ঘুরে এলাম টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ এবং মিয়ানমারের মংডু

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 4 May 2016, 06:44 PM
Updated : 4 May 2016, 06:44 PM

টু দ্যা পয়েন্টে ফকিরেপুল পৌঁছে বাস ধরলাম। নারী-পুরুষের স্বস্তিদা্য়ক অনুপাতে (আমি বাদে সমান সমান) প্রিত হলাম এই ভেবে যে, তাতে অন্তত অহেতুক ফ্রয়ডীয় ঈর্ষা থেকে অনেকে মুক্তি পাবে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। না হোক, সেও তো আরেক মজা।

টেকনাফ পৌঁছলাম সকাল আটটা নাগাদ। হোটেলে উঠে প্রাতঃকর্ম সেরে চলে গেলাম দলবলে শাহপরীর দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত। মূল ভূখণ্ড বলতে সাগর না পেরিয়ে শাহপরীর দ্বীপ যাওয়া যায়। তবে একদম সাগড় পাড়ে। প্রাকৃতিক, মনোরম এক সমুদ্র সৈকত। দ্বীপের বাম পাশে নাফ নদী। নদীর ঐ পারে বার্মা বা মায়ানমার সীমান্ত।

এই দ্বীপের নামকরণ নিয়ে কিছু মিথ প্রচলিত আছে।এর নামকরন সম্পর্কে কেউ বলেন সম্রাট শাহ সুজার 'শাহ' আর তাঁর স্ত্রী পরীবানুর 'পরী' মিলিয়ে নামকরণ হয়েছিল এই দ্বীপের, কারো মতে 'শাহ ফরিদ' আউলিয়ার নামে দ্বীপের নাম করণ হয়েছে। অপরদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি সা'বারিদ খাঁ'র 'হানিফা ও কয়রাপরী' কাব্য গ্রন্থের অন্যতম চরিত্র 'শাহপরী'। রোখাম রাজ্যের রাণী কয়রাপরীর মেয়ে শাহপরীর নামেই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে বলেও অনেকে বলেন।

একসময় এই দ্বীপটি আয়তনে অনেক বড় থাকলেও বর্তমানে ছোট হতে হতে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগে শাহপরীর দ্বীপের আয়তন ছিল দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ছোট হয়ে দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৩ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ভাঙন অব্যাহত আছে।

টেকনাফ থেকে সড়ক পথে শাহপরীর দ্বীপের দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার। সড়ক পথ হলেও মাঝখানে পথ ভাঙা থাকার কারণে কিছুটা পথ ইঞ্জিন চালিত নৌকায় পার হতে হয়।

শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম নাফ নদীর উপর নির্মিত জেটিতে। সেটি মূলত একটি সীমানা চৌকি। ওখানে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বালক বশি দিয়ে এক কোরাল মাছ উঠিয়ে আনল। সাথে আরো কিছু মাছ দেখলাম। চমৎকার তাজা মাছ। তবে বালকটি সে মাছের মালিক নয়। মাছ কিনতে চাইলাম। মালিক নাই বলে আর মাছ কেনা হল না। অগত্যা মাছের সাথে সবাই ছবি তুললাম।

এরপর গেলামে একদম সমুদ্র ঘেষে অবস্থিত বাগারপাড়ায় (নামটি ভুল হতে পারে)। প্রথমে সমুদ্রে গিয়ে দাপাদাপি করলাম। বিশাল

বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল তীর ঘেষে। কক্সবাজারে এত বড় ঢেউ দেখা যায় না। আমরা নেমেও গেলাম অনেকদূর। ফিরতে কষ্ট হচ্ছিল, জোয়ার ছিল বলে বেঁচে গেছি।

বাগারপাড়ায় এসে ডাব খেলাম। ওদের সাথে কথা বললাম, ছবি তুললাম। মনে হল- পরিবারগুলো একেবারে সমুদ্রের সাথে মিশে আছে নির্ভয়ে।

শাহপরীর দ্বীপ থেকে ফিরে টেকনাথে গ্রিন গার্ডেন নাম একটি হোটেলে রাত কাটালাম। সকালে রওনা হলাম মিয়ানমারের মংডুর উদ্দেশ্যে। মংডু হচ্ছে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের একটি ছোট শহর। টেকনাফের মতই। তবে কালচার একেবারে ভিন্ন।

ওখানে যাওয়ার কিছু হ্যাপা আছে। ইমিগ্রেশন থেকে একটি টেমপরারি পাসপোর্ট নিতে হয়। পাসপোর্ট নিতে দুই কপি ছবি এবং ভোটার আইডি কাডের ফটোকপি লাগে। ইমিগ্রেশন ফি লাগে। এরপর ট্রলার পেরিয়ে যাওয়া যায় মিয়ানমারের মংডু। মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস নেওয়া যায় না। একটি মোবাইল নিতে হলে মিয়ানমার কাস্টমসকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। ট্রলারভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা।

মংডুতে থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। দেখতে না জানলে দেখারও তেমন কিছু নেই।

আমরা ছিলাম কেন্নাই গেস্ট হাউজে। এটি বাইরে থেকে দেখতে যত ভালো দেখা যাচ্ছে আসলে ভেতরটা অত ভালো নয়। ওখানে আরেকটা সংকট হচ্ছে- ইলেকট্রিসিটি। রাতে সরকারি বিদ্যুত থাকে না। বিকল্প হচ্ছে জেনারেটর বা সোলার।

