ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা । মাত্র পনের জন সদস্য দিয়ে প্রথমে যাত্রা শুরু , ক্রমে ক্রমে তিনি গড়ে তোলেন এক বিস্ময় জাগানিয়া গেরিলা দল –নাম 'দাস পার্টি'। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ-এর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাকি সেনা আর রাজাকারদের কাছে এই 'দাস পার্টি' ছিল এক ভয়াবহ আতংকের নাম। ভাটি এলাকায় মানুষের মুখে মুখে ফেরে তাঁর বীরত্বকাব্য, দুর্ধর্ষ সেই সব কাহিনী । হাওরের বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়ায় , তিনি অর্জুন পুত্র অভিমন্যু'র চেয়েও বড়ো যোদ্ধা , তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী – যিনি অসীম সাহস , বুদ্ধিমত্তা আর অবিশ্বাস্য ক্ষীপ্রতায় শত্রু ব্যূহ ভেদ করে ভয়াবহ সব অপারেশন করে ফেলেন অবলীলায়। শত্রুর গান বোট , কার্গো কনভয় আর ব্রীজ উড়িয়ে দেন যখন তখন। জলপথে 'দাস পার্টি'র প্রচন্ডতায় ,এক সময় পাকি সেনারা অভিযান স্থগিত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ।
তার পর আসে একদিন , ১৯৭১ এর ১৬ নভেম্বর ইংরেজী সন। সীমিত গোলাবারুদ নিয়ে পাকিবাহিনীর সাথে অবতীর্ণ হন এক অসম যুদ্ধে , পাকিবাহিনীর সাথে তখন বিপুল গোলাবারুদ। পরিস্হিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে একপর্যায়ে দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন , আর একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে একাই এগিয়ে যান, সাথে শুধু সহযোদ্ধা ইলিয়াস। হঠাৎ ইলিয়াস গুলিবিদ্ধ হয় , মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে এবং পিঠে বেঁধে দিয়েই সুতীব্র আক্রোশে ফেটে পড়েন । একাই খতম করে দেন ১২ জন পাকিসেনাকে । এক পর্যায়ে ম্যাগজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতে করতেই মুহুর্তে একটি গুলি তাঁর চোখ বিদ্ধ করে দেয় । মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে বিলের পানিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়েন , 'দাস পার্টি'র কমাণ্ডার।
"তাদের ঘিরে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ
কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে
কেউ এসেছে পাটকলে ছুটির বাঁশি আগে বাজিয়ে
কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে
কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে
কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি
যুবক এনেছে তার যুবতীকে
বৃদ্ধ ধরে আছে বৃদ্ধতরর কাঁধ
সবাই এসেছে একজন কবির
হত্যাদৃশ্য
প্রত্যক্ষ করতে।
খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো কবিকে" / লোরকা স্মরণে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সেদিনটি ছিল রমজানের ঈদের বাজার। আজমিরীগঞ্জ বাজার লোকে লোকারন্য। বিল থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে আসা হয় বাজারে, বেঁধে ফেলা হয় একটি ইলেকট্রিকের খুঁটির সাথে। ইতোমধ্যে সে যে বেঁচে নেই সেটা নিশ্চিত জানা যায় , তবু তাঁর নিষ্প্রাণ দেহের উপর চলে আক্রোশ আক্রমণ। পাকি দোসররা অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে মৃত শরীর। একসময় বিবস্ত্র করে ফেলা হয় তাঁকে। তিন দিন বাজারে পড়ে থাকে এক প্রানহীণ নিথর দেহ ,তারপর রাজাকার'রা সেই বীভৎসতার চিত্র ধারন করে ক্যামেরায় । মৃত্যুর ৭২ ঘন্টা পরেও সেই শরীর কোন গন্ধ ছড়ায় না । এর পর সেই লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেড়া মোহিনী নদীর জলে। ভাসতে ভাসতে কোথায় হারিয়ে যায় , সে খবর আর বলতে পারে না লোকে।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে জগৎজ্যোতি দাস-এর শহীদ হবার সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক "বীর শ্রেষ্ঠ" প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয় , এবং সেটি ছিল সর্বোচ্চ খেতাব দেয়ার প্রথম ঘোষণা , অজ্ঞাত কারণে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সড়ে আসে সরকার। ১৯৭২ সালে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয় তাঁকে। এই পুরস্কারও বাস্তবে প্রদান করা হয় আরো দু'যুগ পর।
তবে কী জগৎজ্যোতিও বেসামরিক যোদ্ধা হওয়ার কারণেই শ্রেষ্ঠ বীরের খেতাব পাননি ? মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য যে সাত জনকে সর্বোচ্চ সম্মাননা 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাব দেওয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই আছে সামরিক পরিচয় , যার ৫ জন সামরিক বাহিনীর এবং ২ জন আধা সামরিক বাহিনীর।
ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয় পয়াতাল্লিশ বৎসর সময় কাল । ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ইং দিবাগত রাত ২টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের সাব কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদী।
"আমি নিজে অন্তত তিনজনকে জানি যাদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া উচিত ছিলো , এদের একজন অবশ্যই জগৎজ্যোতি। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসী বীরত্ব প্রদর্শন করেও যারা যথাযথ মূল্যায়ন ও খেতাব পাননি তাদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমি খেতাব ('বীর প্রতীক') ও সম্মান বর্জন করেছি"- মাহবুবুর রব সাদী ।