ভিনদেশী চিত্রগ্রাহক রবীন সেনগুপ্ত’র না জানা ১৯৭১

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 7 March 2017, 07:03 PM
Updated : 7 March 2017, 07:03 PM

ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমার অন্তর্গত ফেনী নদীর ওপারে পূর্ব পাকিস্তানের  রামগড় চা বাগান । ছোট্ট পল্লীগ্রাম হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃস্টান সব ধর্ম সমন্বয়ের এক সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু বর্বর পাক বাহিনী একেও রেহাই দিল না । ২ মে আগুন দিয়ে ছারখার করে দিল পুরো এলাকা । হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে কূল বধূদের বস্ত্রহীন করে নদীতে স্নান তথা গোসল করাতে বাধ্য করল । মানব সমাজের এক কলঙ্কিত ইতিহাস। (সূত্র ১)

আগুনে ভস্মীভূত রামগড় চা বাগান সংলগ্ন পল্লী ।

ছবি তুলেছেন, লিখেছেন ছবির গল্প

জন্মের প্রায় শত বৎসর আগেই, তাঁর পূর্বপুরুষরা বিক্রমপুর ছেড়ে আগরতলায় এসে বসবাস শুরু করেন। বাবা কাকাদের যৌথ স্টুডিওটির নাম ছিল 'সেন অ্যান্ড সেন'। বয়স যখন বিশ , তখন থেকেই পিতার সান্নিধ্যে ফটোগ্রাফি'র শুরু। ১৯৫২ সালে ফ্রি-ল্যান্সার হিসাবে স্ট্যাটস্‌ম্যান, আনন্দবাজার, যুগান্তর ও অমৃতবাজার পত্রিকায় ছবি ছাপা হতে থাকে।  ১৯৫৬-৬২ পর্যন্ত  আদিবাসীদের জীবন নিয়ে, ত্রিপুরার প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। ব্রাজিলে এক কম্পিটিশনে ছবি পাঠালে  সেখানে তাঁর ছবি শ্রেষ্ঠ মনোনয়ন লাভ করে । ১৯৬২ সালে 'দ্য রয়েল ফটোগ্রাফি সোসাইটি অব গ্রেট বৃটেন' এর সম্মানিত সদস্য পদ লাভ করেন। ভারতের জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে, ইন্দিরা-গান্ধী, নাম্বুরিপাদ, জ্যোতিবসু, খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব এবং ত্রিপুরা রাজার খুব স্নেহধন্য ছিলেন। ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন -প্রায় ত্রিশটিরও অধিক। যদিও তাঁর প্রধান কাজ ছিল ছবি তোলা, তথাপি লিখেছেন ছবির পেছনে গল্প। ত্রিপুরার  সমাজ-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, গান-নৃত্যকলা, ইতিহাস-স্থাপত্য , চারু-কারুশিল্প, আদিবাসী-জীবন, রাজনীতি ও মানুষ, এসব নিয়েই ভেবেছেন, তুলেছেন, লিখেছেন।

সদ্যমুক্ত বেগম মুজিব ও তাঁর পরিজন সঙ্গে ত্রিপুরার সাংবাদিকবৃন্দঃ শেখ রেহানা (ডান থেকে চতুর্থ) সামনে শেখ রাসেল, শেখ জামাল ও বেগম মুজিব ,  ক্যামেরা হাতে রবীন সেনগুপ্ত ।

সুরজিৎ ও দীপক প্রথম শহীদ সাংবাদিক, খবর রাখে নি কেউ

৬ই মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী খান সেনাদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের কাহিনীর বীভৎস প্রামাণিক আলোকচিত্র গুলি আমার কাছে প্রথম পৌঁছে দেয় যুগান্তরের সুরজিৎ ঘোষাল ও দীপক ব্যানার্জী । তাদের গৃহীত সেই সব অত্যাচারের কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে 'সংবাদ' হয়ে উঠে । সমগ্র পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে তথাকথিত সভ্য পাকিস্তানী শাসক ও তার সৈন্যবাহিনীর কুকীর্তির বিবরণ। কিন্তু এ জন্য প্রাণ দিতে হয় দুই সাংবাদিক'কে , ২রা এপ্রিল ১৯৭১ সালে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে পাক সৈন্যের নির্মম বেয়নেটের খোঁচায় ও গুলিতে । জয় বাংলার মুক্তিযুদ্ধে এরাই গণ মাধ্যম তথা  সংবাদ জগতের প্রথম শহীদ, এঁদের কথা আজ সবাই বিস্মৃত হয়েছে। (সূত্র-২)

