ঈশ্বরপুত্র যিশু, পাপীদের পরিত্রাণে পুনরুত্থান

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 23 Dec 2016, 05:53 PM
Updated : 23 Dec 2016, 05:53 PM

THE FIRST SIN  প্রথম পাপ

অ্যাডাম এবং ইভ খুব শান্তিতে ইডেনের বাগানে বাস করছিলেন। ঈশ্বর যা বলতেন তারা সেটাই করতেন, খারাপ কিছু তারা জানতেন না। ঈশ্বর অ্যাডাম  এবং  ইভকে বললেন, কেবল একটি গাছের ফল ছাড়া, তোমরা এই বাগানের সকল গাছের ফল খেতে পার, কিন্তু এই গাছের ফল যদি খাও তবে তোমরা মারা যাবে।  সাপ এসে ইভকে বলল, তোমরা মরবে না , ঈশ্বর জানেন  যেদিন তোমরা এই ফল খাবে সেদিন তোমরা জ্ঞানী হবে এবং ভাল মন্দ জানতে পারবে।  ঈশ্বরের আদেশকে অবহেলা করে সেই ফল পেড়ে খেয়ে ফেললেন ইভ । পরে স্বামী অ্যাডামকে দিলেন এবং অ্যাডামও খেলেন । সেইদিন সন্ধ্যায় অ্যাডাম-ইভ যখন ঈশ্বরের গলার আওয়াজ শুনলেন তখন তারা আগের মত তার কাছে আসলেন না। তারা ভয়ে ভয়ে লুকাতে চেষ্টা করলেন। তাদের অবাধ্যতার কারণে ঈশ্বর ইভকে বললেন , তুমি ব্যথায় কাতরাবে এবং কষ্ট পাবে, তোমার স্বামী তোমার উপরে খবরদারি করবে। অ্যাডামকে তিনি বললেন, যেহেতু তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে অবাধ্য হয়েছ, সেহেতু তুমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করবে, কাঁটা ও আগাছার মধ্যে পরিশ্রম করবে। অ্যাডাম-ইভ তাদের সুন্দর বাগানে থাকতে পারলেন না । ঈশ্বর তাদের বের করে দিলেন এবং বাগানে ঢোকার পথে স্বর্গদূতদের পাহারায় রাখলেন এবং ঝুলিয়ে রাখলেন জ্বলন্ত তলোয়ার। (Old testament  GENESIS 3 , আদিপুস্তক ৩)

'যিশু' ইংরেজিতে Jesus , সময় কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪ অব্দ থেকে আনুমানিক ৩০ খ্রিস্টাব্দ, যাকে "যিশু খ্রিস্ট" নামে অভিহিত করা হয়েছে ।  মূলত ছিলেন ইহুদি ধর্মপ্রচারক, পরবর্তীতে যিনি খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। খ্রিস্টানগণ বিশ্বাস করেন, তিনি হলেন ঈশ্বরপুত্র  এবং  তিনিই সে খ্রিস্ট অভিষিক্ত ব্যক্তি 'মসিহ', ওল্ড টেস্টামেন্টে যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। প্রভু যিশুর আর্দশ, শিক্ষা এবং প্রদর্শিত পথ THE HOLY BIBLE/পবিত্র বাইবেল দ্বারা নির্দিষ্ট যা তাদের কাছে GOD'S WORD ঈশ্বরের বাক্য। পৃথিবীর নানা প্রান্তের প্রায় ৪০ জন সাধু ১৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাইবেল রচনা করেছেন । ঈশ্বর পুত্র যিশু, বাইবেলের কেন্দ্রীয় চরিত্র তবে লেখক এবং রচনাকাল ভিন্নতায় রচনা সমূহের মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত করা গেছে। সর্বপ্রথম মুদ্রিত বাইবেল হল গুটেনবার্গ বাইবেল। পৃথিবীতে বিদ্যমান ৭০০০ ভাষার মধ্যে প্রায় ২৮০০ ভাষায় অনুদিত হয়েছে পবিত্র বাইবেল । প্রতি বছর ছাপা হচ্ছে ১০ কোটি, এই পর্যন্ত মুদ্রিত হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটিরও অধিক।


বাইবেল, গ্রিক βιβλία (biblia) শব্দটির অর্থ '‍একটি পুস্তক' যা প্যাপিরাস গাছের ছালে লিখিত হয়েছিল। পবিত্র বাইবেল প্রধান দুটি অংশে বিভক্ত- ওল্ড টেস্টামেন্ট তথা পুরাতন নিয়ম  ও নিউ টেস্টামেন্ট তথা নতুন নিয়ম । পুরাতন নিয়মের অধিকাংশ পুস্তক হিব্রুতে লেখা অল্প কিছু অরামীয় Aramaic প্যালেষ্টাইন ভাষায়,  পুরাতন নিয়মের পুস্তক সংখ্যা হল ৩৯টি। নতুন নিয়মের সব পুস্তকই গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছে, নতুন নিয়মের পুস্তক সংখ্যা ২৭টি। নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোতে পাঁচটি ভাগ আছে যার অন্যতম প্রধান অংশটির নাম সুসমাচার 'Gospel'।  প্রভু যিশুর মাধ্যমে ঈশ্বর প্রেরিত সংবাদ সমূহকে ইংরেজি বলা হয় 'Gospel'। এই শব্দটি মূলত god (good) – spel  থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ শুভ সংবাদ কিংবা সুসমাচার । প্রভু যিশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুজ্জীবনের বিবরণ  'Gospel' দ্বারা প্রকাশিত। মথি, মার্ক, লুক ও যোহান (Matthew, Mark, Luke & John) দ্বারা লিখিত নূতন নিয়মের চারটি Gospel সুসমাচার কে যিশুর  ঐতিহাসিক সত্যতা অনুসন্ধানের  জন্য অধিক মর্যাদা সম্পন্ন এবং শ্রেষ্ঠ সূত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়।  Matthew 1:18  বলতে বোঝায় সাধু মথি লিখিত সুসমাচার, অধ্যায় সংখ্যা ১ এবং স্তবকসংখ্যা ১৮।

