গৌরব হারানো, লজ্জায় লাল ছাত্রলীগ, সামলাবে কে?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 30 Nov 2011, 07:16 AM
Updated : 19 March 2018, 03:40 PM

কিছু ঘটলেই যখন ছাত্রলীগের নাম সামনে চলে আসে আমাদের জাতি সবকিছুর মত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল বলেন, ছাত্রলীগ নামধারীরা করছে। আর একদল বলেন, না এটাই আসলে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ যে অতীত ঐতিহ্যে বলিয়ান সেখানেও আছে হানাহানি। চার খলিফার একজন প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস মাখন ব্যতীত বাকীদের কি চেহারা?

আ স ম রব ঘোর আওয়ামী বিরোধী। পারলে বঙ্গবন্ধুরও পিণ্ডি চটকান। নূরে আলম সিদ্দিকীর মত বক্তা লীগের কথা বলেন না। শাহজাহান সিরাজ তো তাদের দলের জন্য মীরজাফরই বটে। স্বাধীনতার পরপর দেশের রাজনীতিতে যে বিভক্তি আর সর্বনাশ, তার দুয়ার খুলেছিল ছাত্র রাজনীতি। সেই জাসদ আজ অতীত। কিন্তু ইতিহাস তো জ্বলজ্বলে।

বলছিলাম এখনকার ছাত্রলীগের কথা তাদের তাণ্ডব বা তাদের নামে যে তাণ্ডব এমনকি শ্লীলতাহানি তার কোন জবাবদিহিতা তৈরি করতে পারেনি ছাত্রলীগ। এদিকে মানুষের মনে ভয় আর উদ্বেগ বাড়ছে তাদের নিয়ে। বাড়ার মত কাজ করছে তাদের একাংশ।

গত বছর ডিসেম্বরে আমি কয়দিনের জন্য দেশে গিয়েছিলাম।  চট্টগ্রাম আমার জন্মস্থান। সেখানে বড় হয়েছি আমি। এই শহরের নাড়ি-স্পন্দন আমার জানা। রাজনীতি বিমুখ মানুষের মন পাঠের জন্য খুব বেশি কোথাও যেতে হয়না। ঘরের মানুষই যথেষ্ট। কি আশ্চর্য সংখ্যালঘু নামে পরিচিত নৌকার ভোটারদের মনেও দেখলাম পরম বিতৃষ্ণা। তাদের এককথা শান্তি চাই। শান্তি কোথায় নাই আর কোথায় আছে সেটা খোঁজার জন্যও দূরে যেতে হয়না। আমাদের শহরের প্রিয় মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী তখন সদ্য প্রয়াত। তাঁর ভুল বা দোষগুলো আর বিচার করছেনা মানুষ। সর্বত্র তাঁর জন্য প্রার্থনা আর তাঁর সদগুণের আলোচনা। বিএনপির মানুষজন ও দেখলাম তাঁর প্রশংসা করছিলো। এই রাজনৈতিক শিষ্টাচার দেশের জন্য জরুরি। ভালোলাগার সেই রেশ কাটতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এক দুপুরে চারদিকে হৈ চৈ আর কানাঘুষা। জানা গেলো মহিউদ্দীন চৌধুরীর স্মরণে কাঙালি ভোজের জন্য ভাড়া করা তের কি চৌদ্দ (সম্ভবত) টি কমিউনিটি হলের একটিতে পায়ের তলায় পড়ে মারা গেছে বেশ কিছু মানুষ। অনেকগুলো প্রশ্ন তখন আমার মত মানুষের সামনে এমনিতেই খাড়া । তার ওপর এই দুর্ঘটনা। প্রশ্নগুলো অযৌক্তিক কিছু ছিলোনা।

একজন জনপ্রিয় মেয়র বা নেতা যিনি মানুষের চোখের পানিতে বিদায় নিয়েছেন তাঁকে মানুষ অন্তরেই ধারণ করে আছে। কী দরকার ছিলো অতগুলো হল ভাড়া করে মানুষকে ডেকে আনার? এই শো ডাউন যতটা দরকারি তারচেয়েও বেশি ছিলো লোক দেখানো। মানুষের কথা বলছিলাম, তাদের মনে তখন প্রশ্ন  ঢুকিয়ে দিয়েছে নেতারাই। দলের যেসব নেতা বা কর্মীদের উৎসাহে এতগুলো হল ভাড়া করে ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল তারা এটা মাথায় রাখেননি মানুষ এ নিয়ে ভাবতে পারে। ভাবনাটা খাবারের অর্থ বা টাকার উৎস নিয়ে যতটা তারচেয়েও বেশি এই উৎসবময়তা নিয়ে। আমার মনে আরো একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। একজন জননেতার মরণোত্তর খাবারের আয়োজনে ও হিন্দু মুসলমান একসাথে বসে খেতে পারবেনা? কি কারণে হিন্দুদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা? এমন গোশত বা খাবার কি নাই যা উভয়ে মিলে খেতে পারতো? বা এমন ভাবে যাতে কারো মনে আঘাত না লেগেই যার যারটা সে সে খেতো? এটুকু ভাবার অবকাশ ছিলোনা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক নামে পরিচিত সরকারী দলের নেতাদের।

