অশুভ গোলাপি আছর ও আমাদের ক্রিকেট

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 24 Nov 2019, 11:38 AM
Updated : 24 Nov 2019, 11:38 AM

"পিচ নিয়ে বলার কিছু আসলে নেই। পিচ কেমন করবে, তাতে যায়-আসে সামান্যই। এই বাংলাদেশ দল 'অর্ডিনারি', তাদের নিবেদন 'অর্ডিনারি', টেকনিক 'অর্ডিনারি।' পিচ যেমনই থাকুক, ম্যাচ আজকে শেষ হয়ে যাবে দ্রুতই।" একটু পর টিভির বিশ্লেষণে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুসারীদের প্রতি সহমর্মিতাও জানালেন গাভাস্কার- "খারাপ লাগে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য। ক্রিকেটের প্রতি তাদের আবেগ প্রবল। কিন্তু দলের কাছ থেকে কতটা প্রতিদান পাচ্ছে তারা? এই দুই টেস্টে কোনও নিবেদন দেখা গেল না ক্রিকেটারদের, চোখে পড়ল না তাড়নার চিহ্ন।"

সুনীল মনোহর গাভাস্কার ক্রিকেট জগতের এক দিকপাল। সারাবিশ্বে এক নামে পরিচিত। তিনি কলকাতা টেস্টের তৃতীয় বা শেষদিন খেলা গড়ানোর আগে এই মন্তব্য করেছিলেন এবং তার ভবিষ্যদ্বাণীকে সার্থক করে ইনিংস পরাজয়ে গুটিয়ে গেছে টাইগারেরা। লেখাটা কি গাভাস্কারের চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে শুরু করবো? ভেসে যাবো কথিত জনপ্রিয়তা আর লাইক কমেন্টের তোড়ে? সাধারণত তাই করে থাকি আমরা।

এই কলকাতা টেস্ট ছিলো ঐতিহাসিক। সৌরভ গাঙ্গুলী যে বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের সমর্থক এবং আমাদের জন্য তার এক ধরনের দুর্বলতা আছে সেটা সবাই জানে। এই ঐতিহাসিক টেস্টটি ঐতিহাসিক হবার কারণ ছিলো পিংক বা গোলাপী বলে রাত দিনের টেস্ট ম্যাচ বলে। সাজ সাজ রবে কলকাতা তৈরি। আমাদের মিডিয়ার যে প্রবল উৎসাহ আর জনমনে যে অপার আগ্রহ তার কিঞ্চিতও ছিল না খেলোয়াড়দের আচরণে। সৌরভ গাঙ্গুলী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব নেয়ার পর এটাই তার প্রথম বড় শো ডাউন। তিনি এটিকে বাংলা ক্রিকেট উৎসব হিসেবে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যেখানে মাঠে উপস্থিত সেখানে আমাদের ক্রিকেটারদের যে বাড়তি উৎসাহ আর মনোবল থাকা দরকার তা কি ছিল আদৌ? না তার কোনও নমুনা দেখলাম আমরা?

প্রথমেই বলি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু স্বমহিমায় ভাস্বর। তার সাথে ইডেন গার্ডেন এর এই বর্ণিল আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। আপনি যদি মিডিয়ার ছবি ও খবরে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে দেখেন আপনাকে বোঝাতে হবে না কতটা সপ্রতিভ আর বলিষ্ঠ আমাদের নেত্রী। তার হাঁটাচলা, খেলোয়াড়দের সাথে দেখা করা, তাদের মাথায় স্নেহের হাত বোলানো থেকে কিংবদন্তী খেলোয়াড় শচীন টেন্ডুলকারের সাথে ছবিতে এটা স্পষ্ট তিনি কতটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। মমতাকে ওপার বাংলার লোকজন দিদি বলে সম্বোধন করেন। এই 'দিদি' সম্বোধন এখন কমন। উভয় বাংলায় 'দিদি' নামে পরিচিত মমতা ব্যানার্জীর সাথে শেখ হাসিনার কথা বলার ভঙ্গী ও আচরণে প্রমাণ হয়ে গেছে আসল দিদি কিন্তু আমাদের নেত্রী। তিনি  কত আগে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসহ ভাবমূর্তি তাকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। তার হাসিমাখা মুখ, দৃপ্ত ভঙ্গি ও মনোবলের একটু ছায়াও পড়লো না ক্রিকেটারদের ওপর!