খ্রিস্টানগণ বিশ্বাস করেন, এই বাইবেল রচনা হয়েছিল খ্রিস্টীয় 'ত্রিত্ববাদ'-এর অন্যতম পবিত্র আত্মার সহায়তায় । 'ত্রিত্ব মতবাদ' হচ্ছে  খ্রিষ্ট ধর্মের ঈশ্বর বিষয়ক মূল মতবাদ । এক ঈশ্বর, কিন্তু তাঁর মধ্যে তিনটি ব্যক্তি-সত্তা'র কার্যকারিতা ।

১। পিতা ঈশ্বর – সবকিছুর পরিকল্পনাকারি।

২। পুত্র ঈশ্বর -পরিকল্পনার বাস্তবায়নকারি।

৩। পবিত্র আত্মা ঈশ্বর- পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষমতা বা শক্তি যোগানকারি।

পণ্ডিত এবং গবেষকগণ মনে করেন  'যিশু'  ছিলেন এমন একজন রহস্যোদঘাটনবাদী  ধর্মপ্রচারক যিনি ইহুদি ধর্মের মধ্যেই একটি সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন । যদিও কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষক বলেন যে, 'যিশু'  আদৌ রহস্যোদঘাটনবাদী ছিলেন না । ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি কী, তা নিয়ে 'যিশু' ইহুদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতেন, রোগীদের রোগমুক্ত করতেন, নানাবিধ অলৌকিক ঘটনা সম্পাদন করতেন, নীতিগর্ভ কাহিনীর  মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করতেন । যিশুর অনুগামীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছিলেন এবং তাঁরা যে সমাজ গঠন করেছিলেন, সেটিই পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চার্চে পরিণত হয়।

THE NEW TESTAMENT  MATTHEW  সাধু মথি লিখিত সুসমাচার

মরিয়মের সঙ্গে যোষেফের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বিবাহ এর পূর্বেই জানা গেল, মরিয়ম পবিত্র আত্মার প্রভাবে গর্ভবতী হয়েছেন।  তাঁর ভাবী স্বামী যোষেফ ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি। তিনি মরিয়মকে লোক চক্ষে হেয় করতে চাইলেন না। তাই গোপনে তাঁকে ত্যাগ করার সংকল্প করলেন। এই সমস্যা নিয়ে তিনি যখন বিব্রত সেই সময়ে ঈশ্বর প্রেরিত দূত স্বপ্নে তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন, ওহে ডেভিড পুত্র যোসেফ, মরিয়মকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে দ্বিধা করো না, কারণ পবিত্র আত্মার প্রভাবেই সে গর্ভধারণ করেছে। তার একটি পুত্র সন্তান হবে, তুমি তার নাম রেখো যিশু, কারণ তিনি তাঁর প্রজাদের পাপের কবল থেকে উদ্ধার করবেন।  (Matthew 1:18-21)

প্রতাপশালী রাজা হেরোদের আমলে যিহুদীয়া বেথলেহেম শহরে যিশুর জন্ম হয়। সেই সময়ে প্রাচ্য থেকে কয়েকজন জ্যোতিষী জেরুজালেমে এলেন। তাঁরা জানতে চাইলেন। ইহুদিদের যে রাজা জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি কোথায়? প্রাচ্যের আকাশে তাঁর জন্মের প্রতীক তারার উদয় আমরা দেখেছি। আমরা এসেছি তাঁকে প্রণাম করতে। (Matthew 2:1-2)

প্রতাপশালী হেরোদ তখন সেই জ্যোতিষীদের গোপনে ডেকে তাঁদের কাছ থেকে বিশেষ ভাবে জেনে নিলেন, সেই তারাটি ঠিক কোন সময়ে দেখা গিয়েছিল। তারপর তিনি তাঁদের বেথলেহেমে পাঠিয়ে দিলেন, আর বলে দিলেন, আপনারা সেখানে গিয়ে ভাল করে শিশুটির খোঁজ নিন এবং আমাকে এসে জানান যেন আমিও গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে পারি। এরপর হেরোদের কাছে ফিরে না যাবার স্বপ্নাদেশ পেয়ে অন্য পথ ধরে তাঁরা স্বদেশে ফিরে গেলেন। (Matthew 2:7-8)

জ্যোতিষীরা চলে যাবার পর ঈশ্বরের দূত স্বপ্নে দেখা দিয়ে যোসেফকে বললেন, "যোসেফ, ওঠো, শিশুটি ও তাঁর মাকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যাও। আমার আদেশ না পাওয়া পযর্ন্ত তুমি সেখানেই থাকবে। কারণ শিশুটিকে হত্যা করার জন্য হেরোদ তাঁর সন্ধানে তৎপর হবে। (Matthew 2:13)

প্রতাপশালী রাজা হেরোদ যখন বুঝতে পারলেন যে প্রাচ্যের জ্যোতিষীরা তাঁকে প্রতারণা করেছেন, তখন তিনি অত্যন্ত  ক্রুদ্ধ  হলেন। তিনি তখনই সৈন্য পাঠিয়ে বেথলেহেম ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে দু'বছর ও তার কম বয়সের যত শিশুপুত্র ছিল তাদের সকলকে হত্যা করলেন। জ্যোতিষীদের কথামত তিনি এই বয়সেরই হিসাব করেছিলেন। (Matthew 2:16)