ত্রিপুরার গোপন ঘাটিতে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধা দল।

যুদ্ধের নাম মুক্তিযুদ্ধ , অস্ত্রের নাম ক্যামেরা

পিতা প্রফুল্লচন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, ত্রিপুরার প্রথম পেশাদার ফটোগ্রাফার এবং ত্রিপুরা মহারাজার বিশেষ প্রিয়ভাজন একজন। রবীন তখন সদ্য বিয়ে করেছেন । নতুন বৈবাহিক জীবনে ভরপুর প্রেম আর রোমান্সে জীবন তখন রঙিন হয়ে যাওয়ার  সময়। কিন্তু স্ত্রী রমা সেনগুপ্ত , স্বামীকে জানালেন – প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ! সময় একদম নষ্ট করা চলবে না । রমা প্ররোচিত করলেন  স্বামীকে, নিয়োজিত হতে অন্য এক কাজে! জীবনের নাম যখন – মৃত্যুর প্রহর গোনার প্রতীক্ষা , পিল পিল করে  আগরতলা মুখে নেমে আসছে শরণার্থীর দল , তখন নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করেই দাঁড়াতে হবে অসহায় মানুষের পাশে ! যখন শুরু হয়ে গেছে ঘটনা ১৯৭১, যখন রাতের অন্ধকারে নিরপরাধ অসহায় মানুষগুলোকে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে উল্লাসে মেতে উঠেছে পাকিস্তানী হায়েনার দল,  তখন ঘরে বসে থাকার আর কোন মানেই নেই!

ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘর ছাড়া হলেন রবীন সেনগুপ্ত, স্ত্রী রমা সেনগুপ্ত দূর থেকে দাঁড়িয়ে সাহস দিয়ে গেলেন, চোখ মুছে গেলেন আড়ালে। ছিল রুলেফেক্স, রুলেকড, ক্যানন কিংবা  নিক্কন, সেখান থেকে বেছে কাঁধে তুলে নিলেন এক বা একাধিক।  শরণার্থী শিবির থেকে  সীমান্তবর্তী ক্যাম্প,  মুক্তাঞ্চল থেকে যুদ্ধের ময়দানে ক্যামেরা নামক দুর্দান্ত অস্ত্রটি নিয়ে শুরু হয়ে গেল , এক ভিনদেশী'র মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১।

মর্টার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা।

সাবরুমের থানা থেকে ফেনী নদী খানিকটা দূরে , ওখানে হেঁটে গিয়ে রুলেফেক্স ক্যামেরা ফোকাস করেছি -অমনি ওপার থেকে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেছিল পাক সেনাবাহিনী । সীমানা চিহ্নিত ছিল বাঁশের বেড়া দিয়ে। এরই সঙ্গে বেশ মোটা একটা শিমূল গাছ। কোনক্রমে ওটাকে আড়াল করে চুপ করে বসেছিলাম। কিন্তু জিদ চেপে গিয়েছিল যেমন করেই হোক এই বর্বরতা ক্যামেরায় বন্দী করতেই হবে!  বাঁশের বেড়া ফাঁক করে টুইন লেন্সের রুলেফেক্স ক্যামেরাটি , কোন রকমে ফোকাস করে তিন চারটি স্ন্যাপ পরপর নিয়ে আবার শিমূল গাছের আড়ালে পিঠ দিয়ে চুপচাপ বসেছিলাম । মাঝে মধ্যে এল এম জি থেকে গুলি নিক্ষেপের আওয়াজ আসছিল। (সূত্র-৩)

মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত পাকিস্তানি সৈন্য।

দামাল মুক্তিবাহিনী, নাকাল পাক ফৌজ

ভারতীয় বাহিনী তখন জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে , আর এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে পাক ফৌজ ব্যাপক শক্তি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আগরতলার সীমান্তে। একপর্যায়ে পাক বাহিনী , কামানের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে দিল  একের পর এক । আগরতলা'র আকাশ-বাতাস-ভূমি প্রকম্পিত হয়ে , পুরো শহরটি যেন মাটির সাথে মিশে যাওয়ার প্রতীক্ষায় ! তখন তীব্র শীতের প্রকোপ, তাদের পরিধানে ছিল লুঙ্গি আর টেট্রনের শার্ট  কিন্তু কোমরে ও হাতে বাঁধা ছিল লাল কাপড় । ধান ক্ষেতের আল ধরে ধরে চুপি চুপি এগিয়ে যাচ্ছিল তারা, আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে, হাতে ছিল স্টেনগান সবার । অতর্কিতে পাক বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল , বাংলার লুঙ্গি পরা দামাল মুক্তিবাহিনী । তাদের সাথে এসে যোগ দিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী । ভারতের 'বিজয় ট্যাঙ্ক' আর পাকিস্তানের 'প্যাটন' ট্যাংকের সাথে – সে কী যুদ্ধ ! আগরতলা শহরে তখন গভীর  নিশুতি রাত, গোলাগুলির প্রচণ্ড নিনাদে ,মনে হল -কেউ যেন মহাকালের দুয়ারে হানিয়াছে আঘাত ! সেদিনের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নেমেছিল  মৃত্যু'র মিছিল। এই রকম নিদারুণ বিভীষিকাময় ঘটনা, আগরতলা বাসী'র জীবনে আর ঘটেনি! এই যুদ্ধ'টি স্থায়ী হয়েছিল প্রায় দুই দিন। সুতীব্র আক্রমণে  গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র রেখেই পালাতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী । ডিসেম্বরের ৩ থেকে ৬ তারিখের ঘটনা। (সূত্র-৪)

আখাউড়া আগরতলা সীমান্তে পাকফৌজ'কে পরাজিত করে মিত্রবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথে।

৮৭ বছর বয়সে মৃত্যু

১৯৭১ সালে , একেবারে শুরু থেকেই গভীর ভাবে তিনি জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সাথে। পূর্ববাংলায় তখন , ইতিহাসের জঘন্য এবং নির্মমতম গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি পিশাচকুল। আর সেটি ছিল বিশ্বব্যাপী বাঙালী'র অস্তিত্বকে নতুন করে জানান দেয়ার লড়াই । পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিয়েছিল নতুন একটি দেশ, তিনি ছিলেন সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী । মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারার জন্য তিনি গর্বিত,  মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন , বার বার বলেছেন এই কথা । জন্মেছিলেন ২০শে ডিসেম্বর ১৯৩০ ,  মৃত্যু বরণ করলেন  ২০১৭, ৭ই ফেব্রুয়ারি নিজের শহর আগরতলায়,  মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী ছবি'র কারিগর রবীন সেনগুপ্ত

১৫ ডিসেম্বর রাত ,অহেতুক মৃত্যুর মুখোমুখি

ষোল ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণের চিত্র ধারণ করবার জন্য , পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সাংবাদিক'রা জড়ো হয়েছিলেন আগরতলায় । কথা ছিল হেলিকপ্টার এসে আমাদের নিয়ে যাবে ঢাকায় । কিন্তু অনেক সময় পার হয়ে গেলেও যখন হেলিকপ্টারের দেখা নেই,  তখন সিদ্ধান্ত হল কুমিল্লা হয়ে সড়ক পথ ধরে ঢাকা । দুটি ট্রাক আর তিন'টি জীপে , সোনামুড়া পেরিয়ে বিবিরবাজার দিয়ে কুমিল্লায় পৌঁছানো মাত্রই , মিত্র বাহিনী জানালো – ময়নামতির  ক্যান্টনমেন্ট ডিঙ্গিয়ে  সিএন্ডবি ঘাট হয়ে ঢাকা যাওয়ার পথটি বিপদজনক। কেননা কুমিল্লা  ক্যান্টনমেন্ট তখনও শত্রু মুক্ত হয় নি পুরোপুরি। নতুন সিদ্ধান্ত হল, কুমিল্লা থেকে সড়ক পথে  সোজা চাঁদপুর । প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কণকণে বাতাস উপেক্ষা করে , আমরা যখন চাঁদপুরে পোঁছালাম – ঘড়িতে  তখন রাত সাড়ে বারোটা । দোকানপাট সব বন্ধ , রেলওয়ের একটি সরাইখানায় -প্রচণ্ড ক্ষুধায় একটা কিছু খেয়ে নিয়েই লঞ্চে চেপে বসলাম সবাই। চাঁদপুর ছাত্রলীগের নেতা মনির আগে থেকেই লঞ্চ ব্যবস্থা করে রেখেছিল ঘাটে । প্রমত্ত পদ্মায়  উত্তাল তরঙ্গ ঢেউ আর চারদিকে গভীর অন্ধকার ভেদ করে, সাঁই সাঁই করে , লঞ্চ এগিয়ে চলছে ঢাকামুখি। একটি প্রত্যাশিত আত্মসমর্পণ ক্যামেরাবন্দী হবে আগামীকাল , আমরা সবাই ভীষণ রোমাঞ্চিত ।

