বারে বারে একই ধরনের দুর্ঘটনা, একই জায়গায় দুর্ঘটনা

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 25 July 2015, 06:11 PM
Updated : 25 July 2015, 06:11 PM

আমি সারজীবন ড্রাইভারদের দেখে বিমোহীত। একটা 'ঘর' ঐ গতিতে যারা চালিয়ে নিয়ে যায় তাদের স্যালুট না করে পারিনে। যখন কোন গাড়িতে থাকি, তখন প্রতি মুহূর্তে আমার ভাগ্যলিপি লিখছেন ড্রাইভার। দুর্ঘটনা ঘটার একশো একটা কারণ থাকে, ইন্টারনাল (যে গাড়িতে আমি চলছি) এবং এক্সটারনাল (যে গাড়িগুলো রাস্তায় চলছে), দুইধরনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আমি সহজে যেটা বুঝি- দুর্ঘটনা ঘটার প্রধান কারণ, চালকের অদক্ষতা এবং মনসংযোগের অভাব। তবে আমাদের দেশে প্রধান কারণ এটি নাও হতে পারে। জনসংখ্যার তুলনায় রাস্তা কম, গাড়ি বেশি, বিভিন্ন রকমের গাড়ি -এটাই হয়ত প্রধান কারণ। এক বন্ধুর কাছে শুনছিলাম- রাশিয়ায় নাকি বিশাল বিশাল মহাসড়ক, কিন্তু গাড়ি চলে অনেক্ষণ পর পর একটা।
যাইহোক, ড্রাইভারদের কথায় আসি।
* যাদের উপর আমাদের জীবন মরণের ভার, কতটুকু কেয়ার করি আমরা তাদের?
* কারা পরিচালনা করছে গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটি?
* কতটুকু সুযোগ সুবিধা পান তারা?
* তাদের কর্মঘণ্টাই বা কতক্ষণ?
আমার এক আত্মীয় আছে আমেরিকায়। দীর্ঘদিন ধরে সে চেষ্টা করেছে ড্রাইভার হওয়ার। অবশেষে সফল হয়েছে। সব কাজ বাদ দিয়ে রিস্কি পেশায় কেন যাওয়া -এ প্রশ্ন আমি তাকে করেছিলাম। সে বলল, আয় বেশি। তাছাড়া আরো অনেক সুযোগ সুবিধা আছে।
আমাদের দেশের চালকদের অবস্থা কী? একেবারেই সঙ্গীন নয় কি? তাদের জন্য কোন ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করা নেই, তাদের জীবন বিমা নেই, কোন সুযোগ সুবিধাই তাদের জন্য বরাদ্দ নেই। শুধু চালকদের শাস্তির কথা বললে তো হবে না, দুর্ঘটনায় যখন কোন চালক মারা যায়, তখন তার পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? চালকের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা তো সবচে বেশি, কারণ জীবনের একটা বড় সময় সে গাড়ি চালিয়ে কাটাল।
পাশাপাশি এদেশে চালকদের অসম্মানের তো শেষ নেই। যে লোকটা আপনাকে আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দেবে বলে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার চাচ্ছি, তার প্রতি আমাদের কমিটমেন্ট কতটুকু? ঢাকায় পাবলিক বাসে হরহামেশাই ড্রাইভারদের গালাগাল করা হয়, চড় থাপ্পড়ও মারা হয়। গাড়ির কাগজপত্র না থাকায় দায় মালিকের, কিন্তু পুলিশের হেনস্থার শিকার হয় প্রধানত ড্রাইভারেরা।
সাধারণত, সুযোগ পেলেই আমি গাড়ির সামনে বসি, এতে করে সবকিছু দেখা যায়। বাড়ি থেকে আসার সময় আমাদের বাড়ি থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত সাধারণ সড়ক, ঐ সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলে, আসলে আমাদের মহাসড়কেও সব ধরণের যানবাহন চলে। একটু সামনে বসে খেয়াল করে দেখবেন, রীতিমত ভয়ঙ্কর বিষয়, ছোট ছোট গাড়িগুলোকে যেভাবে বাসটি অতিক্রম করে যায় তাতে যেকোন সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। একটু বেধে গেলেই পিচ্চি গাড়িটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। যায়ও।
শুনলাম, সরকার নাকি মহাসড়কে ছোট যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। ভাল সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তে অটল থাকা জরুরী। তবে সর্বাগ্রে জরুরী চালকদের জন্য কারিগরি এবং মনস্তাস্ত্বিক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। চালকদের জন্য ফ্রি ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা দরকার। আসলে ট্রেনিং দরকার পুরো জাতির। সবার আচার ব্যবহার শেখা দরকার। চালকদের সাথে আচার ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, তার চমৎকার উদাহরণ বাগেরহাট টু পিরোজপুর সড়ক। কারণ, ঐ সড়কে অনেক মালিক নিজেই ড্রাইভার, অথবা মালিকের ছেলে ড্রাইভার, মানে চালকই মালিক। দুর্বব্যবহার করে সেখানে পার পাওয়া যায় না। সমস্যা হচ্ছে, ওরা আবার যাত্রীদের হেনস্থা করে।
আচার আচারণ ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেলে যা হয়। এ দেশে কার সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে, সেটি নির্ভর করে তার অবস্থান এবং ক্ষমতার উপর। অথচ আচরণ কোন আপেক্ষিক বিষয় নয়, এটা একটি কনস্ট্যান্ট বিষয়। একজন ভদ্রলোক সবার সাথে ভদ্র আচরণ করার কথা, কিন্তু তা হচ্ছে না, ভদ্রলোকটি জায়গা মত ভদ্র, আবার সুযোগ পেলেই সে অভদ্র। আবার সমাজের অধঃস্থন মানুষেরা যেহেতু অভদ্র ব্যবহারে এতদিনে অভ্যস্থ হয়েছে, তাই কেউ ভদ্র ব্যবহার করলে তাকে পেয়ে বসে, ভাবে সে দুর্বল বলে ভদ্র আচরণ করছে। বড় বিপদ হয়ে গেছে। উভয় সংকটে পড়ে গেছি আমরা। বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া কিছু হবে বলে মনে হয় না। প্রতিদিন দুর্ঘটনায় বেঘোরে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, হচ্ছে তো হচ্ছেই, চলছেই, একই ধরনের দুর্ঘটনা, একই জায়গায় দুর্ঘটনা বারে বারে! এটা কোন সভ্য দেশে মেনে নেওয়া যায় না।