রাজা হেরোদের মৃত্যুর পর প্রভুর এক দূত মিশরে যোসেফকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, যোসেফ, শিশুটি ও তাঁর মাকে নিয়ে এখনি ইসরায়েল দেশে ফিরে যাও। কারণ শিশুটির প্রাণনাশের চেষ্টা যারা করেছিল তাদের মৃত্যু হয়েছে। যোসেফ তখন তাঁদের নিয়ে ইসরায়েল দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন যে আর্কেলাউস তাঁর পিতা হেরোদের স্থলে ইহুদিয়া প্রদেশে রাজত্ব করছেন। তাই সেখানে যেতে তিনি ভয় পেলেন। স্বপ্নেও তিনি এ সম্বন্ধে সতর্কবাণী পেলেন। তিনি গালীল প্রদেশে চলে গেলেন এবং  নাজারেথ নামে এক জনপদে বাস করতে লাগলেন। (Matthew 2:19-23)

সেই সময়ে যিশু ব্যাপ্তিস্ম (ব্যাপ্টিস্ট হওয়ার দীক্ষা) নেবার জন্য গালীল থেকে জর্ডন নদীর তীরে যোহনের কাছে এলেন।  যোহনের তাতে সম্মতি ছিল না, বলেছিলেন- আমারই তো উচিত আপনার হাতে ব্যাপ্তিস্ম গ্রহণ করা, আর আপনি এসেছেন আমার কাছে ! কিন্তু যিশু তাঁকে বললেন, এখন এ রকম হওয়াই সঙ্গত। কারণ এভাবেই ঈশ্বরের বিধান আমাদের পালন করতে হবে। যোহন তখন সম্মত হলেন। ব্যাপ্তিস্মের পর যিশু জল থেকে উঠে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং তিনি দেখলেন ঈশ্বরের আত্মা কপোতের মত নেমে এসে তাঁর উপরে অধিষ্ঠিত হলেন। (Matthew 3:13-16)

সামন্ত রাজ হেরোদ (প্রতাপশালী রাজা হেরোদ পুত্র) যিশুর খ্যাতি শুনতে পেয়ে তাঁর সভাসদদের বললেন, ইনিই ব্যাপ্তিস্ম দাতা যোহন,  ইনি মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন, তাই এই সমস্ত অলৌকিক শক্তি তাঁর মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সামন্ত রাজ হেরোদ তাঁর ভাই ফিলিপের স্ত্রী হেরোদিয়ার জন্য যোহনকে গ্রেপ্তার করেছিলেন এবং শৃঙ্খলিত করে তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিলেন।  যোহন তাঁকে বলেছিলেন, ভ্রাতৃবধূকে গ্রহণ করা আপনার উচিত হয়নি। হেরোদ তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনসাধারণের ভয়ে তিনি রাজী হননি। কারণ তারা যোহনকে ঈশ্বরের দূত বলে মান্য করত। হেরোদের জন্মদিনে হেরোদিয়ার কন্যা দরবারে নেচে হেরোদকে খুশি করেছিল। তিনি শপথ করে এই কথা দিলেন,  ভ্রাতুস্পুত্রী মেয়েটি যা চাইবে তিনি তাকে তাই দেবেন।  তার মায়ের পরামর্শে মেয়েটি বলল,  যিশুর ব্যাপ্তিস্মদাতা যোহনের মাথাটি একটি থালায় করে আমাকে এনে দিন। রাজা এতে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন,  কিন্তু নিজের শপথের কথা এবং আমন্ত্রিতেরা কি মনে করবেন, তাই ভেবে তিনি আদেশ দিলেন।  কারাগারে লোক পাঠিয়ে যোহনের মস্তক ছেদন করে থালায় নিয়ে আসা হল মাথাটি, মেয়ে তার মার কাছে নিয়ে গেল সেটি। (Matthew 14:1-11)

তিনি যখন কথা বলছিলেন সেই সময়ে উজ্জ্বল একখণ্ড মেঘ এসে তাঁদের ঢেকে ফেলল এবং সেই মেঘের মধ্য থেকে এই বাণী ঘোষিত হল, 'ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, আমার পরম প্রীতিভাজন , তাঁর কথা শোন'। এই কথা শুনে শিষ্যেরা ভয়ে অভিভূত হয়ে মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। যিশু কাছে এসে তাঁদের স্পর্শ করে বললেন, ওঠ, ভয় করো না।  তাঁরা তখন তাকিয়ে দেখলেন, যিশু ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই। পাহাড় থেকে নেমে আসার সময়ে যিশু তাঁদের এই আদেশ দিলেন, মানবপুত্র যতদিন না মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হন ততদিন এই দর্শনের কথা তোমরা কাউকে বলো না। (Matthew 17:5-9)

তাঁরা সকলে যখন গালীল পরিভ্রমণ করছিলেন তখন যিশু তাঁদের বললেন, মানবপুত্রকে মানুষের অধীনে সমর্পণ করা হবে । তারা তাঁকে হত্যা করবে কিন্তু তৃতীয় দিনে তিনি পুনরুত্থিত হবেন। এ কথা শুনে শিষ্যরা অত্যন্ত বিষন্ন হলেন। (Matthew 17:22-23)