১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের নানা দেশের সাংবাদিক সহ চাঁদপুর থেকে ঢাকার পথে , বা থেকে দ্বিতীয় রবীন সেনগুপ্ত

লঞ্চ তখন বিপদজনক মধ্য নদীতে , আচমকা একটি প্রচণ্ড শব্দ জানান দিয়ে , হায়রে!  আস্তে আস্তে থেমে গিয়ে নিঃসাড় হয়ে গেল আমাদের লঞ্চ । মুক্তিবাহিনীর  কিছু সদস্য যদিও সাথে ছিল আমাদের , কিন্তু ব্যাপার'টি ভালো ঠেকলো না কারো কাছেই ! জানা গেল এক অকল্পনীয় দুঃসংবাদ ! ক্রাঙ্কশ্যাফ্‌ট ভেঙ্গে গেছে লঞ্চের । সারেং কে বলে দেয়া হল , সার্চ লাইট জ্বালিয়ে রাখতে -দৈবাৎ যদি বা কোন নৌকা'র দেখা পাওয়া যায় ! তাহলে চাঁদপুর যেয়ে আরেকটি লঞ্চ নিয়ে আসা যেতে পারে । সার্চ লাইট ঘুরে ঘুরে রাউন্ড আপ দিচ্ছে – চারদিকে অথৈজল রাশি , না কোথাও কেউ নেই। আচমকা যেটা আমরা  একদম ভাবি নি , শুরু হল তেমন এক ঘটনা !  লঞ্চ উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছে  শত্রু পক্ষের মুহূর্মুহূ মর্টার শেলিং । বিদেশী সাংবাদিক  যারা ছিলেন , তাদের বলা হল "Don't be afraid , don't switch on your torch or lighter" । রাতের ঘন তমসা দূরীভূত করতে মর্টার শেলের তীব্র জ্যোতির্ময় আলোয়, লঞ্চের আশপাশ  রাত হয়ে গেল দিন। হাওয়াই বাত্তি'র রোশনাই'তে সমগ্র পরিবেশ হয়ে গেল ভয়ঙ্কর ! লঞ্চের সামনে পেছনে , ডানে বামে  -বিকট শব্দে  জলে এসে আছড়ে পড়ছে  মর্টার আর মর্টার ! নিশ্চল লঞ্চ'টি দুলতে লাগলো কাগজের নৌকার মত । আর এই যখন অবস্থা , তখন  নিশ্চিত মৃত্যু  থেকে বাঁচবার জন্য গুরুদেবের কবিতা'ই হল আমার ভরসা ।

"মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান …….

তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,

তুঁহু মম তাপ ঘুচাও।

মরণ, তু আও রে আও"

শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ফুলগাজী স্টেশনে ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং ও মুক্তিবাহিনীর মেজর রফিকুল ইসলাম।

আনন্দবাজার পত্রিকার দুঁদে সাংবাদিক তুষার পণ্ডিতের সে কী কান্না ! লঞ্চটি তখনও দুলছিল , কিন্তু কেন জানি কোন কারণ ছাড়াই আস্তে আস্তে লঞ্চ মুখি মর্টার শেল নিক্ষেপ স্থগিত করে দিলেন শত্রুপক্ষ !  ইতোমধ্যে রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে ফুটে উঠতে লাগলো ভোরের আলো , আবছা কুয়াশায় জেগে উঠছিলেন  পূর্বাকাশে সূর্যদেবতা । চারদিকের আবির রাঙ্গা ভাব কেটে গিয়ে , নদী হয়ে উঠল সোনালী । অনেক দূরে দেখা গেল একটি নৌকা , চিৎকার করে তাদের জানান দেয়া হল -শত্রুপক্ষের নই মোরা,  আসো হে মোদের রক্ষা করো ! বাংলাদেশের পতাকা দেখানো হল , নৌকা আসল লঞ্চের গা'য় ।   সারেং সহ কয়েকজন চেপে বসলেন সেই নৌকায় । মাঝ দরিয়ায় ঘণ্টা চার প্রতীক্ষার পর , মনির চাঁদপুর থেকে আরেকটি লঞ্চ নিয়ে হাজির হল ।

ওয়্যারলেসে রাতে বার বার মনির সহ বাকীরা নাকি জানতে চেয়েছিল – তোমরা কারা , তোমরা কারা , কিন্তু লঞ্চে সবাই তখন এতটাই হতবিহবল ছিল -সেই ওয়্যারলেস পানে খবর ছিল না কারো , তাই কল রিসিভড হয় নি। ফলত মনিরের সাথে মুক্তিবাহিনী'র সবাই মত দিল -এ নিশ্চয়ই পাকিফৌজের লঞ্চ – আক্রমণ ! বলার সাথে সাথেই  লঞ্চ মুখে শুরু মনির'রা শুরু করে দিয়েছিল মর্টারের পর মর্টার। এই কথা বলতে বলতেই , মনির জড়িয়ে ধরল আমায় । মনিরের হাওমাও কান্নায় লঞ্চ জুড়ে সবার চোখে তখন বহিছে আনন্দাশ্রু ! জীবন অনেক  সুন্দর ,  এ কারণেই বেঁচে থাকার ইচ্ছা মানুষের এত অদম্য !

দুপুর দুইটায় লঞ্চ ভিড়ল নারায়ণগঞ্জ ঘাটে , আত্মসমর্পণের চিত্র আর ক্যামেরায় ধারণ করা হল না আমাদের । বরাবরের মত পরাধীন ঢাকা'র   রাস্তা ধরে নয়, এই শহর এখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা । আমরা সবাই এসে পৌঁছলাম হোটেলে , হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল তখন নিউট্রাল জোন হিসাবে রেড-ক্রস অধীন । (সূত্র-৫)

ভারতের বিমানবাহিনী হামলায় পাকিস্তানের প্রতিরোধের অন্যতম কেন্দ্র গভর্নর হাউসের দরবার হল।

বধ্যভূমি দর্শন ও মুজিব পরিবারের মুক্তি

পরের দিন ১৭ই ডিসেম্বর ভোরে , ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং আমাদের রায়ের বাজার বধ্যভূমি পরিদর্শনের কথা বললেন । হলিডে ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান , যিনি ছিলেন রাশেদখান মেননের বড় ভাই , তিনি আমাদেরকে  তার গাড়ী দিয়ে  নিয়ে গেলেন রায়ের বাজার। সেখানে যে বীভৎস নারকীয় পৈশাচিক হিংস্রতা ও বর্বরতার দৃশ্য আমি দেখলাম তা অকল্পনীয় !  মৃত লাশগুলো এখানে ওখানে বিক্ষিপ্ত ! লাশের পচা গন্ধে ভারী বাতাসে , চলছে  শকুনে কুকুরে  টানাটানি আর মারামারি । খাদে নেমে  মৃত দেহের ছবি তুলছি , অনতি দূরে নজরে  আসলো -ইটের গর্তের ভেতরে একজন মহিলার বিকৃত শবদেহ , পরে জেনেছিলাম তিনি ছিলেন সাংবাদিক সেলিনা পারভিন। সকল আনন্দ অনুভূতি ফিকে হয়ে গেল। খবর পেলাম , বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন মুজিবের পরিবার । রায়ের বাজার থেকে সাথে চলে আসলাম ধানমন্ডি । মুজিবপত্নী'র সাথে কিছু কথা হল,  সেটি টেপে ধারণ করে ফিরে আসলাম।  (সূত্র-৬)

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী'র আগরতলা শরনার্থী শিবির পরিদর্শন।

