তারা জঙ্গীদের চেয়েও অপরাধি

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 27 June 2016, 06:29 PM
Updated : 27 June 2016, 06:29 PM

অসুস্থ রোগীর জন্য কিছু অর্থের সংস্থান করা খুব কঠিন নয়, টাকা থাকলে দেওয়া যায়, কিন্তু তার পাশে থাকা খুব কঠিন, তার বর্তমান অনুভূতি এবং দুঃখের সাথে বাস করা খুব কঠিন, সময় থাকলেই সবাই তা পারে না। বেশিরভাগ মানুষই তা পারে না।

অনেক কিছুই দেওয়া যায়, কিন্তু ভালবাসা জিনিসটাই খুব শক্ত। অাবার সবাইকে ভালবাসার বিপদও আছে, অাপনি এত মানুষের পাশে কখন থাকবেন? অবশেষে কারো পাশে না থেকে বড় কাজে মন দেন মানবতাবাদীরা।

এই বড় মানুষগুলোও কখনো কখনো স্বার্থপর আখ্যা পান যেহেতু তাঁরা ব্যস্ত থাকেন এবং নির্দিষ্ট করে কোনো মানুষের পাশে দাঁড়ান না।

অনেকেই আছেন যে একজন কলেরা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে একটি ভালো কলেরা হাসপাতাল গড়ার জন্য সময় দিয়ে যাচ্ছেন। এটা একটি উদাহরণ মাত্র। একজন মানুষ খুব বেশি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু চাইলে একজন মানুষ যুগান্তকারী কিছু করতে পারে, যা একসাথে অনেক মানুষের মুক্তি এনে দেয়।

পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে থাকা মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেখলাম, কাজটি খুব কঠিন। দুই কারণে খুব কঠিন, ১। অর্থ সংস্থান; ২। তাদের সাথে থাকা।

মানসিক রোগীরা একেবারে শিশুর মত হয়, ওদের তালে তাল দিয়ে চলতে হয়। কতক্ষণ পারা যায়? ক্লান্তি আসে, বিরক্তি আসে। পাগলকে তালাবদ্ধ করে রাখা কখনই চিকিৎসা নয়, কিন্তু সে কাজটি আমাদের করতে হয় ঐ বিরক্তি থেকে, বাধ্য হয়ে।

মাত্র তিনজন মানসিক রোগীর চিকিৎসা করাতে আমি ব্যর্থ হয়েছি, একটা সময় এসে হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এ ধরনের রোগীর সংখ্যা তো তিনজন নয়, হয়ত শুধু বাংলাদেশেই কয়েক লক্ষ।

এরকম হয়ত ভাবা যায়, ষোলো কোটি মানুষ কয়েক লক্ষের দায়িত্ব নেবে না? ভাবনাটা সহজ, কিন্তু তা হয় না। সকল বৈকল্যতা দেখা যায় না। সমাজে সক্ষম মানুষ খুব বেশি থাকে না।
আর্থিক সামর্থই এক্ষেত্রে শেষ কথা নয়। তাই অামি কখনই আশা করি না যে চারপাশের খুব বেশি মানুষ বিশেষ কিছু করবে, কারণ, খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, জীবন-যাপন করতে মানুষ কতটা হিমশিম খায়। দেখেছি, সামান্য একটা জিনিস না পেয়ে তারা কতটা দুঃখবোধ করে। তারাও তো মানসিক রোগী, পার্থক্য এই যে তাদেরটা শুধু চোখে পড়ে না। দু্ই পক্ষের চিকিৎসাও দুই ধরনের। একপক্ষের জন্য দরকার নৈতিকতা ও জীবনবোধের শিক্ষা, অারেকপক্ষের জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা।

যে কথা বলছিলাম, তিন জন রোগীর চিকিৎসা করাতে আমার ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে একজন একজন করে খুব বেশি মানুষের জন্য কিছু করা যায় না, যদিও একজন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই অবশ্যই। তবে অনেকে সেটি করবে সে আশাও করা যায় না।

তাহলে সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে, যদি এমন একটি ব্যবস্থা রাষ্ট্রে থাকত যে রাষ্ট্রই এদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে, তাহলে ব্যক্তির কাজটি খুব সহজ হয়ে যেত। আমি শুধু রোগীদের রাষ্ট্রীয় হাসপাতালটিতে পৌঁছে দিতাম। রাষ্ট্রীয় হাসপাতাল আছে বটে, তবে সেগুলো সুস্থ নয়, এবং অপরাধীও।