যিশু জেরুজালেমে  প্রবেশ করলেন সমস্ত নগরে এক মহা আলোড়নের সৃষ্টি হল। লোকে জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি? জনতা উত্তর দিল তিনিই নেজারতের সেই ঈশ্বর প্রেরিত দূত , ইনিই যিশু!  যিশু মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরের মধ্যে যারা বেচাকেনা করছিল তিনি তাদের সকলকে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি অর্থ লেনদেন কারীদের  টেবিল ও ঘুঘু ব্যাপারীদের আসন উলটিয়ে ফেলে দিলেন।  তাদের বললেন, শাস্ত্রে লেখা আছে, 'এই গৃহ প্রার্থনা ভবন রূপে গণ্য হবে',  কিন্তু তোমরা একে দস্যুর আস্তানায় পরিণত করেছ।  মন্দিরে মধ্যে অন্ধ ও খোঁড়া  কিছু লোক  তাঁর কাছে এল,  তিনি তাদের সুস্থ করে দিলেন।  প্রধান পুরোহিত ও শাস্ত্রীরা তাঁর অলৌকিক কাজ দেখে এবং মন্দিরের মধ্যে ছেলেমেয়েদের যিশুর পক্ষে চিৎকার শুনে খুব ক্রুদ্ধ হলেন। (Matthew 21:10-15)

ভণ্ড শাস্ত্রী ও ফরিশীর দল, ধিক তোমাদের! তোমরা লোকের সামনে স্বর্গরাজ্যের দরজা বন্ধ করে দাও। নিজেরা তো প্রবেশ করই না, যারা চায় তাদেরও ঢুকতে দাও । ধিক তোমাদের ! তোমরা বিধবাদের বিষয়-সম্পত্তি গ্রাস কর, অথচ ধর্মের ভাণ করে লম্বাচওড়া প্রার্থনা আওড়াও, এজন্য বিচারে তোমাদের আরও গুরুতর শাস্তি হবে । ভণ্ড শাস্ত্রবিদ ও ফরিশীর দল,  ধিক তোমাদের! একটি লোককে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টায় তোমরা জলে স্থলে ঘুরে বেড়াও, আর কাউকে যদি তা করতে পার তাহলে তোমরা তাকে নিজেদের চেয়েও বড় পাষণ্ড করে তোল। ( Matthew 23:13-15)

তাঁর বারোজন শিষ্যের অন্যতম যিহুদা এসে উপস্থিত হল। তার সঙ্গে ছিল প্রধান পুরোহিত ও সমাজপতিদের পাঠানো একদল লোক। তাদের হাতে ছিল তরোয়াল ও লাঠি। সেই বিশ্বাসঘাতক তাদের এই সঙ্কেত দিয়ে বলেছিল, আমি যাকে চুম্বন করব, সে-ই হল ঐ লোক। তোমরা গিয়ে তাকে ধরবে। সে সোজা যিশুর কাছে এগিয়ে এসে তাঁকে সম্ভাষণ জানাল, গুরুদেব, মঙ্গল হোক আপনার! তারপর সে তাঁকে চুম্বন করল। যিশু তাকে বললেন, বন্ধু যা করতে এসেছ করে ফেল। তারা তখন এগিয়ে এসে যিশুকে গ্রেপ্তার করল।  (Matthew 26: 47-50)

তারপর রাজ্যপালের সৈন্যরা যিশুকে রাজভবনে সৈন্যাবাসে নিয়ে গেল এবং সমগ্র সেনাদল তাঁর চারপাশে জড়ো হল। তাঁর জামাকাপড় খুলে নিয়ে তারা তাঁকে একটি গাঢ় বেগুনী পোষাক পরিয়ে দিল। একটি কাঁটার মুকুট গেঁথে তারা তাঁর মাথায় বসিয়ে দিল আর তাঁর ডান হাতে তুলে দিল একটি লাঠি। তাঁর সামনে তারা নতজানু হয়ে উপহাস করে বলতে লাগল, ইহুদী রাজের জয় হোক! তারা তাঁর গায়ে থুতু দিল এবং সেই লাঠি দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করল। এইভাবে বিদ্রূপ করার পর তারা তাঁর গায়ের সেই পোষাক খুলে নিল, আবার তাঁকে তাঁর নিজের জামাকাপড় পরিয়ে তাঁকে ক্রুশে দেবার জন্য নিয়ে চলল। সেখানে তাঁকে তিক্ত দ্রাক্ষারস পান করতে দিল, কিন্তু একটু আস্বাদন করে তিনি তা পান করতে চাইলেন না। তারপর তাঁরা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করল এবং তাঁর জামাকাপড় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল।  (Matthew 27: 27-31,34)

যিশু  উচ্চকন্ঠে চীৎকার করে প্রাণত্যাগ করলেন। তখনই মন্দিরের যবনিকা উপর থেকে নীচু পর্যন্ত ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে গেল, ভূমিকম্প হল, পর্বত বিদীর্ণ হল । সমাধিগুলি খুলে গেল, বহু মৃত পুণ্যাত্মার দেহ পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল,এবং যিশুর পুনরুত্থানের পর সমাধি থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা পুণ্য নগরীতে প্রবেশ করেছিলেন।  (Matthew 27: 50-31)