বেগম মুজিবের সাথে রবীন সেনগুপ্ত'র কথোপকথন

২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে গবেষণার কাজে ত্রিপুরা গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক , চৌধুরী শহীদ কাদের । তিনি আগরতলায় যেয়ে সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত'র সাথে দেখা করেন । বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মূলত আড়ালে থাকতেই স্বাছন্দ্য বোধ করতেন, বিয়ের পর স্বামী সংসার আর পরিজন নিয়ে ছিল তাঁর দুনিয়া। এবং এভাবেই শেখমুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ,বঙ্গবন্ধু  হয়ে গেছিলেন জাতির পিতা।

সেটি ছিল খুবই স্বল্প সময়ের কিছু কথাবার্তা , ফরমাল কোন ইন্টারভিও নয় এবং পুরনো হয়ে যাওয়া সেই টেপের অনেক কথাই ছিল অস্পষ্ট। ২০১৪ জুলাই'র শেষে দেশে ফিরে চৌধুরী শহীদ কাদের , জনকণ্ঠ পত্রিকায় সেই 'কথোপকথন' অংশটুকু প্রথম বারের কাগজে কলমে  প্রকাশ করেন।

সিলেট সেক্টরে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন বাহিনী ।

শ্রী সেনগুপ্ত বেগম মুজিবের কাছে প্রথমেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা জানতে চেয়েছিলেন।

উত্তরে বেগম মুজিব বলেনঃ

২৫ তারিখ রাতে মিলিটারিরা বাসায় এসে ঘেরাও করল আর গুলি চালানো শুরু করল।  শেখ সাহেব তখন শোওয়া ছিল। গুলির আওয়াজে শেখ সাহেব, আমি ও আমার ছোট ছেলে, তাড়াতাড়ি করে বাথরুমের ভেতরে চলে যাই। ওরা যখন আসছে, তখন প্রথম থেকেই ওরা গুলি করতে করতে আসছে। জানালা খোলা ছিল। আমি জানালা বন্ধ করতে গেছি। জানালা বন্ধ করতে যখন গেছি তখন দেখি পাশের বাড়িতে মিলিটারি ঢুকছে। ওটা দেখে আমি তাড়াতাড়ি করে শেখ সাহেবেরে ডাক দিই যে মিলিটারি আসছে।

শেখ সাহেব জিজ্ঞেস করল , কি করে জান তুমি? আমি বললাম, হ্যাঁ, মিলিটারি আসছে।

এর ভেতরে আমি মিলিটারির আওয়াজ শুনতে পাই।  'জোয়ান পজিশন নাও'। যে সময়ে এই কথা বলছে, আমার ছেলে তখন অন্য ঘরে শোয়াছিল।  আমি তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে, মেজ ছেলেরে নিয়ে আসি। আমি দরজা বন্ধ করতে পারি নাই। এর ভেতরে ওপর নিচে সব জায়গার শুধু গুলির আওয়াজ। শেখ সাহেব বাথরুম থেকে বের হয়ে ওদের বলল গুলি বন্ধ কর। গুলি বন্ধ কর। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি।

তারা এত গুলি করেছে যে, আমাদের ভেতরে কথা কিছুই তারা শুনতে পায়নি। আমার ছোট একটি ছেলে আছে (রাসেল)। ওই ছেলেটা খুব ভয় পেয়ে গেছে ও খুব কান্নাকাটি করছে। ওরে আমি ঘরের ভেতরে আনতে পারি নাই। ও অন্য ঘরে শোয়াছিল। তারা ছেলেটাকে বলল, তুমি আম্মার কাছে যাও।

এর ভেতরে শেখ সাহেব চিৎকার করে বলল 'স্টপ ফায়ারিং।' এই কথা বলার পর গুলি করা বন্ধ হয়ে গেল।

এর আগে আমার বেডরুমের ভেতরে অনেক গুলি করা হয়েছে।

তারপর শেখ সাহেব বাইরে বের হয়ে আসল। আসার পর বলল, তোমাদের এখানে বড় অফিসার কেউ আসছে?