যে রাষ্ট্র নিজেই মানসিক রোগী, যে রাষ্ট্রের নৈতিকতা ও জীবনবোধের কোনো শিক্ষা নেই, সে তার নাগরিকদের সেবা দেবে কীভাবে? এই কারণেই আমার সবসময় মনে হয়, রাষ্ট্রীয়বোধ খুব বড় জিনিস। রাষ্ট্রীয়বোধ দেশের সকল মানুষের বোধ নয়, এটি বড়জোর হাজারখানেক মানুষের চিন্তাভাবনা-নৈতিকতা-স্বপ্নের সমষ্টি।

প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন, কেমনভাবে তিনি ভাবতে পারেন, এটা একটা রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তিনশো পঞ্চাশজন সাংসদ কী ভাবছেন, তাদের ভাবানার সামার্থ কতটুকু, তাদের নৈতিকতা, হৃদয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা কাদের বসাতে পেরেছি রাষ্ট্রক্ষমতায়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আপনি কাকে চয়েজ করবেন? অপশন হয়ত সব সময় আপনার কাছে অনেক থাকবে না। অপশন যদি এমন হয়- একজন অত্যন্ত দক্ষ তবে নিষ্ঠুর এবং দুর্নীতিপরায়ন, আরেকজন কম দক্ষ তবে সৎ এবং মানবিক। অবশ্যই আমার উচিৎ দ্বীতিয়জনকে বেঁছে নেওয়া।
কাজের তাগিয়ে অচিরেই সে দক্ষ হবে, কিন্তু কোনোকিছুর বিনিময়ে একজন অসৎ লোক সৎ হবে না, একজন নিষ্ঠুর লোক দরদী হবে না।

রাষ্ট্র পরিবর্তনের জোরজবরদস্তিমূলক কোনো হাতিয়ার বর্তমানে আর কার্যকর নয়। সমাজ পরিবর্তনও জোর করে হবে না। গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়, ইসলামী জঙ্গীবাদের পুরোটা পৃষ্ঠপোষকতামূলক এবং ধর্মীয় নয়, এর মধ্যে নিশ্চয়ই অনেকক্ষেত্রে স্বতস্ফুর্ততা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী জঙ্গীবাদ আর অাফ্রিকার ইসলামী জঙ্গীবাদও নিশ্চয়ই এক নয়।

মার্কসবাদেরও অনেক রকমফের তৈরি হয়েছে। এসব দিয়ে চেষ্টাও এ যাবৎ খুব কম হয়নি, কিন্তু সফলতা নেই। কারণ, মানুষ থেকে দূরে সরে গিয়ে কিছুই হবে না। জবরদস্তিমূলক কিছুই সফলকাম হয় না।

মানুষ যদি কোনোদিন মারা না যেত, তাহলে সমাজটা কেমন হত? আচ্ছা, অামি কেমন হতাম? খুব অলস হতাম? খুব আরামপ্রিয় হতাম? খুব অসৎ হতাম? জানি না, তবে এটা সত্য যে সম্ভবত মানুষ তখন অত্যন্ত সৎ এবং ধীরস্থির হত।

আমার সবসময় মনে হয় জীবনের সংক্ষিপ্ততাই মানুষকে অস্থির এবং অসৎ করেছে। সেটি প্রাচীন দার্শনিকেরা হয়ত উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ধর্ম এবং পরকাল বাতলে দিয়েছেন।

কিন্তু তাতে খুব বেশি কি কাজ হয়েছে? কোটি কোটি প্রাণ পেরিয়ে আজ যে জটিল প্রাণ মানুষ, সে তো বোকা বনে যাওয়ার নয়। স্বাভাবিকভাবেই, বুদ্ধি আছে বলেই, ভাবার ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করতে পারে না, সন্দেহ করে। সন্দেহ এবং দোদুল্যমানতা খুব ভয়ঙ্কর। নিশ্চিত পরকাল আছে বা নিশ্চিত পরাকল নেই, এটি মানুষকে অনেক স্বস্তি এনে দিত।

"পরকাল নিশ্চিত" জানলে ইহকালে সে এতটা ভোগবাদী হত না, এতটা অস্থির এবং অসৎ হত না। "নিশ্চিত পরকাল নেই" জানলে সে পৃথিবীটা সুন্দর এবং বাসযোগ্য করার চেষ্টা করত।