তাঁর দেহ ছিল বিদ্যুতের মত, তাঁর পোষাক ছিল তুষারশুভ্র। যারা পাহারা দিচ্ছিল তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ল। স্বর্গদূত মহিলাদের উদ্দেশ করে বললেন, ভয় পেয়ো না, আমি জানি, তোমরা ক্রুশে নিহত যিশুকে খুঁজছ। তিনি এখানে নেই, তাঁর কথা মতই তিনি পুনরুত্থিত হয়েছেন। এসো, যেখানে তিনি শায়িত ছিলেন সেই স্থানটি দেখ। তাঁর শিষ্যদের সত্বর সংবাদ দাও যে তিনি মৃতলোক থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং তোমাদের আগেই গালীলে যাচ্ছেন। তোমরা সেখানেই তাঁর দেখা পাবে, এই আমার বক্তব্য। ভয়ে ও গভীর আনন্দে উদ্বেল হয়ে তাঁরা সমাধিস্থল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটে চললেন শিষ্যদের সংবাদ দিতে। হঠাৎ যিশু এসে তাঁদের সামনে দাঁড়ালেন, বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক। তাঁরা কাছে গিয়ে তাঁর পা দু'খানি জড়িয়ে ধরে তাঁকে প্রণাম করলেন। (Matthew 28: 3-9)

ক্যাথলিক

ক্যাথলিক শব্দটির অর্থ সার্বজনীন । 'রোমান ক্যাথলিক চার্চ'  হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্মের বৃহত্তম উপাসনালয় বা গির্জা । ইতালীর রোম নগরীর সার্বভৌম ভ্যাটিক্যানসিটিতে যার অবস্থান । এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় ইনস্টিটিউশান, পশ্চিমীয় সভ্যতার বিকাশে যার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । রোমের বিশপ 'পোপ' (ল্যাটিন 'papa' গ্রীক 'pappas' পিতাকে শিশুরা যে নামে ডাকে) কে রোমান ক্যাথলিক চার্চের  প্রধান এবং বিশ্ব ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের গুরু হিসাবে মান্য করা হয়। 'রোমান ক্যাথলিক চার্চ'  মতানুযায়ী যীশু ও তাঁর  দ্বাদশ শিষ্য (Twelve Apostles)  দ্বারা প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত এটিই আদি অকৃত্রিম  গির্জা । প্রথম ও অবিভক্ত খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে  যার শুরু এবং নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রেরিত পুরুষ পরম্পরায়  (Apostolic Succession) এখনও পর্যন্ত যা বিরাজমান।  গির্জার বিধান (Canon law) অনুযায়ী যারা ব্যাপ্তিস্ম  (baptized) হয়েছেন অথবা ধর্মীয় পেশায় নিয়োজিত হয়ে ক্যাথলিক চার্চ  দ্বারা গৃহীত হয়েছেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদ ত্যাগ করেন নি , তারাই মূলত 'ক্যাথলিক'। মহামান্য ষোড়শ বেনেডিক্ট হলেন বর্তমান পোপ। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭২০ কোটি ধরা হলে খ্রিষ্টান  ধর্মানুসারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ প্রায় ২৪০ কোটি । এই ২.৪ বিলিয়ন খ্রিস্টান দের প্রায় অর্ধেক ১.২ বিলিয়ন ক্যাথলিক মতে বিশ্বাস করেন  ।

মার্টিন লুথার লিখিত পোপ বরাবরে পত্র।

প্রটেস্ট্যান্ট

ষোড়শ শতাব্দীতে 'রোমান ক্যাথলিক চার্চ'-এর  প্রথা, নিয়মকানুন, বিধি-বিধান এবং রীতি-নীতির প্রতি দ্বিমত পোষণ এবং তার সংস্কার আন্দোলনের মধ্যদিয়েই প্রটেস্ট্যান্ট'দের  আবির্ভাব । জার্মানীর ক্যাথলিক পুরোহিত মার্টিন লুথার প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীর একজন অন্যতম প্রবক্তা । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুণ্যপিতা পোপ মহোদয়কে ৯৫ দফা সম্বলিত একখানা পত্র লিখেছিলেন। তিনি সেখানে  ক্যাথলিক মন্ডলীর বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি সমূহ তুলে ধরেন এবং মন্ডলীর স্বার্থে তা সংশোধনের আহ্বান জানান। কিন্তু পোপ মহোদয় গ্রহণ করতে অস্বীকার জানান । এই দ্বিধা বিভক্তিকে ঘিরেই পুণ্য পিতা পোপ মহোদয়ের পরিচালনাধীন একক মন্ডলীতে একটি লক্ষণীয় বিভাজন জন্ম গ্রহণ করে । উদ্ভব হয় প্রটেস্ট্যান্ট , আন্দোলনটি  প্রথম শুরু হয় জার্মানিতে। ১৫২৭ সালে মার্টিন লুথার প্রণিত প্রন্থ 'দ্য নাইন্টি ফাইভ থিসিস' গ্রন্থে তিনি রোমান যাজকীয় নীতি, তাদের প্রচলিত খ্রীস্ট বিশ্বাস নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন । ষোড়শ শতকে  তার অনুসারীরারা  ইউরোপের জার্মান থেকে আশেপাশের স্ক্যান্ডিনেভীয় এলাকা সমূহ ডেনমার্ক , নরওয়ে , ফিনল্যান্ড এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে,  প্রতিষ্ঠা করে লুথিয়ান চার্চ । হাঙ্গেরি, স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও একই আদলে চার্চের সংস্কার করা হয় । ১৫৫৩ সালে চার্চ অব ইংল্যান্ড পোপের কর্তৃত্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে এই সংস্কার আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করে ,গঠিত হয়  প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলী । তাদের দ্বারা  শিক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান, মানবতা,  রাজনীতি, সমাজনীতি , অর্থনীতি, শিল্পকলায় প্রভূত অর্জন সাধিত হয় ,  বিকশিত হয় সভ্যতা । ব্যাপ্টিস্টগণ মূলত একক বিশ্বাসী কোন গ্রুপ নন , তাদের কার্য পদ্ধতি , ধর্ম রীতি পালন ও বিশ্বাসের রকমফেরে তাদের মধ্যেও বিভিন্ন অনুসারী আছেন । বিশ্বজুরে ব্যাপ্টিজমে বিশ্বাসী লোক সংখ্যা খ্রিস্টান জনসংখ্যা ২৪০ কোটি'র প্রায় ৩৭%, ৯০ কোটি।

