পাকিস্তানে ‘শান্তি’ নয়, ‘বুদ্ধ’  ফিরে এলেন নয় বছর পর

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 1 Dec 2016, 06:04 PM
Updated : 1 Dec 2016, 06:04 PM

আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগের কথা । প্রাচীন গ্রিক ভাস্কররা অনুপ্রাণিত হলেন এবং স্বেচ্ছায় নিয়োজিত হলেন বুদ্ধমূর্তি নির্মাণে । এই ঘটনা পরবর্তীতে ভারতবর্ষে জন্ম দিল  'গান্ধার' নামে এক অভূতপূর্ব শিল্পরীতি । এটি ছিল মূলত ভারতীয় বুদ্ধ'র সাথে গ্রিক শিল্পরীতির এক মিশ্রণ । বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থান ছিল প্রাচীন গান্ধার রাজ্য। গান্ধারের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা – শিল্প শিক্ষা ও বাণিজ্যের এক সমৃদ্ধশালী শহর । সেই যুগে গান্ধার শিল্পরীতিতে নির্মিত অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি গুলো ইতিহাসের ছিল এক অনন্য অধ্যায়। সেই ঐতিহাসিক  বুদ্ধ কিংবা বুদ্ধ-স্তূপ , যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ,গোটা উপত্যকা জুড়ে ,  প্রকৃতির এক অনুপম সৌন্দর্য লীলা ভূমি ,  ভূস্বর্গ  'সোয়াত' উপত্যকা  যার নাম।

"A Daughter Is Born একটি কন্যার আবির্ভাব

আমার জন্মের পর গ্রামের লোকজন আমার মাকে সমবেদনা জানায় এবং কেউই বাবাকে অভিনন্দন জানায়নি। ভোরের শেষ নক্ষত্র ডুবে যাওয়ার পর আমার জন্ম। আমরা পশতুনরা একে শুভ লক্ষণ মনে করি। হাসপাতালে নেওয়া বা দাই রাখার মতো সামর্থ্য বাবার ছিল না, তাই আমাদের এক প্রতিবেশী সে সময় সাহায্য করেছিলেন। আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিল, কিন্তু আমি হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে, চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এসেছিলাম।

I was a girl in a land where rifles are fired in celebration of a son, while daughters are hidden away behind a curtain, their role in life simply to prepare food and give birth to children. আমি সেই দেশের মেয়ে যে দেশে ছেলেসন্তানের জন্ম উদযাপন করতে রাইফেল থেকে গুলি ছোড়া হতো, যেখানে মেয়েদের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হতো এবং জীবনে তাদের কর্তব্য কেবল খাবার তৈরি করা আর সন্তান জন্ম দেওয়া। "

"আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় থাকতাম। আমার উপত্যকা, সোয়াত উপত্যকা হলো পর্বতের স্বর্গরাজ্য, যেখানে আছে স্ফটিক-স্বচ্ছ হ্রদ এবং প্রবল গতিতে ছুটে চলা জলপ্রপাত। উপত্যকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে ফলকে লেখা, 'স্বর্গে স্বাগতম'। আগেকার দিনে সোয়াতকে বলা হতো 'উদ্যান'। আমাদের বুনোফুলে ভর্তি মাঠ আছে, রসাল ফলের বাগান আছে, পান্নার খনি আর টাকি মাছে ভর্তি নদী আছে। সোয়াতকে বলা হয় পুবের সুইজারল্যান্ড– পাকিস্তানের প্রথম স্কি রিজোর্টও আমাদেরই। পাকিস্তানের বড়লোকেরা ছুটিতে আমাদের বিশুদ্ধ বায়ু সেবন ও প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে আসে, উপভোগ করে নাচে-গানে ভরপুর সুফি উৎসব। আসত বিদেশিরাও এবং তারা যেখান থেকেই আসুক না কেন, আমরা তাদের বলতাম 'আংরেজান' বা ইংরেজ। এখানে ইংল্যান্ডের রানিও এসেছেন এবং সোয়াতের প্রথম ওয়ালির স্থাপিত 'হোয়াইট প্যালেস'-এ থেকেছেন, যেটি তাজমহলের মতোই একই ধরনের মর্মর পাথরে তৈরি।"

১৯৫৬ সাল , সোয়াত উপত্যকা , পাকিস্তান । গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত হলেন কতিপয় ইতালিয় প্রত্নতত্ত্ববিদ।

২০০১ সাল , বামিয়ান উপত্যকা , আফগানিস্তান । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮২০০ ফিট উচ্চতায় পর্বতগাত্রে খোদাই করা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল দুটি বৃহৎ আকারের বুদ্ধমূর্তি । বড় মূর্তিটির উচ্চতা ছিল ১৮০ ফুট আর ছোটটির উচ্চতা ছিল ১১৫ ফুট । প্রাচীন গান্ধার রাজত্বের প্রায় পনেরশ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক দুইটি বুদ্ধমূর্তি বোমা মেরে উড়িয়ে দিল  তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী । স্তম্ভিত হয়ে গেল বিশ্ববাসী।