সেদিন দুপুর থেকে রাত অবদি চাটগাঁ পরিণত  হয়েছিল শোকের শহরে। ব্যবস্থাপনার অভাব বা অসতর্কতা যেটাই দায়ী হোক মানুষের প্রাণ গিয়েছিল । আর সে প্রাণ যাবার বিচার চাওয়ার সাহস বা শক্তি ও নাই কারো। যেন যারা মরেছিল তাদের প্রাপ্য ছিলো কিছু টাকা আর সমবেদনা। রাজনীতির এই একমুখি প্রবণতা মহিউদ্দীন চৌধুরীর আদর্শ ছিলোনা। তিনি ছিলেন জনগণের মানুষ। তিনি সেই নেতা যিনি একাধিকবার পরাজিত হবার পর ও হাল ছাড়েননি। বড় কথা হাল ধরে চাটগাঁয় বিএনপির আধিপত্য আর মারমুখিনতা থেকে আওয়ামী লীগকে উদ্ধার করেছিলেন। দলে তখন প্রয়াত আখতারুজ্জামান বাবু ও মহিউদ্দীন চৌধুরীর দ্বন্ধ প্রবল। একদিকে অর্থ আরেকদিকে মানুষের চাওয়া। মহিউদ্দীন চৌধুরী সে টাগ অফ ওয়ারে দলকে বাঁচিয়েছিলেন। একথা মানতে হবে বাবু মিয়া নাথাকলেও দল টিকতোনা। কিন্তু মূল কথা হলো আজকের যে দল আর দলের কান্ডকীর্তি সেটা সেদিন দেখিনি আমরা।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির ভোজ সভার শোক ভুলতে না ভুলতে চাটগাঁর মানুষ কি দেখলো? তাঁর স্মরণ সভায় হাতাহাতি আর মারামারিতে কলঙ্কিত হয়ে গেছে ঐতিহাসিক লালদীঘির পাড়। শোকসভার যাবতীয় নিয়মকানুন আর গাম্ভীর্য ভঙ্গ করে নিজেদের মধ্যে মারামারি হাতাহাতি করা ছাত্রলীগ আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে তারা লাগামহীন। সত্যি বলতে কি পত্রিকা পড়ে মনে হয়েছে এদের কারনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যাবতীয় অর্জন একদিন প্রশ্নময় হয়ে উঠতে পারে। মিডিয়া লিখছে:

লালদীঘির মাঠে নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি আলহাজ এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্মরণ সভায় দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। এক পর্যায়ে মারামারি থামানোর জন্য স্মরণসভা বন্ধ করে মঞ্চের অতিথিদের মাঠে নামতে হয়। পরে প্রধান অতিথির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে সভা শেষ করতে বাধ্য হন। গতকাল সোমবার বিকালে নগর ছাত্রলীগের উদ্যোগে এই স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়।
বিকাল ৪টার পর স্মরণসভা শুরু হয়। ছাত্রলীগের বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড এবং কলেজ শাখার নেতাকর্মীরা নিজ নিজ কমিটির ব্যানার নিয়ে সেখানে হাজির হন। পৌনে ৫টার দিকে মঞ্চের বামপাশে সিটি কলেজ, ডান পাশে চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা নিজ নিজ কলেজের নামে পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিচ্ছিল। মাঝে বসা ওমর গণি এমইএস কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীরাও সমান তালে তাদের কলেজেন নামে স্লোগান দিচ্ছিল। মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা দফায় দফায় স্লোগান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েও ব্যর্থ হন। এই স্লোগানের মধ্যে নগর ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আরশাদুল আলম বাচ্চু বক্তব্য দিতে উঠেন। তার বক্তব্যের পরপরই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। শুরু হয় চেয়ার ছোড়াছুড়ি। এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর চেয়ার ছুড়তে থাকে। এসময় কয়েকটি চেয়ার ভেঙেও যায়। ঘটনায় চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লালদিঘি মাঠজুড়ে ছাত্রলীগকর্মীরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। তাতে সভাস্থলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রণি চেষ্টা চালান। কিন্তু কে শুনে কার কথা। তারা দুই পক্ষকে থামাতে ব্যর্থ হন। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে সভামঞ্চে উপস্থিত যুবলীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় সব নেতা মাঠে নেমে আসেন। তারাও চেষ্টা করেন মারামারি থামাতে। বারবার নির্দেশ দেয়ার পরও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, যারা এরপরও বিশৃঙ্খলা করবে তারা ছাত্রলীগের কেউ না। ভিডিও করা হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই হচ্ছে এখনকার ছাত্রলীগ। এদের কারণে শুধু প্রয়াত মহিউদ্দীন চৌধুরী নন আমাদের লালদীঘিও আজ আক্রান্ত। মনে পড়ে এই সেই মাঠ যেখানে মুক্তিযুদ্ধের নেতারা আসতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা চারনেতা হত্যার পর এই মাঠ হয়ে উঠেছিল আমাদের দুর্গ । এই মাঠে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়ে উঠছিল দেশের আলোকবর্তিকা। এই মাঠে মহিউদ্দীন চৌধুরী চট্টগ্রামকে কতবার ভরসা দিয়েছিলেন কতবার ফুঁসে উঠেছিলেন কতবার আলো জ্বালিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নামধারী বা ছাত্রলীগের নেতাদের তা জানা নাই।

একতরফা রাজনীতি, বিরোধী দলহীন রাজনীতি যা ইচ্ছে করে পার পাওয়ার বা ভয় জাগানোর দলনীতির শিকার ছাত্রলীগ এখন বেপরোয়া। তারা ইতিহাস ইতিহাসের মাঠ নেতা এমনকি ভবিষ্যৎকেও কলঙ্কিত করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এ থকে উত্তরণের জায়গা কি শুধুই শেখ হাসিনা? আর কারো কথায় যদি কাজ নাহয় তো দল চলবে কিভাবে?

মানুষ বড় রেগে আছে। রাজনীতি তা না বুঝলে তাদেরই লোকসান।