’ফিদেল ক্যাস্ট্রো’- পৃথিবী নামক গ্রহের সর্বশেষ সাহসী মানুষ

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 27 Nov 2016, 04:37 AM
Updated : 27 Nov 2016, 04:37 AM

আজ থেকে সাতাশ বছর আগে , আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো কে ? তখন আমার ছিল ,

"আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি"

তখন আমার ছিল, জানার সবে শুরু ! সাতাশ বছর আগে , আমি পড়েছিলাম –  ফিদেল ক্যাস্ট্রো'র পিতা  ছিলেন চিনি বাগানের একজন শ্রমিক এবং পরবর্তীতে তাঁর পিতা কিছু জমি সম্পত্তি কিনে ভূস্বামীও হয়েছিলেন বটে!

কিন্তু ফিদেল ক্যাস্ট্রো  বললেন, না এভাবে বলা যাবে না,

"It doesn't sound too good to say I am the son of a landowner, so let us rather say I am the grandson of exploited  Galician (Spanish) peasants. "আমি একজন ভূমি-মালিকের সন্তান এটা খুব খারাপ শোনায়, বরং বলো আমার দাদু ছিলেন একজন অবহেলিত স্প্যানীয় কৃষক।

"আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা"  

সুকান্ত ভট্টাচার্য।

আমার জবাবে ঔদ্ধত্য ছিল । বলেছিলাম আমার ভগবান -ব্রহ্মা ,বিষ্ণু, মহেশ্বর কিংবা কেষ্ট ঠাকুর নয় । 'ফিদেল ক্যাস্ট্রো' -আমার ভগবান । আমার মনে আছে , জ্যাঠামশাই আপনি খুব হতাশ হয়েছিলেন সেদিন , বলেছিলেন যা পড়ছো  যা জানছো তা ভুল , নিশ্চিত কেউ তোমার মাথা বিগরে দিচ্ছে ! একদা আমায় যে বিগরে দিয়েছিল , আজ সকালে আমার সেই বন্ধুটি 'শওকত জামান সিপু' আমায়  টেক্সট পাঠিয়েছে -হায়! ফিদেল ক্যাস্ট্রো  আর নাইরে!

কিউবার ভাষা ,সংস্কৃতি , আবহাওয়া  কিংবা কেমন তার জলবায়ু , আমি জানি না । আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন- 'ফিদেল ক্যাস্ট্রো' এইটা  কী খায় না পিন্দে ?  আমি  যদি বলি , একদা স্বপনে , ছাত্র জীবনে , দুরন্ত  যৌবনে , উন্মাতাল সময়ে , বুঝে না বুঝে , দিন রাত আমি  ক্যাস্ট্রো পিন্দিয়া থাকিতাম । অল্প একটু ভেঙ্গে গেলে , সবটা যদিও তার আস্ত থাকে, তুবুও তা লাগে না  কাজে ,  আবার ফিনিক্স পাখির ধ্বংসাবশেষ থেকেও পুনরুত্থান হয় মাঝে মাঝে । আপনি বুঝবেন না , বরং আপনি প্রশ্ন করতে উৎসাহিত হবেন- এককালে রাশিয়ায় বৃষ্টি হলে তোরা ছাতা ধরতিস , এই ব্যারাম কী এখনও তোদের আছে ?

হে হে হে ! আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না  , যেমন জানিনা আপনি যখন জানতে চান-  ভোটে খাড়াইলে তো ১০০ ভোটও পাবি না , তাইলে কেমনে কী ? তথাপি আপনাকে আমি একবারও জিজ্ঞেস করতে চাইবো না- রোহিঙ্গা মরলে আপনি নীরব কিংবা সরব থাকেন কেন? নাসিরনগর সাঁওতাল পল্লী , আপনি উচ্ছ্বসিত কিংবা উৎকণ্ঠিত হন কেন? আপনি যদি হিন্দু হন , তাহলে মাংস রাখার অপরাধে কেন একজন  মুসলিম কে হত্যা করেন ? আপনি বৌদ্ধ'র উপর চরম আজ, অথচ নরম ছিলেন গতকালেও ? দিন শেষে আপনি , হিন্দু ,খৃষ্টান, শিয়া ,সুন্নী , বৌদ্ধ হয়ে যান -আপনি কী মানুষ ছিলেন কোন কালেও?