সবাই ভাল থাকতে চায় এবং ভাল হতে চায়, "নিশ্চিত পরকাল নেই" জানলে সে ভাল থাকা এবং একইসাথে ভালো হওয়ার পথও খুঁজে নিত।

অর্থাৎ উত্তর-আধুনিক যুগে এসে আমরা দার্শনিকতার একটা সংকটের মধ্যে পড়েছি। প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানে কল্যাণে মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু আসলে কিছুই ঠিক থাকছে না। একটি জায়গাতে এসেই সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঈশ্বর আছে কি নেই, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, 'পরকাল' আছে কি নেই। নানানভাবে বললেও মানুষ 'পরকাল' আছে বলে বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস যে করেনি তার প্রমাণ মানুষের জীবন-যাপনের ধরণ থেকেই বোঝা যায়।

সমাধান কী? "অন্ধের মত বিশ্বাস করো", একথা তো মানুষকে হাজার হাজার বছর ধরে বলা হচ্ছে, কিন্তু মানুষতো অন্ধভাবে বিশ্বাস করেনি, বরং বিশ্বাসটাকে নিজের স্বহজাত প্রবৃত্তির সাতে খাপ খাওয়াএ নিতে চেয়েছে।

এখন যদি বলা হয়, "বিশ্বাস করো না, পরকালে বিশ্বাস করো না, বরং পৃথিবিটাকেই সুন্দর করো, বাঁচো এবং বাঁচাও।" তাহলে কি মানুষ তা শুনবে?

এটা এমনই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে বিষয়টির সমাধান না হলে রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি কিছুই ঠিক হবে না। তাই বলে এই বিতর্কের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া যেতে পারে না। আবার যারা এই বিতর্ক অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন, তারা জঙ্গীদের চেয়েও অপরাধী বলে আমি মনে করি, কারণ, সমাজে এক ফোঁটাও অবাদান না রেখে নির্বিঘ্নে জীবন কাটাতে চাওয়া মানুষগুলোই শুধু এভাবে পাশ কাটায়।

আমি যেমন জঙ্গীদের চাপাতির আঘাতে নিহত হওয়া রাজীব হায়দার-অভিজিৎ রায়দের জন্য দুঃখবোধ করি, একইসাথে দুঃখবোধ করি ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া ফাহিম-শফিকের জন্য, কারণ, জীবনটা তারা কেউই স্বেচ্ছায় শেষ করেননি।

খুন কখনো আদর্শিক হতে পারে না, এটা শুধু উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং জিঘাংসার ফসল। একইসাথে ক্রসফায়ারে খুনিদের হত্যা করাও কোনো সমাধান নয়, কাম্য নয়, যদিও রাষ্ট্র বলছে বাধ্যবাধকতার কথা।

একথা অবশ্যই সত্য যে এক্ষেত্রে একপক্ষ খুনি, তাই উভয়পক্ষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের একই হতে পারে না। খুনিদের জন্য সবসময় ঘৃণা বরাদ্দ থাকবে। কিন্তু সম্ভাব্য হলেও একটি জায়গায় অন্তত আমি খুনিদের "এসব থেকে দূরে থাকা মানুষদের" চেয়ে এগিয়ে রাখব। প্রশ্ন রাখতে হবে, তারা কি শুধুমাত্র উন্মাদ খুনি, নাকি ভুল হলেও কোনো আদর্শ তাড়িত ছিলেন, কারো দ্বারা মোটিভেটেড ছিলেন? তারাও হয়ত এমন একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যে প্রশ্নটির সমাধান না হলে রাজনীতি বা অর্থনীতি, জীবন-যাপন ইত্যাদি কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না।

"জীবন পৃথিবীতে শুরু পৃথিবীতেই শেষ" এই তত্ত্বের সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনো সংঘর্ষ নেই, সংঘর্ষ আছে 'স্বর্গ-নরক' কনসেপ্টের সাথে।
"মানুষের মনের গহীন কোণে ঈশ্বর থাকে থাক, কিন্তু সে ঈশ্বর যেন মানুষের ভাল-মন্দের বিচার ইহজগতেই করেন। সে ঈশ্বর বা জীবন-যাপনের অবশ্যম্ভাবি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই যেন মানুষের ব্যর্থতা-সফলতার মানদণ্ড হয়।"
এমন একটি তত্ত্ব কি সভ্যতার এই যুগে এসে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে না?