এভাবে সবাই তলিয়ে থাকছে অতলে সদলবলে

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 19 June 2016, 05:16 PM
Updated : 19 June 2016, 05:16 PM

আমি কোনোভাবেই মনে করতে পারছি না যে এদেশের প্রধান সমস্যা জঙ্গিবাদ। বিগত কয়েক দিনের কয়েকটি ঘটনা মনে করলেই বোঝা যাবে তা। তার আগে একটি ঘটনা বলি, মহাখালি বাসস্টান্ডের পাশ দিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে একটি লোক মরার মত পড়ে আছে। সারা গায়ে মাছি উড়ছে। মুখের পাশে মাছি ভন ভন করছে।

পাশে দিয়ে উন্মাদের মত মানুষ ছুটছে, একটু পরেই ইফতার, আশেপাশে তাকানোর ফুসরত মানুষের নেই। লোকটির পাশ ঘেষেই একটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে ছোলা-বেগুনি-আলুটালু এইসব। যে যার মত কিনছে। কেউ একবার তাকিয়েও দেখছে না, সবার চোখগুলো আপন বৈশিষ্ট হারিয়ে বড্ড বেশি সরলরৈখিক হয়ে গেল, ত্রিমাত্রিকভাবে দেখার ক্ষমতা সবার দুই চোখ হারিয়ে ফেলল।

হতে পারে লোকটি নেশাখোর, হতে পারে লোকটি ভাগ্যহত, হতে পারে লোকটি সিনতাইয়ের স্বীকার, হতে পারে লোকটি পথের পাগল, অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু পাশ দিয়ে হাজার হাজার সুস্থ লোক নির্বিকার হেঁটে যাবে, তা কি হতে পারে? আমার কাছে জঙ্গীবাদের চেয়ে মানুষের এ মনস্তত্ত্ব বেশি ভয়ংকর ঠেকছে।

কয়েক দিন আগে খুলনায় ছিলাম। ওখানকার একটি স্থানীয় পত্রিকায় পড়লাম, মা নয় বছরের ছেলেকে খুন করিয়েছে, কারণ, ছেলে মায়ের বিবাহবহির্ভূত যৌনকর্ম দেখে ফেলেছে! খবরটি বিশ্বাস না হওয়ায় যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছি। বিবাহবহির্ভূত যৌনকর্ম এবং তা দুর্ঘটনাক্রমে কেউ দেখে ফেলা বিস্ময়ের নয়, বিস্ময় হচ্ছে, মা ছেলেকে খুন করাচ্ছে …

চট্টগ্রামের খবর হচ্ছে, ভাড়া ঠিকমত মেটাতে না পারায় এবং বাকবিতণ্ডা হওয়ায় সিএনজি চালক সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দম্পতিকে কিলঘুষি মেরেছে, মহিলার কোলে থাকা আটমাসের বাচ্চাও রেহাই পায়নি, মারা গিয়েছে তৎক্ষণাত। ফেসবুকেই দেখলাম, কাঁঠাল বিচি নিয়ে শিশুদের মধ্যের বিতণ্ডা বড়দের মধ্যে গড়িয়েছে, এবং দুইজন নিহত হয়েছে।

এগুলোকে আপনি কী বলবেন? এই অসহিঞ্চুতার ব্যাখ্যা কী? এ তো ধর্মীয় অসহিঞ্চুতা না, তাহলে এর ব্যাখ্যা কী দেবেন?

নেট থেকে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণাপত্র পড়ছিলাম নিজের ভাবনার সাথে মিলিয়ে। দেখলাম, জন্মের পর একটি শিশু কীভাবে এবং কেমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠবে, সে শিক্ষা প্রথমত সে পায় পরিবার থেকে, দ্বিতীয় পায় সমাজ তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।

নৈতিকতার শিক্ষা, মানবিকতার শিক্ষা, সহিঞ্চুতার শিক্ষা আমাদের সমাজে একেবারেই অনুপস্থিত। ধর্মের নামে শিশুবয়স থেকেই শত্রু চেনানো হচ্ছে, পরিবার পদে পদে শেখাচ্ছে কিভাবে বৈষয়িক লাভ করতে হয়, কিভাবে অন্য শিশুদের ছোট ভাবতে হয়। শেখাচ্ছে কিভাবে অন্যের চেয়ে বেশি মার্কস পেয়ে গর্ব করতে হয় …

পুরো সমাজটাই হয়ে উঠেছে অভদ্র, অসভ্য। সুযোগ পেলেই একে অপরের দিকে তেড়ে যাচ্ছে, অল্পতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায় দুজন রিক্সালার বাকবিতণ্ডা, খুব তুচ্ছ কারণে তারা একে অপরের দিকে তেড়ে যাচ্ছে, অথচ দু'জনই রিক্সালা।

গাড়িতে রিক্সার ছোঁয়া লাগতেই মালিক চালকসহ নেমে এসে রিক্সালার ঘাড় মটকাছে, রিক্সালা আবার এর শোধ তুলছে কোনো নিরীহ যাত্রীকে হয়রানি করে। পুরো সমজাটা চলছে শোধ প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে।

জঙ্গীবাদ তো রাজনৈতিক বিষয়, রাজনৈতিকভাবে যা মোকাবেলা করা সম্ভব, যদি সরকার তা চায়, কিন্তু সামাজিক এ সমস্যাগুলো তড়িৎ মোকাবেলা করা যায় না, এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মধ্যে দরদ-ভালবাসা-মানবিকতা-সহিঞ্চুতার শিক্ষা পরোক্ষভাবে থাকা দরকার। কিন্তু তা নেই। চটুল বিষয় নিয়ে চলছে আমাদের গণমাধ্যম।

স্কুলের পাঠ্যবই পরিকল্পিতভাবে তৈরি হচ্ছে না। কনটেন্ট এবং কনসেপ্টের চেয়ে সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে লেখকের নাম-পরিচয় এবং রাজনৈতিক বিষয়। এর বাইরে মাদ্রাসায় এক কোটি শিক্ষার্থী কঠোর-কঠিন পরিবেশে যা পড়ছে, তা একজন মানুষকে টেনে তোলে না, বরং অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

গ্রামে গিয়ে দেখলাম, মানুষের হাহাকার; এ হাহাকার বড় হবার নয়, এ হাহাকার বেদনার নয়, এ হাহাকার মানব জীবনের অবশ্যম্ভাবি শূন্যতার নয়। এ হাহাকার অহংকার করার জন্য, উদ্ধত হবার জন্য, সুযোগ পেলেই তারা তা করছে, অন্যকে ছোট করার জন্য সবাই যেন মুখিয়ে আছে। এভাবে সবাই তলিয়ে থাকছে অতলে সদলবলে।