ওরা কি বলল আমি আর শুনতে পাই নাই। আমি তখন ভেতরের রুমে বসা আছি। তারপর শেখ সাহেব ওদের সঙ্গে নিচে চলে গেল। নিচে গিয়ে একটু পর উপরে উঠে আসল। একজন বোধহয় কর্নেল, একজন মেজর, দুই জন সিপাহি উনার সঙ্গে উপরে আসল। উপরে এসে কামালকে বলল আমার বিড়ি আর স্যুটকেসটা দাও।

তাড়াতাড়ি করে আমি আর কামাল জামা কাপড় রেডি করে দিলাম।

শেখ সাহেব কর্নেল কে বলল, 'আপনারা আমাকে ফোন করলেই তো পারতেন এভাবে গুলি চালানোর কি উদ্দেশ্য?'

যখন শেখ সাহেবকে নিচে নিয়ে যায়, তখন কর্নেল এসে মেজ ছেলেকে বলল, 'তোমার বাবারে নিয়ে যাচ্ছি আমি খুব দুঃখিত।' মেজ ছেলে খুব রাগ করল। শেখ সাহেব বলল এদের সঙ্গে আর কথা বলে কি হবে !

রবীন সেনগুপ্ত বেগম মুজিবকে আরও জিজ্ঞেস করেছিলেন -'শেখ সাহেব আপনাকে সর্বশেষ কি বলে গিয়েছিলেন?'

এর উত্তরে বেগম মুজিব বলেছিলেনঃ

এখানে যদি তুমি ভালভাবে থাকতে না পার, দেশের বাড়িতে চলে যেও। এরা (ছেলেমেয়ে) থাকলে এদের ভালভাবে লেখাপড়া শিখাবে। এই একটি মাত্রই কথা, ছেলেমেয়ে থাকলে ওদেরকেই মানুষ করবা।  আর কোন কথা বলেনি।

এর পর তিনি নয় মাসের আতঙ্কের দু'-একটি কথা বলেন, টেপে যার কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা বোঝা যায় না। তবে, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

আগরতলা জিবি হাসাপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে মার্কিন সিনেটার এডোয়ার্ড কেনেডি।

রবীন সেনগুপ্ত ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে দেখতেন অসহায় মানুষ গুলোর বেঁচে থাকার কী নিদারুণ আকুতি ! তাদের বেঁচে থাকার মূল অর্থ এবং একমাত্র  উদ্দেশ্য ছিল -সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা  স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যাবে তারা- তাদের ছিল এত এত কষ্ট,  তবুও তাদের বুকে ছিল নতুন একটি স্বাধীন দেশ পাবার নিদারুণ প্রত্যাশা !

ইন্দিরা গান্ধী, এডওয়ার্ড কেনেডিসহ অনেক বিদেশি সংস্থা'র কর্মকর্তারা  শরনার্থী শিবির পরিদর্শনকালে , তাদের সাথে থাকতেন  রবীন সেনগুপ্ত । গেরিলা বাহিনীর ট্রেনিং , ট্যাঙ্ক তাক করা পাকি ফৌজ , একের পর মর্টার শেল , ভয়াবহ সব অপারেশন ! মাইন পোতা মাঠ , ফায়ারিং আর মৃত্যু উপেক্ষা করে চষে বেড়িয়েছিলেন  বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর তাকে 'মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু সম্মাননা' পদকে ভূষিত করে।

রবীন সেনগুপ্ত'কে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

কৃতজ্ঞতাঃ  মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ , রবীন সেনগুপ্তের গ্রন্থ ও ছবি

সূত্র-১ : কপি পেস্ট , রবীন সেনগুপ্তের 'চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ'  গ্রন্থ থেকে, পৃষ্ঠা ১০।

সূত্র-২ : কপি পেস্ট , রবীন সেনগুপ্তের 'চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ'  গ্রন্থ থেকে, পৃষ্ঠা ৯  ।

সূত্র-৩ : কপি পেস্ট , রবীন সেনগুপ্তের 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা কিছু স্মৃতি কিছু কথা'  গ্রন্থ থেকে, পৃষ্ঠা  ৫৯।

সূত্র-৪, ৫ ও ৬ :  ছায়া অনুসারে , রবীন সেনগুপ্তের 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা কিছু স্মৃতি কিছু কথা'  গ্রন্থ থেকে, পৃষ্ঠা যথাক্রমে ৫৮, ৬২-৬৫ ও ৬৬-৬৮।

*শহীদ বেগম মুজিবের অপ্রকাশিত একটি সাক্ষাতকার , জনকন্ঠ পত্রিকা , লেখকঃ চৌধুরী শহীদ কাদের