২০০৭ সাল , সোয়াত উপত্যকা , পাকিস্তান । তালেবানদের উত্থান হল এখানে । গবেষণা কার্যক্রমে স্থগিত করে , ধীরে ধীরে দেশে ফিরতে উদ্যত হলেন , সকল ইতালিয় প্রত্নতত্ত্ববিদগণ । সোয়াত উপত্যকার 'জেহানবাদে' পাথরের গায়ে খোদাই হয়ে , ধ্যানমগ্ন ছিলেন বুদ্ধ । আকারে তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় পাথরে খোদাই করা বুদ্ধ , ২১ ফুট বাই ১২ ফুট । দফায় দফায় ভয়াবহ  ডিনামাইট চার্জ করলেন শান্তিকামীরা ।  ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ'র  ধ্যান ভাঙ্গল না , তবে  মুখাবয়ব ঝলসে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন বুদ্ধ । এবার কিন্তু স্তম্ভিত হল না বিশ্ববাসী , বরং আশ্বস্ত হল । কেননা মূর্তিটি সমূলে বিনাশ হয় নি , এটাই অনেক প্রাপ্তি ! সমগ্র উপত্যকা জুড়ে , বুদ্ধের মহান বাণী -ওং শান্তি ,ওং শান্তি, ওং শান্তি , প্রতিষ্ঠিত করলেন তালেবানগণ। পাকিস্তান সরকার কাজের মধ্যে কাজ করলেন একটাই,  আপাতত সমাধান হিসাবে , ২০০৮ সালে সোয়াত জাদুঘরটি বন্ধ করে দিলেন।

২০১২ সাল ,  সোয়াত উপত্যকা , পাকিস্তান । নতুন করে  আবারো গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত হলেন কতিপয় ইতালিয় প্রত্নতত্ত্ববিদ। তাদের দুই জন রিস্টোরার বা পুনরুদ্ধার-কারক , দুই জন থ্রি ডি স্ক্যান এক্সপার্ট , একজন প্রধান রিস্টোরার , পাঁচ জন স্থানীয় রিস্টোরার সাথে পঁচিশ জন অভিজ্ঞ সহযোগী । সকল আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলো  ইতালির ইউনিভার্সিটি অব পাডুয়া । এটি ছিল সম্পূর্ণ  ইতালিয় অর্থায়ন । "আর্কিওলজি কমিউনিটি ট্যুরিজিওম ফিল্ড স্কুল প্রজেক্ট" নামীয় একটি প্রকল্প , যা মূলত ছিল ডিরেক্টোরেট অব আর্কিওলজি মিউজিয়াম অব খাইবার পাখতুনখাওয়া ও ইটালিয়ান আর্কিওলজিক্যাল মিশন এর একটি যৌথ উদ্যোগ ।  টিম লিডার  অভিজ্ঞ  ডঃ লুকা মারিয়া অলিভিয়েরী।

"আমরা থাকতাম মিঙ্গোরায়, যেটা উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহর, সত্যিকার অর্থে একমাত্র শহর। এটা একটা ছোট জায়গা ছিল, কিন্তু আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোক এসে এখানে থাকা শুরু করলে জায়গাটা জনবহুল এবং নোংরা হয়ে যায়। আমাদের হোটেল, কলেজ, একটি গলফ কোর্স এবং একটি নামকরা বাজার ছিল, যেখানে ঐতিহ্যবাহী সূচিশিল্প, দামি পাথর ও প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে পাওয়া যেত। মারঘাজার জলপ্রপাতটা বাজারের ভেতর দিয়ে গেছে, ওর ভেতর ফেলা ময়লা আর প্লাস্টিক ব্যাগের কারণে পানিটা ঘোলাটে বাদামি হয়ে গেছে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো এটা অতটা স্বচ্ছ নয়, বৃহত্তর সোয়াত নদীর মতো পরিষ্কারও না। শহরের ঠিক বাইরে সোয়াত নদীতে মানুষ টাকি মাছ ধরত, যেখানে আমরা বেড়াতে যেতাম। আমাদের বাসা ছিল গুলকারা, যার অর্থ ফুলের স্থান, কিন্তু আগে একে বলা হতো বাটকরা বা বৌদ্ধমূর্তির জায়গা। আমাদের বাসার কাছে ছিল রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ ছড়ানো এক মাঠ-বসে থাকা সিংহের মূর্তি, ভাঙা খুঁটি, মস্তকবিহীন মূর্তি আর সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার-শত শত পাথরের ছাতা।"

