কাদম্বিনী ফ্লাইওভার তলে মরিয়া প্রমাণ করিল, সে বাঁচিয়া ছিল

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 14 March 2017, 07:32 PM
Updated : 14 March 2017, 07:32 PM

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে গল্পটি পড়ি নি কিন্তু সারমর্ম জানি, তার সংক্ষিপ্তরূপ ঃ

'জীবিত অথবা মৃত' 

রানীহাটের জমিদার শারদাশংকর বাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না,  সকলেই একে একে মারা গিয়াছে। পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই । একদিন শ্রাবণের রাত্রে সেই কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল। চারিজন ব্রাহ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ দাহ করিতে লইয়া গেল।  রানীহাটের শ্মশান লোকালয় হইতে বহুদূরে । শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি। থম্‌থমে মেঘ করিয়া আছে, আকাশে একটি তারা দেখা যায় না, কোথাও কিছু শব্দ নাই-কেবল পুষ্করিণীতীর হইতে অবিশ্রাম ঝিল্লি এবং ভেকের ডাক শুনা যাইতেছে । এমন সময়ে মনে হইল যেন খাটটা ঈষৎ নড়িল- যেন মৃতদেহ পাশ ফিরিয়া শুইল। বিধু এবং বনমালী এক মুহূর্তে ঘর হইতে লম্ফ দিয়া বাহির হইয়া গ্রামের অভিমুখে দৌড় দিল।

সকলেই জানেন, জীবনের যখন কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না তখনো অনেক সময় জীবন প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, এবং সময়মতো পুনর্বার মৃতবৎ দেহে তাহার কার্য আরম্ভ হয়। কাদম্বিনীও মরে নাই-হঠাৎ কী কারণে তাহার জীবনের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। যখন সে সচেতন হইয়া উঠিল, দেখিল, চতুর্দিকে নিবিড় অন্ধকার। চিরাভ্যাসমতো যেখানে শয়ন করিয়া থাকে, মনে হইল, এটা সে জায়গা নহে। একবার ডাকিল 'দিদি'- অন্ধকার ঘরে কেহ সাড়া দিল না। সভয়ে উঠিয়া বসিল, মনে পড়িল সেই মৃত্যুশয্যার কথা।

শারদাশংকর বাবু জোড়হস্তে কাদম্বিনীকে কহিলেন, 'ছোটোবউমা, এই কি তোমার উচিত হয় ! যখন সংসার হইতে বিদায় লইয়াছ তখন এ মায়াবন্ধন ছিঁড়িয়া যাও- আমরা তোমার যথোচিত সৎকার করিব। তখন কাদম্বিনী আর সহিতে পারিল না, তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, 'ওগো, আমি মরি নাই গো, মরি নাই। আমি কেমন করিয়া তোমাদের বুঝাইব, আমি মরি নাই। এই দেখো, আমি বাঁচিয়া আছি।' বলিয়া চীৎকার করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর জলের মধ্যে গিয়া পড়িল। শারদাশংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস্‌ করিয়া একটা শব্দ হইল।

গল্পের শেষ লাইনটি ছিল-

'কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই'

নির্মাণাধীন মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার ভূপাতিত হয়ে দুর্ঘটনা ও মানবমৃত্যু'র সাথে কবি গুরুর শেষ লাইনটির একটি সুনিবিড় ও গভীর সম্পর্ক আছে । আসুন আমরা চেষ্টা করে দেখি এই সুনিবিড় ও গভীর সম্পর্কটি আমরা স্থাপন  স্থাপন করতে পারি কিনা।

 "নিয়ম না মানা আর গাফিলতিতে ফ্লাইওভার দুর্ঘটনা"

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীঃ  প্রতিটি বড় প্রকল্পেই হেলথ অ্যান্ড সিকিউরিটি ম্যানুয়াল থাকে। চুক্তিপত্রে লেখা থাকে, প্রকল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং আশপাশের লোকজনের নিরাপত্তা কীভাবে বিধান করবে। আমাদের বিল্ডিং কোডেও বলা আছে, সেফটির জন্য কী করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো পালন করা হয় না, প্রকল্পে কাজ করার সময় এগুলো ঠিকাদাররাও মানে না। কারণ তাদেরকে বাধ্য করা হয় না। কনট্রাকটরকে ফোর্স করতে হবে। এগুলো না মানলে আমি কাজ করতে দেব না- এটা বলতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে।

আইইবি, চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদারঃ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না। দুর্ঘটনার পর তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। ঠিকাদাররা স্বাভাবিকভাবেই ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়োগকারী সংস্থাগুলো রাজউক, সিডিএ কিংবা এলজিইডি- সরকারি সব সংস্থার মধ্যেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এ কারণেই নিরাপত্তার ফাঁকফোকর গুলো বড় হতে থাকে। এই ফাঁক দিয়েই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। বড় প্রকল্প গুলোয় 'সেফটি রেকর্ড' রাখা জরুরি। সেফটি রেকর্ড দেখে প্রতি সপ্তাহে ব্যবস্থা নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু আমাদের এখানে কোথাও সে প্রক্রিয়া পালন করা হচ্ছে না । আমি কয়েকবার ওই ফ্লাইওভার নির্মাণ এলাকায় গিয়েছি। আমি দেখেছি, নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। উপরে কাজ করার সময় সতর্কীকরণের জন্য নিচে কোন সাইন থাকে না, কোন মানুষ থাকে না। এমনকি যারা উপরে কাজ করছিল, তাদেরও সেফটি শু, সেফটি হেলমেট, বেল্ট পড়তে দেখিনি।

ঠিকাদার "তমা কনস্ট্রাকশন"- এর পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়াঃ মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো । ঝুঁকি এড়াতে রাত ১২টার পর রাস্তা বন্ধ করে গার্ডার উঠানো হয়। পুরো রাস্তা বন্ধ করেই গার্ডার তোলা হয়, যেন তা পড়ে গেলেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি না ঘটে। রোববার রাতেও সেভাবেই কাজ করা হচ্ছিল। কিন্তু যে লোকটা মারা গেছে, সে কীভাবে এখানে এসে পড়ল? সেটা নাকি কেউ দেখেনি, কেউ টেরই পায়নি ! দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া ছিল। এটা খুব ক্রিটিকাল কাজ। এজন্য এখানে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার, এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারসহ সবাই ছিল। সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছিল কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা তো প্রায় ১২ থেকে ১৪শ গার্ডার নিরাপদে উঠাইলাম। আসলে কীভাবে দুর্ঘটনা কখন ঘটে, কেউ জানে না। এটা আগে তোলা হয়েছিল, বসানো গার্ডার, এটা পড়ে যাওয়ার কথা না। এখন কেন পড়লো, আমরা তা বুঝতে পারছি না।

প্রকল্প পরিচালক নাজমুল আলম এবং এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শ্যামা প্রসাদ অধিকারীঃ ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং । অর্থাৎ মোবাইলে কল করা হয়েছে দুজনের কেউই ফোন ধরেননি।

বিশেষজ্ঞ ও ঠিকাদার বক্তব্য সারাংশঃ

বিশেষজ্ঞ: নির্মাণ কাজে সেফটি কোড মেনে চলবার বিধান'গুলো শুধু কাগজে কলমেই আছে, বাস্তবে এসব মেনে না চলাটাই এখন প্রচলিত রীতি। ঠিকাদার কে এই বিষয়ে যাদের ফোর্স করার কথা , তারা তা করছেন না , অর্থাৎ সরকারের নিয়োগকারী সংস্থা সমূহ নিরাপত্তার বিষয়'টি আমলে নিচ্ছেন না । সেফটি রেকর্ড বুক মেন্টেন করা এবং প্রতি সপ্তাহে রেকর্ডবুক পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন প্রক্রিয়া চালু নেই। নির্মাণ শ্রমিক'রা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করছেন সেফটি বেল্ট , জুতা ছাড়াই। প্রকল্প এলাকা নিরাপত্তার বিষয়টি আদতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ দিচ্ছেন না কেউই।

ঠিকাদার: শুধুমাত্র নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই গভীর রাতে রাস্তা বন্ধ করে গার্ডার তোলা হয় । সরকারী সংস্থার যৌথ তত্ত্বাবধানেই কাজটি করা হয়েছে । এই পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার গার্ডার কোন রূপ আওয়াজ ছাড়াই  তোলা হয়েছে। পতিত গার্ডারটি আগে থেকেই বসানো ছিল , কেমন করে সেটি পড়ে গেল – তা এক বিরাট রহস্য ! নীচে তখন সাধারণ পথচারী কারো থাকবার নয়, কিন্তু কেমন করে 'তার মরিবার জাগিয়াছিল সাধ'  -তা বিরাট রহস্যের চাইতেও অধিক রহস্যময় !

ঠাকুমার ঝুলি

ছোটবেলায় ঠাকুমা যখন তাঁর ঝুলি থেকে গল্প ডাওনলোড দিয়ে বসতেন, রাক্ষস-খোক্কস, অমরাবতী রাজকন্যা ও অপারগর অনেক গল্প,  সেখানে  একটি গল্প ছিল খুবই কমন,  যা আমাদের অনেক বার শোনা।

প্রমত্ত পদ্মার উপর ব্রিজ নির্মাণ করতে যেয়ে বৃটিশদের তখন রীতিমত ঘাম ছুটে যাওয়ার মত অবস্থা! সেখানে ছিল ইয়া বড় বড় ষোল'টি খুঁটি, তার উপর নির্মাণ করতে হবে একে একে পনেরটি পাটাতন। দিনের বেলা বৃটিশরা  ব্রিজে পাটাতন বসিয়ে বাড়ি যেতেন, কিন্তু নিশুতি রাত্রিবেলায় সেই পাটাতন ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যেতো নদী গর্ভে । সকালে তারা এসে দেখতেন ব্রিজ পুরাই পাটাতন শূন্য।  দেশ বিদেশের অনেক বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার এসেও এর কোন কূল কিনারা করতে পারছিলেন না। অথচ মাল মেটেরিয়েলসেও কোন দুই নম্বরী কিন্তু ছিল না এবং ব্রিজের নির্মাণ পদ্ধতিও ছিল একশতে একশ।  এইরূপ অলৌকিক বিপর্যয়ে ব্রিটিশদের মাথার তার ছিঁড়ে গেল, সবার তখন পাগল পাগল অবস্থা ! এমতাবস্থায় এক রাতে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড মিস্টার হার্ডিঞ্জের স্ত্রী স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন- যত বিদেশী হাই-টেক কারিগরিই করা হোক না কেন, তাতে কোন কাজ হবে নাকো। এর একমাত্র সমাধান, পাটাতন প্রতি এক জোড়া শিশু মা' পদ্মাবতী'র নামে দিতে হবে বলি । দেবী পদ্মাবতী তৃপ্ত হলেই , কাম সাড়া , কেন  টেনশন নেও খালি খালি!

পরদিন বৃটিশ'রা মিটিং করলেন, পনেরটি পাটাতনে মাত্র পনের জোড়া শিশু, এ এমন আর কী! আর এভাবেই তিরিশটি প্রাণের বিনিময়ে আজকের এই হার্ডিঞ্জ সেতু। অবশ্য রক্ত-খেকো সেদিনের প্রমত্তা  পদ্মা এখন শুকায়ে সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনের চাইতেও অধিক ক্ষীণকায় – কপালে'র লিখন বলে কথা!

ঠাকুমা'র গল্পের তথ্য সমূহ বিবেচনা করলে, শত বৎসর অধিক সময় পর ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বদ্দারহাট ঘটনা অতি সামান্যই বটে! সেদিন  ফ্লাই-ওভারের জন্য  মা চট্টেশ্বরী খেয়ে নিয়েছিলেন মাত্র আনলাকি থার্টিন সংখ্যক প্রাণ! এই সস্তার বাজারে, সংখ্যায় তা ছিল বড্ড অপ্রতুল!  আর সেই ঘটনার পাঁচবছর পর, আজ ২০১৭ সালে এসে মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের জন্য মা ঢাকেশ্বরী'র কপালে জুটেছে মাত্র ১ জন! একবার ভেবে দেখুন – যে  ঢাকা শহরে লক্ষ লক্ষ মানব ঘোরে কিংবা বেঘোরে করে রাত্রি যাপন কিংবা আরাম-আয়েশে সুখ- দুঃখে  জীবন করে উদযাপন, ফুটপাত এবং রাস্তায়। সেই ঢাকা, দেশের রাজধানী বলে কথা, সেখানে ঢাকেশ্বরী মায়ের ভোগে একটি মাত্র মানব বডি!  এ যে মায়ের জন্য অনেক বড় লজ্জা! এ যে মায়ের অনেক বড় অপমান!

উন্নত বিশ্বে অধিক উচ্চতায় কাজের করতে গেলে শ্রমিকের জন্য থাকে নিরাপদ নির্মাণ কাঠামো, বৃহৎ আকারের ক্রেন । নির্মাণ সহযোগী যানবাহনে চড়ে শ্রমিকরা সেখানে কাজ করেন। আমাদের জানা উচিত সেখানে নির্মাণ কাজে 'সেফটি' ইস্যুটি অন্যতম প্রধান বিবেচনা। শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের  জীবন রক্ষায় গৃহীত হয় 'জিরো টলারেন্স' নীতি । সেখানে নিরাপত্তা সুবিধা প্রণয়নের জন্য , যে খরচ করা হয় বা ধরা হয় তা -তা এই দেশে আমাদের কাছে রীতিমত এক অকল্পনীয় ব্যাপার ! কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের কাজের রিস্ক ফ্যাক্টরের উপর ধার্য হয় তার তার মজুরী । যমুনা ব্রিজ নির্মাণে তৎকালীন কোরিয়ান সাধারণ রড ওয়েল্ডারদের বেতন আমরা দেখেছি  প্রকল্প পরিচালকের চাইতেও তা  ছিল অনেক বেশী । অথচ বঙ্গদেশে একজন নির্মাণ শ্রমিক যখন প্রায় ২৫ খানা ইট যার ওজন প্রায় ৯০ কেজি , একত্রে মাথায় নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে একটি স্থাপনার ছয় তলায় নামিয়ে দেন -তখন তাঁর শ্রমের মূল্য দাঁড়ায় ইট প্রতি সর্বোচ্চ আশি পয়সা । এভাবে অরক্ষিত অবস্থায়, রেলিং বিহীন নির্মাণাধীন স্থাপনায় ৭০-৯০ কেজি নির্মাণ সামগ্রী মাথায় নিয়ে -দ্রুততম সময়ে আপ-ডাওন করার এই কাজটিতে ক্ষণিকের ভুলেই ঘটে যেতে পারে তাঁর মৃত্যু ! আপনি মিস্টার বাড়ির মালিক , কিংবা মহামান্য ঠিকাদার কিংবা অতি মহামান্য প্রকৌশলী – বলেন তো সেই শ্রমিকের জীবনের দাম সর্ব সাকুল্যে আপনি ধরেছেন কত ? অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে আপনি ইতোমধ্যে জেনে গেছেন এর উত্তর খুব সহজ –আল্লাহ্‌র মাল আল্লাহ্‌ নিয়া গেছে ! কপালে মৃত্যু লেখা ছিল, আমাদের আর করিবার কী ছিল!

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টি, যেহেতু তার নামের আগে সিভিল শব্দটি আছে তাই -এই মুহূর্তে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বিশ কোটি হলে, আমরা ধরতেই পারি- দেশের সক্কলেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । ধরা যাক সংখ্যায় তা পনের কোটি, এই পনের কোটি থেকে সাকুল্যে পনেরজন জন ইঞ্জিনিয়ার সেফটি কী জিনিস – খাইতে হয় না পিন্দিতে হয়, জানেন না ঠিকঠাক ! পনের'র সাথে আমি যোগে মোট ষোলজন যদি ধরি , আমরা জানি 'সেফটি' মানে -মাথায় থাকতে হবে একটি লোক দেখানো হেলমেট আর কোমরে থাকতে হবে নামকাওয়াস্তে একখান  বেল্ট । আমরা জানি এই দুইটি জিনিস থাকিবার নাম- শ্রমিকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা । অথচ আধুনিক নির্মাণে হেলমেট এবং বেল্ট পরিধান অনিবার্য কিন্তু তাকে সর্বনিম্ন নিরাপত্তা সহযোগী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।  নীচে হাজার হাজার  ট্রাফিক সাথে যানবাহন  চলমান -তার উপরে ফ্লাইওভার ক্রমশ বহমান , এই রকম কাজের জন্য 'মাত্রাতিরিক্ত' নিরাপত্তা গ্রহণ অবশ্য কর্তব্য। নিরাপত্তার 'মাত্রা' নিয়েই মাথা ঘামানোর টাইম নাই -সেখানে আবার  'মাত্রাতিরিক্ত' নিরাপত্তা –হা হা হা, মানে এমনি এমনিই হচ্ছে না তার উপর আবার ত্যানা পেঁচানোর কাহিনী !

 নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা  দুর্ঘটনার দুই দিন পরের ছবি।

অথচ এই মালিবাগ মৌচাক ফ্লাইওভারের কাজটি কিন্তু অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা! কিন্তু মন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ এখনও একের পর এক নতুন নতুন ডেডলাইন দিয়েই যাচ্ছেন ! এই জাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে 'সময়' একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা । যোগাযোগ মন্ত্রীসহ সরকারের রথীমহারথীরা যখন প্রকল্প ভিজিটে আসেন -সে কী উৎসব উৎসব সাজ ! সাথে থাকে বড় মাঝারি পাতি নেতা সহ বিশাল সাংবাদিকের বহর ! টিভিতে দৃশ্যমান হয় খবর , নেতা বলছেন-

মালিবাগ পুস্পবনে আমরা কিন্তু মৌচাক হইতে  মধু আহরণ করিতে আসি নাই । কোন প্রকারেই কর্মে কোনরূপ গাফিলতি আমরা বরদাস্ত করিব না , নেভার এভার । এটা মন চাইল  খেলিব না , দিয়া দিলাম ওয়াকওভার -মোটেই তাহা  নয় , মনে রাখিবেন ইহার নাম  ফ্লাইওভার । আগামী ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নিজভূমে ফিরে আসিবার দিন , উহার আগেই শেষ করিয়া দিন । আদারওয়াইজ আছেন এখানে যাহারা, বলিয়া গেলাম নো ওয়ে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ জানানো ছাড়া ! সেটি ছিল ২০১৪ সালের ঘটনা। তারপর অনেকবার বলা হয়েছে বাই হক্কু অর বাই ক্রুক্কু ২০১৬ ডিসেম্বরে তা হবেই হবে ! আমজনতা এখন আর জানতে আগ্রহী নয় তা ২০১৭ না ২০১৮ না ১৯ ।

শ্রমিকের শ্রমের সর্বোচ্চ মূল্য যখন মৃত্যু, তখন ফ্লাইওভারের তলায় পিষ্ট হয়ে আমজনতা কিংবা কুকুর যাহাই মরুক -তাহার আর এমন কীবা দাম? তাছাড়া রাত গভীর হলে কি হয় না হয়, কে নেয় তার খোঁজ! যেহেতু শুধু মৃত্যু হলেই খবরের নাম নিউজ; অতঃপর আমরাও জেনে যাই -আমজনতা বেহুদাই মরতে গিয়েছিল সেখানে। হায়রে! বদনাম দিয়ে সে কিনে নেয় মৃত্যু!

এই কাজে কম নিরাপত্তা, অধিক জনতার দুর্ভোগ ছাড়াও আরও একটি ব্যাপার অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে ভারী নির্মাণ যন্ত্রপাতি সমূহের সহজলভ্যতা। একজন ঠিকাদার যখন এক সাথে অনেক কাজে নিযুক্ত হন, তখন দুই তিন সেট যন্ত্রপাতি দিয়েই তিনি সবকাজ সম্পন্ন করার পাঁয়তারায়  নিয়োজিত হন। তাতে আলটিমেটলি নির্মাণ কাজে লেগে যায় প্রচুর সময়।  প্রকল্প এলাকায় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা এবং সেফটি কোড মেনে না চলার কারণে, ইতোপূর্বে সরকারী সংস্থা ঠিকাদারকে ওয়ার্নিং, থ্রেটেনিং, সান্টিং, হুমকি-ধামকি কিংবা জরিমানা করেছিলেন কিনা, তা আমাদের জানা নেই । তবে এতটুকু জানা গেছে,  দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার দুই দিন পরেও, ঠিকাদার কোম্পানি 'তমা কনস্ট্রাকশন' কিন্তু কাজ করে চলছে এখনও আগেরই মত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সংবাদ দাতা সাইট ঘুরে এসে রিপোর্ট করেছেন, ফ্লাইওভারের নির্মাণাধীন এলাকায়  লোহার রড, গার্ডারসহ নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে  আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনি। ফ্লাইওভারের যেসব অংশে গার্ডার বসানোর কাজ চলছে সেখানে নিচে কোন নিরাপত্তা বেষ্টনি নেই; নেই  পথচারীদের কোনো সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড । কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকায় এই ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণযজ্ঞের মধ্য দিয়ে চলছে জন সাধারণের চলাচল।

মোদ্দা কথা আমজনতা কিংবা স্বপন নামীয় সেই পথচারীটি  -গার্ডার তলে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে মৃত্যু বরণ করিলেই, কেবল আমরা জানিতে পারি, এতদিন স্বপন  বাঁচিয়া ছিল এবং এইমাত্র সে মরিয়া গেল। তাই মরিবার পর আমাদের স্বীকার না করিবার কোন উপায় থাকে না, এতদিন ঢাকা শহরে তাহার  বাঁচিয়া থাকিবার ঘটনাটি ছিল তাহার প্রতি রাষ্ট্র এবং নগরের এক অসীম দয়া!

অতএব আমরা এখন নিশ্চয় বলিতে পারি 'কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে বাঁচিয়া ছিল'