এই জায়গাটা বিচার বিশ্লেষণ না করে অতি উৎসাহ আর দেশপ্রেমের নামে উল্লাস বা জোশ কোনদিনও ক্রিকেটে সুফল বয়ে আনবে না। আমাদের জাতিগত স্বভাব হচ্ছে উন্মাদনা। একাত্তরের রক্ত ত্যাগ দেশ্রপ্রেমে স্বাধীন দেশ পাওয়ার পর ও আমাদের ঐক্য অটুট থাকেনি। আর সব বিষয়ের মতো ক্রিকেটেও আমরা প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত। আমি হলপ করে বলতে পারি পাকিস্তানের বেলায় আমরা সাপোর্ট বা ঘৃণা দুই ব্যাপারেই অযৌক্তিক। আমি একবারও পাকি ক্রিকেট বা ক্রিকেটারদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে কথা বলছি না। তাদের ভেতর যারা আমাদের এখনো ঘৃণা করে কিংবা বাংলাদেশ বিষয়ে বৈরিতা পোষণ করে তাদের আমি দু চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু একদিকে শাহিদ আফ্রিদির জন্য গালে 'ম্যারি মি' লিখে মাঠে যাওয়া যেমন জঘন্য, তেমনি তাদের দেখলেই রক্তে ঘৃণা জেগে ওঠাও হিংসার পরিচয় বহন করে। এ দুটোর কোনটাতে আমাদের লাভ নেই। বরং আমাদের জাতীয় চরিত্রের জন্য সত্যি এটা ভয়াবহ।

অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, এই যে পেঁয়াজ সংকটে ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলো এই সরকারও কি পাকিস্তান থেকে পিেয়াজ আনে নি? আর সে পেঁয়াজ কিনে বাড়িতে কষা গরুর গোশত বা ছাগলের মাংস খেয়ে তারচেয়ে কষে পাকিস্তানিদের গালাগাল করা কিন্তু আসলে হাস্যকর। ঠিক এমনই ভারত বিরোধিতা। আমি খেয়াল করেছি ভারত-বাংলাদেশ লড়াই মানেও এখন যুদ্ধ। টগবগ করে ফোটা সামাজিক মিডিয়া দেখলেই বোঝা যায় কী আমাদের মনোভাব। যতদিন বা যত সময় এই খেলা চলে বা মাঠে গড়ায় ততসময় ধরে কিছু মানুষের মাতম দেখে মনে হয় অমুসলিম প্রধান কোন জাতির সাথে যুদ্ধ করছি আমরা। আর আমরা অভিশাপ বা গালাগাল দিলেই খসে পড়বে একর পর এক উইকেট।

ভিরাট কোহলি আমার পছন্দের খেলোয়াড় নন। তার চেয়ে আমার পছন্দ রোহিত শর্মা। কিন্তু কোহলির জিভ থেকে ধোনির ক্রিজ আঁকড়ে থাকা সবই দেখি আক্রমণের শিকার। সাইকোলজি বা মনস্তত্ব কিন্তু বলে পরাজিতের আক্রোশ ভয়াবহ হয় শেষতক তাদের নিজেদের জন্য। খুব মনে আছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে অনেক আগে  আমার একটা নির্মোহ ক্রিকেট বিষয়ক লেখার পর কী পরিমাণ অপমান আর ঘৃণার শিকার হয়েছিলাম! অজস্র মানুষের সমর্থনের পর ও বেশ বড় সংখ্যক মানুষ আমাকে ভারতে চলে যাবার পরামর্শ দিতেও ভোলেননি। অথচ তারা জানে না খোদ ভারতীয়রা রাতের পর রাত জেগে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া আসার জন্য। মোদ্দা কথা হলো আমরা সববিষয়ে এমন এক হুজুগে জাতিতে পরিণত হয়েছি যার সর্বাঙ্গে এখন উত্তেজনা আর আক্রমনের বিষ।