স্যরি ,আমি জানতে চাইবো না কোনদিন। মানুষকে -জাত , ধর্ম , সাদা , কালো -এই বিচারে জানতে না চাওয়ার এই শিক্ষাটি, আমি সাম্যবাদ থেকে পেয়েছি । আমি পচে যদি গন্ধ ছড়াই, আমি নষ্ট ভ্রষ্ট , দগদগে  দাউদ কিংবা একজিমাও হয়ে যাই -তবুও জেনে রাখেন – রাম আর রহিম , এই দুইজনই আমার অতি আপনজন।

  • সেটা ছিল স্পেন গৃহযুদ্ধের কাহিনী , যার নায়ক একজন ডিনামাইটার , মার্কিন তরুণ , নাম ছিল রবার্ট জর্ডান। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে  লিখেছিলেন "For Whom the Bell Tolls"-এটা ছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রো'র প্রিয় বই।
  • ১৯৬০ সালে জাতিসংঘে টানা সাড়ে চার ঘণ্টা বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি , সেই রেকর্ড এখনও অক্ষত । আর কিউবায় একবার তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন সাত ঘণ্টা ।
  • অথচ তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন আমেরিকানদের আগ্রাসন নিয়ে লেখালেখি মাধ্যমে । কিন্তু পরে শুধু বলেই গেছেন,  লেখালেখি আর করা হয়ে উঠেনি তাঁর ।
  • বিপ্লবকালীণ সময়ে শ্মশ্রুমণ্ডিত হয়ে তিনি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন । বলেছেন- প্রতিদিন পনের মিনিট তুমি যদি শেভ করতেই নষ্ট করে ফেলো , তবে এক বছরে পাঁচহাজার মিনিট তুমি হারিয়ে ফেললে ,বরং এই সময়টুকু দেশের জন্য ব্যয় করো।
  • প্রায় ৬৩৪ বারের চেষ্টা বিফলে গেছে । সিআইএ বছরের পর বছর পয়জন পিল নিয়ে ঘুরেছে তার পেছন পেছন,  ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫  আট বার । টক্সিন ভরা সিগার গোপনে পাঠানো , ডাইভিং স্যুটে কেমিক্যাল মিশিয়ে রাখা, কলমে  হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ লুকিয়ে রাখা – নানা রকম ফন্দী ফিকির – উদ্দেশ্য একটাই টু কিল হিম।
  • হাসতে হাসতে বলেছিলেন মৃত্যু থেকে ফিরে আসার একটি ইভেন্ট অলিম্পিকে থাকলে নিশ্চিত সোনা পেতাম আমি ।
  • একসময় শিক্ষায় বিশ্বে প্রথম ছিল , কিউবায় শিক্ষার বর্তমান  হার ৯৯.৮%  এবং ছাত্র শিক্ষক অনুপাতও যথেষ্ট সমৃদ্ধ , ক্যাস্ট্রো  বলেছেন , আমেরিকা যুদ্ধবাজী করতে করতেই দিন শেষ , শিক্ষা নিয়ে সে ভাববে কখন !
  • ২০১৬ মার্চে ওবামা সফরে গিয়েছিলেন কিউবা , প্রায় ৮৮ বছর পর । ফিদেল ক্যাস্ট্রো'র সাথে দেখা হয় নি। কৌতুক করে ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন ,ওবামার মুখে মধু নিসৃত বাণী শুনে , তাঁর নাকি প্রায় হার্ট ফেল হয়ে যায়।
  • বলেছেন- আমরা কারো করুণা প্রার্থী হতে না চাই, সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকার  হাত থেকে কোন উপহার  চাই না আমাদের ।
  • ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ এলাকায় ক্রমাগত হামলার হুমকি  দিয়ে যাচ্ছে  , ইসরাইল । আমেরিকা এই হামলার জন্য বোমা সরবরাহ করতে প্রস্তুত। শেষ জীবনেও ফিদেল ক্যাস্ট্রো  বলেছেন , ইরানে হামলা করা হলে -তা হবে আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল।

১৯৭৩ সাল ।  ফিদেল ক্যাস্ট্রো'র উপস্থিতিতে , অনেকেই 'নাম সম্মেলন' সভায় থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, কেননা কিউবা তখন ছিল ওয়ারশ জোটভুক্ত । ফিদেল ক্যাস্ট্রো সেদিন সেখানে প্রকাশ্যে বলেছিলেন -আমেরিকা হচ্ছে প্রধান নাটের  গুরু ,  ইসরাইলের সকল অপকর্মের মূল খলনায়ক । সম্পর্ক ছেদ করে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বুকে টেনে নিয়েছিলেন প্যালেস্টাইন কে ।