"আমাদের উপত্যকায় ইসলাম এসেছিল একাদশ শতকে, যখন গজনির সুলতান মাহমুদ আফগানিস্তান থেকে এসে আমাদের শাসক হয়ে বসলেন। কিন্তু প্রাচীনকালে সোয়াত ছিল বৌদ্ধদের রাজ্য। বৌদ্ধরা দ্বিতীয় শতকে এখানে এসে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছিল। চীনা পর্যটকদের গল্পে ফুটে ওঠে, সোয়াত নদীর তীরে এক হাজার ৪০০টি মঠ ছিল এবং কীভাবে বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টার জাদুময়ী শব্দ উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত। মন্দিরগুলো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু তুমি সোয়াতের যেখানেই যাবে, সেখানেই বাসন্তীকুসুম এবং অন্যান্য বুনো ফুলের মাঝে তাদের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা পদ্মাসনে বসে থাকা হাস্যোজ্জ্বল ভগবান বুদ্ধের প্রস্তরমূর্তির আশপাশে প্রায়ই বনভোজনে যেতাম। প্রচলিত আছে, ভগবান বুদ্ধ নিজে এ শান্তিময় জায়গায় এসেছিলেন এবং এই উপত্যকায় একটি বিশালিকৃতি স্তূপার নিচে তাঁর ভস্মের কিছু অংশ পোঁতা আছে বলেও জনশ্রুতি আছে।" 

প্রত্নতত্ত্ব পুনরুদ্ধার কিংবা পুনর্গঠন কাজে  থ্রি ডি মডেল টেকনোলোজি ,বর্তমানে একটি প্রচলিত পদ্ধতি। থ্রি ডি মডেলিং মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে অসংখ্য টু ডি  ইমেজ থেকে পর্যায়ক্রমে একটি ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করা হয়। এই কাজে ব্যবহার করা হয়  ত্রিমাত্রিক ল্যাজার স্ক্যানার যার , যার প্রধান কাজ -একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে ত্রিমাত্রিক বস্তুটির দূরত্ব সমূহ বিবেচনা করে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে অসংখ্য রিফ্লেকশন তৈরি করে দেওয়া । পরবর্তীতে ত্রিমাত্রিক স্ক্যান সমূহ কম্পিউটারে খুব সহজেই একটি ত্রিমাত্রিক মডেল করে ফেলতে সক্ষম হয়। প্রত্নতত্ত্ব' টির পূর্বাবস্থা সমূহের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য উপাত্ত এবং ইমেজ দ্বারা নির্মিত আদি রূপ টির সাথে তুলনা মূলক বিচারেই  নির্মিত হয় সম্ভাব্য মডেল । প্রত্নতত্ত্ববিদ'রা অসংখ্য ট্রায়াল এন্ড এরর প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রত্নতত্ত্বটির পুনরুদ্ধার কার্যে নিয়োজিত হন।

ইতালীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা ত্রিমাত্রিক টেকনোলজি পদ্ধতি ব্যবহার করে  রিস্টোরিং -এর কাজ করলেন চার বছর , অবশেষে জেহানবাদ বুদ্ধমূর্তি'র মুখাবয়বটি পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হলেন তারা । নভেম্বর ০৭ , ২০১৬ সাল ।

"এটা ছিল আমাদের পেশাগত এবং নৈতিক দায়িত্ব -সোয়াতের মানুষদের কাছে তার ঐতিহ্যটি ফিরিয়ে দেয়া , সেই টানেই কাজটি করেছি আমরা" – টিম লিডার ডঃ লুকা মারিয়া অলিভিয়েরী ।

"পাথরে খোদাই করা এই বুদ্ধমূর্তি টি -একটি নিবিড় স্থাপত্য , যার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস । বুদ্ধ'র পদতলে দাঁড়িয়ে সোয়াতকে উপভোগ করা সত্যিই এক অনন্য অনুভব"-ইউরি জর্নহো ,একজন  রাশান পর্যটক।

"বাটকরার ধ্বংসাবশেষ ছিল লুকোচুরি খেলার এক জাদুকরি স্থান। একসময় কতিপয় বিদেশি প্রত্নতাত্ত্বিক এখানে কাজ করতে এসে বলেছিলেন, অতীতে এটি ছিল বৌদ্ধ রাজাদের কবর এবং স্বর্ণের গম্বুজসংবলিত বুদ্ধমূর্তিতে উদ্ভাসিত এক তীর্থস্থান। আমার বাবা 'বাটকরার পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন' নামে একটি কবিতা লিখেছেন, যেখানে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল মসজিদ ও মন্দির কীভাবে পাশাপাশি অবস্থান করতে পারেঃ মিনারে যখন সত্যের ভাষণ জাগে/ বুদ্ধ তখন হাসেন /এবং ছেদ পড়া ইতিহাস জোড়া লাগে।
When the voice of truth rises from the minarets, /The Buddha smiles,/ And the broken chain of history reconnects."

উদ্ধৃতি সমূহ  I am Malala আমি মালালা বলছি  বই থেকে নেয়া।

লিখেছেন- মালালা ইউসুফজাই, ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব / অনূবাদঃ  রোজা শাওয়াল রিজওয়ান

কৃতজ্ঞতাঃ  অনসূয়া বড়ুয়া

ছবি ও তথ্যঃ  ডন , ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, উইকিপিডিয়া।