*অর্থোডক্স খ্রিস্টান , খ্রিস্টধর্মের আরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যা এখানে উল্লেখ্য হয়নি।

ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট মত পার্থক্য

এই দুই গোষ্ঠী'র খৃষ্টানগণই যিশু খ্রিস্ট প্রদর্শিত ধর্মের বেসিক প্রিন্সিপালগুলো মেনে চলেন, তথাপি তাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রযেছে। প্রোটেস্ট্যান্টগন মনে করেন ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত পবিত্র বাইবেল হলো একটি সম্পূর্ণ বিধান এবং একমাত্র বাইবেলের শিক্ষাই জগতের পাপীগনের মুক্তিলাভ করার জন্য যথেষ্ট। তাদের মতে সকল ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হল বাইবেল। প্রোটেস্ট্যান্টদের এই ধারনার উৎস হল পাঁচ প্রত্যাদেশ । যার একটি  প্রত্যাদেশ 'Sola Scriptura' যার মানে পবিত্র বাইবেল অনুসরণ করা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন নির্দেশিত পথ নাই । এছাড়া পাবিত্র বাইবেলের বিভিন্ন জায়গায়ও একাধিকবার তাদের মতবাদের পক্ষে যুক্তি আছে বলে প্রোটেস্ট্যানগন মনে করেন। কিন্তু ক্যাথলিকগন এই ধারণা সঠিক মনে করেন না। তাদের মতে পবিত্র বাইবেলের পাশাপাশি রোমান ঐতিহ্যগত অনুশাসনও একজন খ্রীস্টানের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য । ক্যাথলিকরা সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী , তারা মনে করেন 'রোমান ক্যাথলিক চার্চ' হচ্ছে সেই গির্জা যা মূলত যীশু'র মনোনীত শিষ্য দ্বারা প্রতিষ্টিত। তারা প্রভু যীশু এবং বাইবেল নির্দেশিত পথ মেনে চলেন এবং যুগপৎ  খ্রীষ্ট সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রধান হিসাবে পোপের কর্তৃত্বকে স্বীকার করেন । ক্যাথলিকগন মনে করেন 'পোপ' তিনি সকল গির্জার প্রধান,  Vicar of Christ অর্থাৎ যীশুর প্রতিনিধি । তারা মনে করেন  পোপ নির্দেশিত সকল শিক্ষা ও বাণী নির্ভুল এবং খ্রীস্ট  ধর্মবিশ্বাস ও  জ্ঞান চর্চায় 'পোপ' কোন ভুল করতে পারেন না । অন্যদিকে প্রোটেস্ট্যান্টগন তা মানতে নারাজ , তাদের বক্তব্য পোপ একজন মানুষ, তিনি ঈশ্বর প্রেরিত কোন দূত নন , তাই তিনি ভুলের উর্ধ্বে নন । প্রোটেস্টানরা ক্যাথলিকদের মতো পৌরহিত্য করেন না । সামাজিক আচার , রীতি কিংবা অনুষ্ঠান পালনে যাজক হিসাবে তারা সর্বজন বিশ্বাসভাজন কারও উপর তার দায়িত্ব অর্পন করতে চান । ক্যাথলিকরা ঈশ্বর-যীশু ছাড়াও অনেক সাধু সন্তদের উদ্দেশ্য প্রার্থনা করেন। প্রোটেস্ট্যান্টরা সাধু সন্তদের উপর বিশ্বাস রাখলেও তাদের উদ্দেশ্যে  প্রার্থনা করেন না । এছাড়া আরও কিছু ধর্মাচার , যেমন হলিওয়াটার, সেলিবাচি, যন্ত্রনাভোগ ও নানে শুধুমাত্র ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন। প্রোটেস্ট্যান্টরা মনে করেন পাপমোচন বা মুক্তি লাভের লাভের একমাত্র উপায় ঈশ্বরের উপাসনা । ক্যাথলিকরাও তেমনটাই বিশ্বাস করেন তবে পাশাপাশি সাতটি পবিত্র স্যাকরাম্যন্টের / গির্জা কর্ত্তৃক নির্দেশিত ধর্মাচার  দ্বারা অনুগ্রহ লাভের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করেন  ক্যাথলিকগণ । তন্মধ্যে ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট গণ মনে করেন একজন শিশু জন্মের পরেই প্রভু যিশুকে হৃদয়ঙ্গম কিংবা ধারন করার যোগ্য হয়ে উঠে না । শুধু মাত্র প্রাপ্তবয়স্ক হলে সে জীবন দর্শণ পাপ-পুণ্য সম্পর্কে সম্যক ধারনা অর্জনে সক্ষম হয় । তাই তারা 'Adult baptism'  -এ বিশ্বাস করে । ব্যাপ্টিস্টগণ বিশ্বাস করেন 'infant baptism' বাইবেলের কোথাও বর্ণিত হয় নি । কিন্তু ক্যাথলিকরা ইনফ্যান্ট ব্যাপ্টিজম বা অভিসিঞ্চনে বিশ্বাস করে ।