আপনি আমেরিকাকে  দিন রাত চব্বিশঘণ্টা গালাগালি করেন ,আবার চিকনে চাঞ্চে থাকেন , ইস্‌ ভিসাটা যদি লাইগ্যা যায় ! স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে আপনি পৌঁছে  যাবেন ডাইরেক্ট স্বর্গ রাজ্যে ! আপনি চিন্তাভাবনায় খুবই পরিষ্কার আসলে আপনি দিনের বেলা ডঃ জেকিল আর রাত হলেই মিঃ হাইড , হয়ে যান । আপনি হয়তো বা জানেন না কিংবা জানলেও আপনি নিজেকে অপ্রকাশিত রাখেন। কপাল খারাপ হলে , যা হয় আর কী ! মিস্টার রাশিয়া বেঁচে থাকলে পাড়ার এই উঠতি মাস্তান'কে চড়ায়ে বত্রিশ দাঁত ফেলে দিতো আজ ! কিন্তু একদা রাশিয়াকে আপনি ভালোবাসেননি । অবশ্য পুতিন আপনাদের অনেকের কাছেই এখন হিরু ।

আপনি আপনার রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন , একজন দুম করে এসে, আপনার দুই গালে কষিয়ে বসিয়ে দিল -চড় এবং চলেও গেল ! আপনি কান্না কাটি করতে গিয়েও করতে পারলেন না – কেননা চড়দাতার ইন্ধন দাতা, আদতে আপনার শহর বাসী কিংবা  দেশবাসী কোনটাই নয় , আপনি তা জানেন। ইন্ধন দাতা , অনেক দূরে তার বসবাস , সেখান থেকেই তিনি রংবাজি করেন।  এই গ্রহের তিনিই সর্বে সর্বা- মেসার্স ইউনাইটেড স্ট্যাটস অব আমেরিকা তার নাম। পর দিন বিচার বসলো , আপনাকে বলে দেয়া হলো -এই রাস্তায় আপনার হাঁটার আর কোন অধিকার নেই। আপনার শহর, আপনার দেশ প্যালেস্টাইন,  আপনার নয়- আপনি জেনে গেলেন। এভাবেই রংবাজের ইশারায় ,  নিজেরা নিজেরা ব্যাপক সমারোহে লেগে গেলেন । এমনি করেই মানচিত্র থেকে ইরাক , লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া এখন থেকে শুধু নামে থাকবে , যেহেতু তিনি বলে দিলেন , আপনি তা জেনে গেলেন এবং মেনেও গেলেন ।

চোর এবং গেরস্থ , এই দুই প্রজাতিরই – তিনি একমাত্র অভিভাবক , সমগ্র  বিশ্বে তার  মাতব্বরি  অনুমোদিত । অন্য দিকে দেখুন , নিকটতম বন্ধুটি  রাশিয়া হারিয়ে গেছে সেই কবে ! তবুও কিউবা নামীয় সাধারণ দেশটি-পরাক্রমশালী এক কংশ রাজা আমেরিকা যার নাম , তার নাকের ডগায় – হু কেয়ার্স ! ধুর ওরে গুনে ক্যাঠায় !  এই রকম ভাব নিয়ে , খেয়ে গেলো , করে গেলো – লাইক আ কিং । চেয়ে চেয়ে দেখে গেলেন আমেরিকা নামীয় প্রভু – এই ব্যাপারটি , ভেবে দেখেছেন কী কভু ?

আমি গর্বিত , এই 'হু কেয়ার্স'  ফিদেল ক্যাস্ট্রো -আমার ভগবান । ফেব্রুয়ারি ১০ , ২০১২ । হাভানা কনভেনশন সেন্টার । ২১টি দেশের বিখ্যাত লেখক , নোবেল বিজয়ী , সাংবাদিক, গবেষক উপস্থিত ছিলেন সেদিন । সেখানে নয় ঘণ্টা ব্যাপী চলেছে প্রশ্ন উত্তর পর্ব । ছিয়াশি বছর বয়সেও ফিদেল ক্যাস্ট্রো , বলেছেন , শুনেছেন , বিশ্বাস করুন কিংবা না করুন!

Nine hours of conversation, interrupted by two short breaks: that is easy to say, but those of us who have been following the leader of the Cuban Revolution know that those 540 minutes entail the intensity of several libraries and an emotional charge that would last for days and the people living through those minutes would never forget them.

 MORE THAN NINE HOURS DIALOGUING WITH INFINITE এর পিডিএফ কপি পড়ুন।

 

আপনি চাননি , কিন্তু  আপনার ধর্মভিত্তিক রাস্ট্রের নায়কেরা , ইতোমধ্যেই আমেরিকার গিনিপিগ হয়ে বসে আছেন সব । আপনি  সাম্যবাদে বিশ্বাস করেন না, অথচ একজন সাম্যবাদী  মানুষ আপনার অধিকারের  পক্ষে আমেরিকার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন । এই রকম স্বার্থহীন উচ্চারন আর কে করবে এখন?

পৃথিবী  নামক গ্রহের সর্বশেষ সাহসী মানুষ 'ফিদেল ক্যাস্ট্রো'  তোমায় লাল সেলাম।

 

সূত্র ও ছবিঃ ইন্টারনেট