দেখার মধ্যে দেখলাম রাখাইনদের চালচলন এবং খাদ্যাভাস। অন্যরা তো আমাদের এ পাশের মতই। পার্থক্য বলতে কাপড়টা ওরা বেশিরভাগ মিয়ানমারের কালচার মেনে পরে। অর্থাৎ লুঙ্গি ইন করে পরলে যেমন হয়।

রাতটুকু থেকে সকালে দল ছেড়ে একটু ভেতরে গেলাম। দেখলাম সুন্দর ছিমছাম গ্রাম। ধনী না হলেও তারা খুব সাজিয়ে থাকে। ওখানে আছে হিন্দু পাড়া এবং মুসলিম পাড়া। অদূরে আছে রাখাইন পাড়া।

সব মিলিয়ে চব্বিশ-পঁচিশ ঘণ্টা আমরা ওখানে ছিলাম। ঘর হতে দু'পা র বেশি ফেলার সুযোগ ছিল না, অনুমতি ছিল তিন কিলোমিটার। যাওয়া হয়ত যায় চোখ এড়িয়ে আরো খানিকদূর। তবে যেহেতু দলটি নারী-পুরুষ মিলিয়ে দশজনের তাই একমত হতে হতেই সময় চলে যায় অনেক। দলটির সবার মধ্যে যে জানাশোনা খুব বেশি তাও আসলে নয়।

অবশ্য দল থেকে উপদল হয়ে কেউ কেউ যে বাড়তি কিছু দেখেছে তার নজির তো নিচের ছবিগুলো, আমরা যেহেতু সেখানে সদলবলে যাইনি। যােইহোক আমরা ছবি তো অন্তত দেখছি!

তারপরেও হয়েছে তো অনেক কিছুই। নতুন স্থান দেখা হয়েছে, নতুন সংস্কৃতির সাথে সংযোগ সাধন হয়েছে, নিজেদেরকেও জানাশোনা হয়েছে।

তবে কিছু বিষয় মাথায় রাখলে এ ধরনের ট্যুর আরো উপভোগ্য হতে পারে। যেমন-

১। ছোট দলে যাওয়া ভালো, তাতে বোঝাপড়া সহজ হয়, অবশ্য দলটা খুব বেশি বড় ছিল না, তবে বোঝাপড়ায় ঘাটতি ছিল;

২। গ্রুপের মধ্যে উপগ্রুপ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরী;

৩। একজনকে দায়িত্ব না দিয়ে, কমপক্ষে দুইজনকে ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া উচিৎ;

৪। শার্প টাইমলিমিট না থাকাই ভালো। একদুই দিন হাতে নিয়ে গেলে সুবিধে হয়;

৫। প্রত্যেকের খরচ বাঁচিয়ে চলার মানুসিকতা থাকা দরকার। একটু সতর্ক হলেই অনেক খরচ বাঁচানো যায়। খাওয়ার আগে অবশ্যই দাম জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিৎ। যানবাহন রিজার্ভ করলে সবদিক চুকিয়ে নেওয়া উচিৎ;

৬। ট্যুরে একান্ত আপনজন নিয়ে গেলে কোনো দায়িত্ব আপনি নিতে যাবেন না, তাতে হযবরল হয়। অন্যদের কাছে বিষয়টি বিরক্তিকর হতে পারে।

খুব বড় কোনো লক্ষ্য থাকলে ছোট ছোট কারণে আপনি উচ্ছ্বসিত হতে পারবেন না। ভালোলাগা পর্যন্তই তা সীমাবদ্ধ থাকবে। এমনিতেই আমি দলবদ্ধ অানন্দে খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারিনে, তার উপর বিভিন্ন পারিবারিক দায়িত্বের কারণে মনের অবস্থা খুব একটা খোলামেলা থাকেও না।

এবার ইচ্ছে ছিল সময়টা ঝাঁপিয়ে-দাপিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার। খুব একটা তা হয়নি, আবার একেবারে যে হয়নি তাও নয়।

প্রত্যেকটা নতুন জায়গায় দেখার-বোঝার থাকে অনেক কিছু, তবে সেজন্য সময় দিতে হয়, চোখ ঘুরিয়ে চলে আসলে অনেক সময় শুধু ক্লান্তিই বাড়ে। তাই ট্যুরের ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটি দর্শন আছে- সময় নির্দিষ্ট করে যেতে আমি রাজি নই। জায়গাটিকে একজস্ট করে আসতে যত সময় লাগার লাগবে, নট লুক এট অনলি, আই লাইক টু লুক ইনটু।

টাইম বাজেট করে গেলে সে জিনিসটা হয় না, গ্রুপে গেলে আরো কিছু সমস্যা থাকে, সবার মতামত এক করা, সবাইকে এক পালে রাখা -এগুলো বিগ চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া পরিবেশ এবং প্রাকটিসের কারণে আমরা খুব বেশি এডভেঞ্চার-প্রিয় নই, যার কারণে গাছের আম তলায় না পড়লে বা কেউ না পেড়ে দিলে আমাদের খাওয়ার জো নেই।

তাই খুব বেশি প্রত্যাশা এ ট্যুর থেকে আমার ছিল না। তাতে কিছু যায় আসে না, চোখ খোলা থাকলেই আমার মন ভরে যায়। হয়েছেও তাই।