বাংলায়  খ্রিস্টধর্ম

ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যিশু খ্রিস্টের ১২ জন শিষ্যের অন্যতম সাধু টমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে আসেন এবং ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে সাক্ষ্যমর বা ধর্মশহীদ হন। এ সময়ের মধ্যে তিনি স্থানীয় কিছু ইহুদী, অগ্নিউপাসক ও সনাতনধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পর্তুগীজ আধিপত্যের  গোড়াপত্তন করেন। পর্তুগীজ বসতিস্থাপনকারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা বর্তমান ভারতের হুগলীর নিকটবর্তী সাতগাঁও ও চট্টগ্রামে বসবাস ও শুল্কগৃহ নির্মাণের অনুমোদন  লাভ করেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট আকবর তাঁদেরকে বঙ্গদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পর্তুগীজ মিশনারীরা বাংলাদেশের শিক্ষা, সভ্যতা ও সামাজিক অবস্থার ভিত্ প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকেন। ১৬৬৩-১৮৩৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গদেশে খ্রিস্ট ধর্মের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে।

"সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার

ঈশ্বরীপুর গ্রামে, স্থাপিত হয়েছিল-বাংলাদেশের প্রথম খ্রিস্টান গির্জা"

১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ইগ্নেসিয়াস লয়োলা নামক একজন স্পেনিস ব্যক্তির নেতৃত্বে জেসুইট বা যিশু সম্প্রদায় গঠিত হওয়ার পর খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য খ্রিস্টানগণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। পিয়ারে ডু জারিক নামক একজন ফরাসী'র  তথ্যানুযায়ী , সে সময়ে বাকলা, শ্রীপুর ও যশোহর নামে তিনটি হিন্দু রাজ্য ছিল। ফনসেকা নামক একজন খ্রিস্টান পাদ্রী নদীপথে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুরে পৌছান । সেখানে তিনি অন্য একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ফাদার সোসার সাক্ষাৎপান । অত:পর ফাদার সোসও ফনসেকা প্রতাপাদিত্যের দরবার কক্ষ বারদুয়ারীতে উপস্থিত হয়ে রাজাকে বেরিঙ্গান নামের এক প্রকার সুস্বাদু কমলালেবু উপহার দেন এবং বারদুয়ারী ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে যেখানে খ্রিস্টান পল্লী অবস্থিত সেখানে একটি গির্জা নির্মাণের প্রস্তাব করেন । প্রতাপাদিত্য আনন্দের সঙ্গে এ প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। প্রতাপাদিত্যের ফরমান পাওয়ার পরই গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যায় । ঐ সময়ে প্রতাপাদিত্যের সৈন্য বাহিনীতে বহু পর্তুগীজ সৈন্য কর্মরত ছিলেন । গির্জা নির্মাণের জন্য তারাসাধ্যমত অর্থ সাহায্য করেন । এছাড়া প্রতাপাদিত্য নিজের রাজধানীতে খ্রিস্টানদের উপাসনালয় নির্মাণের জন্য প্রভূত সাহায্য সহযোগিতা করেন । ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে গির্জার নির্মাণ কাজ শেষ হয় । নাম ছিল  ÔHoly Name of Jesus' । ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র তার ১৯২২ সালে প্রকাশিত 'যশোর খুলনার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন,  'ঈশ্বরীপুরের (বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর) উত্তর-পূর্ব কোণে যুধিষ্ঠির সর্দারের ভিটাবাড়ির পাশের জঙ্গলের মধ্যে ইষ্টকরাশি এক্ষণে তাহার স্থান নির্দেশ করিয়া দেয় মাত্র'।

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ফাদার ফ্রান্সিস্কো ফার্নান্দেজ এবং এন্ড্রূ বোভস, আরকানের রাজার অর্থ সহায়তায় দ্বিতীয় গির্জাটি নির্মাণ করেন চট্টগ্রামে , যার নাম 'Saint John the Baptist Church'. ১৬০১ সালে পর্তুগীজ মার্চেন্টগণ কর্নফুলী নদী তীরে তৃতীয় গির্জাটি নির্মান করেন , যা আরাকান আক্রমনে যা ধ্বংস হয়ে যায় । কিছু পর্তুগিজ বালক তখন  আরাকান'দের ক্রীতদাস হিসাবে কর্মরত ছিল ,  ফাদার ফ্রান্সিস্কো ফার্নান্দেজ এর প্রতিবাদ করেছিলেন । আরকান'রা তখন ফাদার কে ব্যাপক মারধর করে। নির্মম ভাবে আঘাত এবং নির্যাতনপূর্বক ফাদারকে অন্ধকার ঘরে বেঁধে রাখে তারা। অতঃপর ১৪ নভেম্বর ১৬০২ তারিখে  মারা যান ফ্রান্সিস্কো ফার্নান্দেজ। সেটি ছিল -বাংলার বুকে কোন খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকের প্রথম মৃত্যু।

১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রথম পর্তুগীজ আগষ্টিনিয়ান পুরোহিতগণ খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু করেন। ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নারিন্দায় একটি গির্জা নির্মিত হয় যার নাম রাখা হয় 'Church of the Assumption'. ঢাকার ঐতিহাসিক তেজগাঁও গির্জা ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এছাড়া বর্তমান গাজীপুর জেলার নাগরীতে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে, ঢাকার নবাবগঞ্জের হাসনাবাদে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে এবং বরিশালের পাদ্রীশিবপুরে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটি করে গির্জা নির্মিত হয়েছিল।

