প্রযুক্তির ব্যবহার ও তারুণ্যের উদ্ভ্রান্ত মস্তিষ্ক

ঊর্মি খান
Published : 4 March 2012, 02:06 PM
Updated : 4 March 2012, 02:06 PM

ভাবতে ভাল লাগে পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ! তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে পিছিয়ে নেই আমরাও । উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার যে হারে বাড়ছে তা সত্যিই বিস্ময়কর ! বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে আমাদের দেশের তুলনা করলে এটাই প্রতিয়মান হয় । অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক দূর অগ্রসর হবে এই স্বপ্নে যখন আমরা বিভোর তখন মাঝে মাঝেই বিজ্ঞানের কোন কোন ক্ষেত্রের অপব্যবহার আমাদেরকে যে পীড়া দেয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন । তবে ইন্টানেটের চেয়ে মোবাইল ফোন পৌঁছে গিয়েছে প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের কাছে ।দেশে এখন বর্তমানে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ মোবাইল ফোন গ্রাহক (গড় হিসাব)।

খুব ছোট বেলায় আমাদের বাসায় একটা রেডিও দেখেছিলাম । রেডিওতে গান-নাটকসহ নানা ধরণের অনুষ্ঠানগুলো শুনতাম আর বিস্ময়ে হতবাক হতাম । তারপর একদিন দেখলাম বাসায় একটা সাদা-কালো টেলিভিশন কেনা হল । আমাদের আনন্দ দেখে কে ! এবার শুধু শোনা নয় দেখাও যাবে, সে এক বিশাল ব্যাপার । বুঝে বা না বুঝে প্রতিটি অনুষ্ঠান দেখার সেই আনন্দ আজকের তুলনায় হয়ত কিছুই না । কিন্তু সেই সময়ের সেই আনন্দটা অনেক গাঢ় ছিল । এরপর আরেকদিন হঠাৎ করেই (৪র্থ শ্রেণীতে পড়তাম, ১৯৯৪ সালের কথা ) আব্বু ঘড়ির দোকানে নিয়ে গিয়ে একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন । তখনতো রীতিমত নিজের ভাবটাই বেড়ে গেল । আমাদের কাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তখন হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে ঘড়ি ছিল । আমার হাতের ঘড়িটা কেউ কেউ যখন বিস্ময় নিয়ে তাকাতো, তখন অহংকারে মাটিতে যেন পা পড়ত না । সেটা মনে পড়লে এখন প্রচন্ড হাসি পায় । এটাতো গেল আমাদের ছোট বেলার কথা । বড়দের কাছে শুনেছি-তাদের ছোট বেলায় নাকি রেডিও, টিভি, ঘড়ি, সাইকেল সারা গ্রামে খুঁজে একটার বেশি দুটো পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ । আজকের যুগের দিকে তাকালে ওসব নিছকই হাস্যকর মনে হয় । মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার । এইতো, চার-পাঁচ বছর আগেও একটা সিম কার্ড আর মোবাইল ফোন মানুষের কাছে দুঃসাধ্য ছিল । আর এখন কারো কাছে অগুনিত সিমকার্ড না থাকাটাই বিস্ময়কর ব্যাপার । আর মোবাইল ফোন গড়ে একটা করে থাকলেও এক শ্রেণীর মানুষের কাছে দুটি-তিনটি অথবা তার অধিক থাকাটাও অসম্ভব কিছুনা । সত্যিই ভাবতে ভাল লাগে- আজ আমরা ধীরে ধীরে এমন যুগের দিকে যাচ্ছি, যে যুগে দুর্লভ বস্তুগুলো আমাদের কাছে ক্রমেই সহজলভ্য হয়ে উঠছে ।

মোবাইলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে । ধনী-গরীব সবাই খুব সহজেই অতি অল্প খরচে-অল্প সময়ে যোগাযোগ করতে পারছে । এক কথায় 'দূরের' সবকিছু হয়েছে অতি নিকটতম আর সহজতর । এটা সত্যিই আমাদের এগিয়ে যাওয়া । কিন্তু ভালোর পাশাপাশি মন্দ থাকবেই…এটা চিরন্তন সত্য । আর সে কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন কিছু কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে যা সচরাচর ঘটে চলেছে এই মুঠোফোনের মাধ্যমেই । একটা সময় ছিল যখন, আত্মিয়ের সাথে আত্মিয়ের বন্ধনটা অনেক দৃঢ় ছিল । অনেকদিন পরে পরে যাওয়া-আসা করলেও বন্ধনটা ছিল অনেক মজবুত । ভাবতে খুব কষ্ট হয়, আজকের যুগে অতি অল্প সময়ে যোগাযোগ করা যায় বলে-

বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে এই ফোনের মাধ্যমে । যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আত্মিয়তার বন্ধন । হারিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি ! কেউ কেউ হয়ত বলবেন- এখন সবাই অনেক বেশি ব্যস্ত । কারো বাড়িতে যাওয়ার চেয়ে ফোনে অল্প সময়ে দাওয়াত কিংবা খোঁজ নেয়াটা অনেক বেশি সহজ । কিন্তু আমি বলব- এভাবে চলতে থাকলে নিজের আপন দাদা-দাদি, নানা-নানি কে নাতি-নাতনিরা একসময় চিনবেইনা আর চাচা-মামা-খালা-ফুপুদের সাথেও পরিচয় ঘটবেনা কোনদিন । কিছুটা দূরের আত্মিয়ের ক্ষেত্রেতো প্রশ্নই উঠেনা । এটাতো গেল আত্মিয় প্রসংগ । এখন এমনও দেখা যায় যে, আমরা আমাদের পাশের বাড়ির প্রতিবেশি অসুস্থ হলেও জানতে পারিনা বা জানার চেষ্টা করিনা । এপার্র্টমেন্টের কোন ফ্লোরে কেউ মারা গেলে অন্য ফ্লোরের মানুষ জানতেই পারেনা…। সবাই নিজের মতো করে একা থাকতেই পছন্দ করে । হয়ত তারা মনে করে, যে সময়টুকু প্রতিবেশির বাড়িতে কাটাবে সে সময়টা টেলিভিশন দেখে কাটানো অনেক বেশি শ্রেয় । তাছাড়া কোন বিশেষ সিরিয়াল মিস হয়ে যেতে পারে এটাও অনেক বড় একটা চিন্তার ব্যপার ।বাচ্চাকে বিদ্যালয় থেকে আনতে গিয়ে অনেক মায়েরাই একত্রিত হন । অধিকাংশ সময় দেখা যায় তাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে হিন্দি সিরিয়ালে কার সাথে কার বিয়ে হবে , কার ডিভোর্স হবে…ইত্যাদি । এভাবে যদি চলতে থাকে তবে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটা একসময় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? শিশুদের মাঝে কিভাবে গড়ে উঠবে সম্পৃতি , মমত্ববোধ , সাজাত্ব্যবোধ আর ভালবাসা? কারণ তারা তো আমাদের দেখেই শিখবে…।শিশুরা খেলার মাঠ না পেয়ে কম্পিটারে ফুটবল-ক্রিকেট খেলে স্থুল স্বাস্থ্যের অধিকারী হচ্ছে । রোগ পতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে । কমে যাচ্ছে মানসিক বিকাশ ।

মোবাইলে আজকাল মানুষের মধ্যে খুব সহজেই গড়ে উঠছে বন্ধত্ব । বিশেষ করে কোন ছেলে কোন মেয়ের নাম্বার পেলেতো কথাই নেই…মিস্ড কল, কল, এস এম এস…তারপর একসময় গড়ে উঠে বন্ধুত্ব এবং পরিশেষে সেটা গড়ায় প্রেমের দিকে। প্রেম খুব স্বাভাবিক আর চিরন্তন বিষয় । এটাতে দোষের কিছু নেই । কিন্তু এই ধরণের প্রেম জঘন্য পর্যায়ে গড়ায় । জঘন্য বললাম কারন বর্তমানে ছেলে-মেয়ের মধ্যে মোবাইলে এমন সব উদ্ভট উত্তেজক বাক্যালাপ হয় যাকে এক কথায় 'মোবাইল সেক্স' নামে অবিহিত করা যায় । সরাসরি (অবৈধ ভাবে) শারিরীক সম্পর্কের চেয়ে এটা অনেক বেশি ভয়ংকর আর জঘন্য ! এতে মানুষ ধীরে ধীরে শারিরীক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে । বাড়ছে মানসিক সমস্যা । আবার কোন মেয়ে যদি ফোন রিসিভ করে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে না চায় তবে তাকে বাজে কথা শুনতে হয় কিংবা দেয়া হয় বাজে এস এম এস । তখন বাধ্য হয়ে নাম্বার বদলানো ছাড়া উপায় থাকে না ।তবে ইদানিং কিছু মেয়েরাও কোন কোন ভদ্র গোছের ছেলেদের সাথে এরকম উদ্ভট আচরণ করছে ।

এবার আসা যাক ইন্টারনেটের দিকে । ইন্টারনেট…যার মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন স্থান থেকে শুধু যোগাযোগ নয় সরাসরি দেখাও যায় উয়েব ক্যাম এর মাধ্যমে। এটা সত্যিই একটা ম্যাজিকের মত ব্যাপার । কিন্তু এটার মাধ্যমেও ঘটছে আরো ভয়াবহ ব্যাপার ! মোবাইলে শুধু শোনা যায় আর এটা দিয়ে সরাসরি নগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয় । এক জরিপে দেখা যায়, স্কুল- কলেজ পড়য়া ছেলে-মেয়েরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে । আর ব্লু মুভি-ম্যাগাজিন তো রয়েছেই ।

আমরা আসলে পারত পক্ষে এগিয়ে যাচ্ছিনা । বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে ক্ষয় হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কেরও…! ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে আমাদের মানসিকতা , সুন্দর সংস্কৃতি আর সৃষ্টিশীল মন এবং কাজের প্রেরণা । আমরা মূলত বৃহত জগতের চেয়ে ক্ষুদ্র জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি । চারিদিকে বাড়ছে অস্থিরতা । ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে পরিবারের দূরদর্শিতার অভাবে । মান-অভিমান থেকে বাড়ছে অত্মহত্যার প্রবণতা । এটাই কি তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা? নতুন পৃথিবীতে আর একজন নতুন রবীন্দ্রনাথ কি জন্মাবে না? নাকি আমরা মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের মস্তিষ্কের ভেতর আমাদের মস্তিষ্ক আবদ্ধ করে রাখব আর জন্ম দেব অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম…?