খেলোয়াড়রা কি এর শিকার? না তার সাথে আছে আরো কিছু বিষয় যা এখন আমরা প্রকাশ্য হতে দেখছি। এটা নিশ্চিত যে ক্রিকেট বোর্ডের সাথে নামী খেলোয়াড়দের সম্পর্ক নাজুক। শুধু নাজুক বলা ঠিক না, বেশ ভঙ্গুরও। দেশের সবচেয়ে নামী ক্রিকেটার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেরা সাকিবের সাথে মাঝে মাঝেই দ্বন্দ্ব আর সংঘাত দেখি। সাকিব যে সব বিষয়ে সঠিক তা নয়। তবে সব বিষয়ে দোষী এমনও মানা কঠিন। জনাব পাপন যেমন নামে ভারী তেমনি নিন্দিতও বটে। এই যে তিনি কলকাতা টেস্ট নিয়ে বললেন- 'সিদ্বান্ত ছিলো টসে জিতলে বোলিং নেয়ার', এটা যদি সত্যি হয়, অধিনায়ক কার নির্দেশে বা কেন তবে ব্যাটিং বেছে নিলেন? এর জবাব তিনি দেবেন না। জবাবদিহিতা না দেয়ার সংস্কৃতি  এখন দেশব্যাপী চলমান। এবার গিয়ে আমি প্রচুর মানুষের সাথে কথা বলে বুঝেছি তারা জেনে গেছেন এ সমাজে কেউ কারো কাছে দায়ী না। কারো কোন স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতার  দরকার নাই। তাহলে কি কারণে ক্রিকেটারদের কাছে তা আশা করবো আমরা?

বড় কথা হলো, ক্রিকেট যে একসময় জুয়ায় পরিণত হবে সেটা অনেক ভারতীয় ঋষি বলে গিয়েছিলেন। ভারতে তাদের ক্রিকেটাররা দেবতারও বেশিকিছু। অনেকে জানেন ভারতের অলিম্পিকে মেডেল পাওয়া খেলোয়াড় বিমান বন্দর থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। এর বিপরীতে ক্রিকেটার মানেই 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'। আমাদের দেশেও তাই। যে কোন ক্রিকেট খেলোয়াড়ের আয় উপার্জন সাধারণ মানুষের জন্য ঈর্ষার। তারা যা স্বপ্নেও ভাবেন না সেটাই ক্রিকেটাররা পেয়ে যায় অনায়াসে। এক্ষেত্রে তারা হারলো না জিতলো তা নিয়ে মাথাব্যথা নাই। এই কদিন আগেই তারা নেমেছিল আন্দোলনে। কেন? মাসোহারা বাড়াতে হবে বলে। পৃথিবীতে কি এমন কোন চাকরি বা কাজ আছে যেখানে কাজের মূল্যায়ন ছাড়া বেতন বাড়ে কিংবা অঢেল টাকা পাওয়া যায়? আমাদের ক্রিকেটে পাওয়া যায় বলেই হয়তো খেলোয়াড়রা সেই কৌতুকের মত সিগারেটের আগুন না নিভিয়ে প্যাভিলিয়ন থেকে মাঠে আসেন যাতে ফিরে গিয়ে আবার তা ধরাতে না হয়।

কলকাতা টেস্টে শোচনীয় পরাজয়ের পর আমরা কি কিছু শিখবো? ধারণা করি, এরপর আমাদের উত্তেজনা আর জোশ স্তিমিত হবে। কথায় কথায় ভারত পাকিস্তান বা টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে নিয়ে অকারণ জোশ আর উল্লাসে ফেটে পড়বো না আমরা। দূর করবো সাম্প্রদায়িকতা জাতিগত বিদ্বেষ আর রাজনৈতিক অনৈক্য। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও চেতনাকে যেন patriotism is the last refuge of the scoundrel এ পরিণত না করি আমরা।

ক্রিকেট আমাদের জাতীয় পরিচয়, আমাদের গর্ব। আমাদের ঝুলিতে অর্জন কম নয়। কম না আগামীর সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক পরিচয়সূত্র আর দেশপ্রেমের হাতিয়ার ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের সঠিক ভূমিকাসহ ঝলসে ওঠাই একমাত্র উত্তরণ । নয়তো বাকী সব অরণ্যে রোদন মাত্র । আপাতত এটা প্রমানিত গোলাপি বল বা গোলাপি ক্রিকেটের 'বদ আছরে' মুখ থুবড়ে পড়েছি আমরা। ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প নাই এখন।