বাংলাভাষা ও বাঙালি জাতির শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মিশনারি মনীষীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর নাম ড. উইলিয়াম কেরী। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতায় আসেন। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা খুলেন এবং হিন্দু ও মুসলমান যুবকদের জন্য মদনাবটিতে ১টি ও রামপাল দীঘিতে ১টি কলেজ স্থাপন করেন। তিনি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র বাইবেলের নতুন নিয়মের গদ্য অনুবাদ করেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পবিত্র বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম বাংলায় অনুবাদ করেন ও তা মুদ্রণ করেন। ড. কেরী ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একখান ছাপাখানা স্থাপন করেন ও ছাপার মান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি শ্রীরামপুরে একটি কলেজও স্থাপন করেন। তাঁর কর্মজীবন অবিভক্ত ভারতে খ্রিস্টধর্মের আলো প্রবর্তনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ড. কেরী ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট মন্ডলীর একজন নিবেদিত প্রাণ ধর্ম প্রচারক।

বাংলাদেশের ক্যাথলিক মণ্ডলি  ঢাকা , চট্টগ্রাম , দিনাজপুর , খুলনা , ময়মনসিংহ , রাজশাহী ও সিলেট এই ৭টি ধর্মপ্রদেশে  বিভক্ত। বাংলাদেশে মোট  খ্রিস্টান জনগণ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ , তন্মধ্যে  সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ক্যাথলিক মন্ডলীর অন্তর্ভুক্ত । সকল বিশপগণের পক্ষে আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি' রোজারিও ক্যাথলিক মন্ডলী বা চার্চ পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাদেশে মূলতঃ তিনিই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু।

প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মণ্ডলি রয়েছে। বাংলাদেশে প্রটেস্ট্যান্ট মণ্ডলিগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান মণ্ডলিগুলো হল- চার্চ অব বাংলাদেশ, ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ, ব্যাপ্টিষ্ট ফেলোশিপ চার্চ, গারো ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ, সেভেন্থ ডে এডভ্যান্টিষ্ট চার্চ, এ্যাসেম্বলীস্ অব গড চার্চ (এজি চার্চ), প্রেসবেটেরিয়ান ফেলোশিপ চার্চ, লুথারিয়ান চার্চ, প্যান্টিকষ্ট চার্চ, গসপেল চার্চ, মেথডিষ্ট চার্চ, নাজরীন চার্চ, তালিতাকুমী চার্চ, ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চ অব বাংলাদেশ, চার্চ অব ক্রাইষ্ট, রিডিম্ড চার্চ অব বাংলাদেশ  উল্লেখযোগ্য। চার্চ অব বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান হলেন শ্রদ্ধেয় বিশপ পল শিশির সরকার।

ঢাকার আর্মেনিয় স্ট্রিটে অবস্থিত আর্মেনিয় গির্জা  'হলি রিজারেকশন'। গির্জাটির প্রার্থনা হলের উপরে স্থাপিত ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, গির্জাটি পূর্বের একটি চ্যাপেলের ধ্বংশাবশেষের ওপর নির্মিত হয়। এটি এবং কলকাতার আর্মেনিয় গির্জা ইচমিয়াদজিন-এর প্রধান আর্মেনিয় গির্জার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। গির্জার আদি শীর্ষ চূড়া ও ক্লক-টাওয়ারটি জোহান্স এ্যারাপিট সারকাইজ কর্তৃক ১৮৩৭ সালে নির্মিত হয়। তবে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এটি ভেঙ্গে পড়ে।

জনসন রোডের সেন্ট টমাস অ্যাংলিকান গির্জাটি ১৮১৯ সালে নির্মিত হয় । বাইরের দিকে এর পোর্চ, খাঁজকাটা প্যারাপেট, ক্লক-টাওয়ার এবং গথিক রীতির খিলান ইংল্যান্ডের পল্লী গির্জাগুলির (parish churches) মতো। বহির্ভাগ থেকে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো গথিক রীতির জানালা সমৃদ্ধ এর সম্মুখ ভাগের দ্বিতল অবয়ব। বিশাল অভ্যন্তর হলটি অসংখ্য ভাস্কর্যে পূর্ণ। দুপাশে মাদার মেরী ও সেন্ট জন সহ ক্রুসের মাঝে বেদনাবিদ্ধ যিশুর চিত্রাঙ্কিত বেদি এবং এর পেছনে রয়েছে চক্র সদৃশ্য জানালা (rose window)। পূর্ব কোণের ছাদে স্বর্গীয় পরী ও যিশুখ্রিস্টের চিত্র অলংকৃত, যা স্বর্গের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান।

'Cathedral of Our Lady of the Holy Rosary' ক্যাথেড্রাল অব আওয়ার লেডি অব দ্য হোলি রোজারি , পাথর ঘাটা চট্টগ্রাম , ক্যাথলিক চার্চ , পর্তুগিজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ১৬০০ সালে , ব্রিটিশ'রা কর্ত্তৃক নতুন নির্মাণ সাল ১৮৪৩ এবং সংস্কার ও পুননির্মাণ ১৯৩৩ সাল।

Holly Rosario Church হোলি রোজারিও চার্চ  তেজগাঁও ঢাকা । গির্জাটি ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় বলে ধারনা করা হয়। প্রথমদিকে এটি গির্জা ছিল না , সম্ভবত নেস্টোরীয় খ্রিস্টানগণ উপাসনার স্থান হিসেবে গির্জার পশ্চিম দিকের অংশটি নির্মাণ করেছিল । ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গির্জাটির চারবার সংস্কারের কথা জানা যায়।

ছবি ও তথ্যঃ উইকিপিডিয়া

খ্রিস্টান রিলিজিয়াস ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট