গণহত্যা ও নির্যাতন: গল্প উপন্যাসে নয়, লেখা আছে যুদ্ধ দলিলে

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 24 March 2017, 06:05 PM
Updated : 24 March 2017, 06:05 PM

অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে চাই। কোথা থেকে শুরু করবো?  খেয়াল রাখতে হবে যে, ইতিহাস-আশ্রয়ী গল্প/উপন্যাস/কবিতা সুখপাঠ্য হলেও কখনই যেন তা ইতিহাসের 'রেফারেন্স' হিসেবে না-আসে। ইতিহাস নির্ভর ফিকশন বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সাহিত্যমাধ্যম। তবে বাইরের দেশে সে সকল বইয়ের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করা থাকে যে, এটা নিছকই একটা 'ফিকশন', একে ইতিহাসের 'রেফারেন্স' হিসেবে উল্লেখ করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশের আমজনতা একথা বুঝতে চান না। উনাদের কাছে শাহাদুজ্জামানের 'ক্রাচের কর্নেল' কিংবা হুমায়ূন আহমেদের 'দেয়াল' বা 'জোছনা ও জননীর গল্প' মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক একটি উল্লেখযোগ্য রেফারেন্স মাধ্যম, যা সর্বাংশে ভুল!  এক্ষেত্রে প্রথম বিবেচনা হতে পারে, তথ্য মন্ত্রণালয় হতে প্রকাশিত এবং হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র' শীর্ষক সংকলনটির নাম। '৭২ সালে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টেশন শুরু করেন। পরবর্তীতে '৭৭ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান পুরোদমে এই প্রজেক্ট হাতে নেন। '৮২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে দলিলপত্রের ফার্স্ট প্রিন্ট প্রকাশিত হয়। '০৩ সালে চারদলীয় আমলে হয় পুনর্মুদ্রণ । আবার '০৯ সালে মহাজোট আমলে হয়েছে রিপ্রিন্ট ,তেমন কোন এডিটিং ছাড়াই! তাই এখানে রক্ষিত দলিল সমূহ  নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রাইমারি সোর্স হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র থেকে বলছি

'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র' অষ্টম খণ্ড, গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার , ঢাকা বিভাগ 

বদলু ডোমঃ আমি ১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ  মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে লাশ তুলেছি। কয়েকদিন পরে মিল-ব্যারাক পুলিশ লাইনের নদীর পাড় থেকে পনের জন যুবক, একজন সাধু ও বৃদ্ধার ক্ষতবিক্ষত, ফুলা, পচা লাশ তুলেছি। প্রতিটি লাশ চোখ ও হাত-পা বাঁধা ছিল। এরপর আমরা বাবুবাজার পুলের উপর থেকে এক অন্ধ ফকিরের লাশ তুলেছি। সদরঘাট, শ্যামবাজার, ওয়াজঘাট, বাদামতলী এলাকায় আমরা নদীর পাড় ও পানি থেকে বৃদ্ধা, যুবা ও শিশুর লাশ তুলেছি। কয়েকদিন পর আমরা মন্দিরের সামনে থেকে দুধওয়ালা সাধুর লাশ তুলেছি, শাঁখারিবাজার প্রবেশ করে মন্দিরের সামনের বাড়ীর ভেতর থেকে শিশু-কিশোর, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতীর দশটি পোকায় খাওয়া গলিত লাশ নিয়ে এসেছি। কয়েকদিন পর রমনা কালীবাড়ি মন্দিরের ভেতর থেকে পাঁচটি এবং কালীবাড়ির প্রবেশ পথে দুটি চোখ ও হাত বাঁধা পচা লাশ তুলেছি। এরপর পাক সেনারা আমাদের নির্মমভাবে মারপিট করায় আমরা আর লাশ তুলতে যাই নাই।

চুন্নু ডোমঃ ২৮শে মার্চ , লাশ উঠাবার জন্য একটি ট্রাক প্রথমে আমাদের শাঁখারিবাজারে কোর্টের প্রবেশ পথে নামিয়ে দেয়। ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকের যে পথ  শাঁখারিবাজারের দিকে চলে গেছে, সে রাস্তার দু'ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোরের বহু পচা লাশ। লাশগুলো  পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, শাঁখারিবাজারের দুদিকের ঘরবাড়ীতে আগুন, সেখানে অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ, অদূরে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনারা প্রহরায় । একটি ঘরে শিশু সহ ১২ জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। সেই সব মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের উচ্ছৃঙ্খল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। এক অসহায় বৃদ্ধা চিৎকার করে "পানি পানি" বলছিলেন , আমি পানি দিতে গিয়েও ভয়ে ফিরে এসেছি। শাঁখারিবাজার থেকে এভাবে প্রতিবার একশত করে তিন বারে  তিনশত লাশ ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি। ২৯শে মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড , বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে লাশ তুলেছি । লাশ পচে ফুলে যাবার কারণে লোহার কাঁটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমি এবং বদলু ডোম লাশ ঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি, আর গণেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁঝরা ছিল, মেয়েদের লাশের কারো কারো স্তন ছিল না,  যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা।  যুবতী মেয়েদের যোনিপথে এবং পিছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল কিন্তু তাদের খোঁপা বাধা ছিল ঘন চুলে।

ছোটন ডোমঃ ২৮শে মার্চ সকালে, আমাদের ট্রাক ইংলিশ রোডের মুখে রায়সাহেব বাজার হয়ে গোয়ালনগরের স্কুল ও মন্দিরের সম্মুখে থামানো হয়। মন্দিরের ভেতরে চৌদ্দ বছরের ফুটফুটে ছেলেটির হাত বাঁধা। পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে , তাজা রক্ত ঝরছে অঝোরে। সদ্য মৃত শরীর পরম আদরে গাড়িতে তুলতে গিয়ে আমার হৃদয় যেন কেঁপে উঠলো, আমি চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না, কাঁদতে শুরু করে দিলাম। এভাবে অনেক লাশ তুলে ধলপুর ময়লার ডিপোতে গিয়ে দেখলাম- বড় বড় গর্ত করে কুলিরা বসে আছে- ট্রাক থামিয়ে আমরা সব লাশ গর্তে ঢেলে দিলাম, কুলিরা মাটি ফেলে গর্ত বন্ধ করে দিল। আর এভাবে লাশ তুলে তুলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন আমি আর কাজে যাইনি।

গণহত্যা নিয়ে মনগড়া কাহিনী লিখলাম না । আপনাদের অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এক গল্পের নাম, গল্প নয়  মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানতে পড়ুন  যুদ্ধদলিল , সূত্রঃ  গণহত্যা ও নির্যাতন