ভাবতে গা শিউরে উঠছে না?

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 14 July 2015, 03:42 AM
Updated : 14 July 2015, 03:42 AM

এগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র সেই ঘটনাগুলো- যাদের শুধুমাত্র সন্দেহের বশবতী হয়ে হত্যা করা হয়, বা শধুমাত্র নিপিড়ণের তাগিদ থেকে হত্যা করা হয়। হাতেনাতে ধরেও কাউকে হত্যা করার কোন সুযোগ নেই। সেখানে সন্দেহের বশবতী হয়ে হত্যা, শিশু হত্যা, এদেশে বহুদিন ধরে ঘটছে এবং বিচার হচ্ছে না। অর্থাৎ, হত্যাকারীরা ধরে নিয়েছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সমাজের সায় আছে।

নিচের ঘটনাগুলো সাক্ষ্য দেয়- শিশু রাজনের হত্যাকাণ্ডটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি ধারাবাহিকতা, বিচাহীনতা এবং এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতির ফলাফল।

# ঘটনা-১ :
বন্ধুরা, দেখেন তো মনে করতে পারেন কিনা-
১৭ জুলাই ২০১১, ছয় বছর আগে
সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে শবে বরাতে রাতে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

মনে পড়ে? নিশ্চয়ই মনে পড়ে। নিশ্চিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বলছি যে, সে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। এখন স্বজনদের কান্নার সাথে যোগ হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। আমরা কি পেরেছিলাম ঐ ঘটনার পরে লাগাতার প্রতিবাদ করে যেতে? পারিনি, ভুলি গেছি বেমালুম। আমি ফেসবুক টাইমলাইনে বিষয়টা স্টিকি করে রেখে দায় সেরেছি মাত্র, এখনো আছে। আচ্ছা, ঐদিন যাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের একটু স্মরণ করতে চাইলে কি রাষ্ট্র নাখোশ হবে?

হতে পারে, তবু স্মরণ করি-

নিহত ছাত্ররা হলেন, ম্যাপল লিফের এ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শামীম (১৮), মিরপুর বাঙলা কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ (২০), একই কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল (২১), উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত (১৬), তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান (১৯) ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবির মুনিব (২০)।


# ঘটনা-২ :
১৯ জুন ২০১৩, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে মুকুন্দগাঁতী বাজারে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে মুরতুজ আলী সন্তোষ (১২) নামে একজন শিশুর মৃত্যু হয়। সে স্থানীয় একটি মিলে কাজ করত। ঐদিন সিনেমা দেখে বাড়ি না ফিরে মিলেই ঘুমায়। ভোরে বাড়ি ফেরার সময় চোর সন্দেহে স্থানীয় শহিদসহ কয়েকজন শিশুটিকে বেধড়ক মারধর করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে সন্তোষ মারা যায়।  ভয়ংকর ব্যাপার কি জানেন- হত্যাকারীরা শিশুটির পরিবারের সাথে আপোশ করে ফেলে। পুলিশও সরে আসে।

# ঘটনা-৩ :
১৬ ডিসেম্বর ২০১৩, রাজধানীর মিরপুরে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে মোহাম্মদ ইমরান (১৪) নামে এক কিশোর নিহত হয় । বন্ধুরা, মনে নাও পড়তে পারে, কারণ খুব বেশি আলোচিত ঘটনা ছিল না এটি।
নিহতের বোনের জবানিতে ঘটনাটা ছিল এরকম- দু'একদিন আগে বস্তির পাশে কল্যাণপুর ১২ নম্বর সড়কে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ঢেউটিন চুরি হয়। রবিবার রাতে ভবনের নিরাপত্তাকর্মীসহ স্থানীয় কয়েকজন ইমরানসহ চারজনকে চোর সন্দেহে ধরে নিয়ে যায়। সারা রাত তাদেরকে বেধড়ক মারধর করে। সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন যুবক ইমরানকে মুমূর্ষু অবস্থায় বস্তিতে ফেলে যায়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে সে মারা যায়। ইমরানরা কল্যাণপুরের নতুন বাজারের কাছে ৬ নম্বর বস্তিতে থাকে।
উক্ত ঘটনার বিচারের আপডেট জানি না।

# ঘটনা-৪ :
৪ আগস্ট ২০১৪ তারিখের ঘটনা। চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে নিহত হয় মো. রনি (১৮)। বিচারের আপডেট জানি না।

# ঘটনা-৫ :
চলতি বছরের ঘটনা। ২৯ মার্চ ২০১৫,  রাজধানীর দারুস সালামের হরিরামপুরের চিতাখোলা এলাকায় কয়েকজন যুবকের  পিটুনিতে  আলআমিন (১০) নামে এক শিশু নিহত হয়। কেন মারা হয়েছিল তাকে? জানতে হবে তো- কারণ, সেখানে চুরি বা এ ধরনের কোন অজুহাত ছিল না, এটা ছিল স্রেফ একটি নিপীড়ণের ঘটনা। আলাআমিন তখন ন্যাড়া ছিল। ঐ যুবকেরা আলআমিনের মাথায় বালু দেয়। আলআমিন একটু শক্ত প্রতিবাদ করলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তাকে। এই ঘটনার বিচার হয়েছি কিনা জানি না।তবে তখন এই ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আপডেট জানি না।

এর সাথে আরেকটি ঘটনা মিলিয়ে নিতে হবে। সেই যে আমরা 'সিনেমা' দেখেছিলাম, একেবারে লাইভ! সবারই মনে থাকার কথা। বলছি, শাহাজানপুরে পরিত্যাক্ত পানির বোরহোল পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যু এবং রাষ্ট্রীয় ভাওতাবাজির কথা। সে ঘটনাটাও আড়াল হয়ে গেল। বিচার হল কিনা আমরা জানলাম না। কোন ফলোআপ রিপোর্ট কোথাও নেই।


সমগ্র ঘটনার তুলনায় এগুলো কিছু নমূনা মাত্র। তাহলে ভয়াবহতা অাঁচ করুন। মিডিয়াতে আসেনি এমন ঘটনাও তো নিশ্চয়ই আছে। অর্থাৎ, নাগরিক হিসেবে আমাদের দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা লাগাতার প্রতিবাদ করে যেতে ব্যর্থ হয়েছি। একদল আমরা রাস্তায় পড়ে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছি, রাষ্ট্রকে খুনিদের বিচারের আওতায় নিতে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই আজকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড।
ক্ষমা নেই আমাদেরও। কবে জানি আমার আপনার সন্তানও …ভাবতে গা শিউরে উঠছে না?

** ছবিগুলো নেট থেকে সংগৃহীত। সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকা থেকে নেওয়া।