প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের “শিক্ষা বানিজ্য” এবং তাদের কীর্তিকলাপের কিছু নমুনা

হারুন
Published : 5 August 2011, 06:21 PM
Updated : 5 August 2011, 06:21 PM

নামে-বেনামে কত প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে আমাদের এই দেশে আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের শিক্ষা মন্ত্রনালয় বা পরিসংখ্যান ব্যুরো দিতে পারবে কিনা এই নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।তবে এই সব পরিসংখ্যান নিয়ে আজকে আমার লেখা না,আমার লেখার বিষয় শিক্ষা বানিজ্য।এই দেশে বাণিজ্যের তো শেষ নেই।তার মধ্যে শিক্ষা বানিজ্য একটি।আজকে আমার এই লেখায় আমার দেখা এই সব বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যের কিছু নমুনা এবং তাদের কিছু কীর্তিকলাপ তুলে ধরার চেষ্টা করব।প্রথমে বলে রাখি এই সব প্রতিষ্ঠানে কারা চাকরী করে এবং কেন করে।

কারা করে?

১)ফ্রেশ গ্রাজুয়েট।
২)বয়স যাদের ৩০+।

কেন করে?

ফ্রেশ গ্রাজুয়েটরা পাস করে বের হয়েই একটা জবের জন্য পাগল হয়ে যাই,আবার ফ্রেশারদের জন্য তো আমাদের দেশে এভেইলেবল জব নাই আর সরকারী জব সে তো সোনার হরিন।তাই এই সব ফ্রেশ গ্রাজুয়েটরা হম্বিতম্বি খেয়ে ঐ সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে জব করে ।

আর বয়স যাদের ৩০+ তার তো (যদি কোন অভিজ্ঞতা না থাকে)একধরনের বাধ্য হয়ে এই সব প্রতিষ্ঠানে জব করে।তবে ৩০ দের সংখ্যা খুব বেশি হয়না। যদি একটা প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন শিক্ষক থাকে তবে তাদের মধ্যে ৫ জন হবে ৩০+। অন্যরা সবাই ফ্রেশার।

কাদের মালিকানায় এই সব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়?

এই সব প্রতিষ্ঠানের মালিক,অধ্যক্ষ,উপাধ্যক্ষ সবাই একই পরিবারের সদস্য হয় অথবা বিশেষ কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়।যে কারনে শিক্ষকগনের প্রতি সম্মানবোধ বা শ্রদ্ধাবোধের জায়গা ওদের ভিতরে থাকে না।থাকে শুধু ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি।শিক্ষকদের সাথে যখন তখন যা-তা আচরণ করতে ওদের দ্বিধাবোধ হয়না। শিক্ষকগণ যতদিন এইসব প্রতিষ্ঠানে জব করে ততদিন তারা চরম অসহায়ত্বে ভোগে।চরম অপমান সহ্য করে।ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে,অভিভাবকদের সামনে ঐসব ব্যবসায়ীরা মেধাবি,সত্য, একনিষ্ঠ ,ত্যাগী শিক্ষকদের অপমান করে।

এই সব ব্যবসায়ীদের অমানবিকতা এবং ব্ল্যাকমেইলিং এর কিছু নমুনা:

১) বিনা নোটিশে শিক্ষক বরখাস্ত!!

দুই ধরনের শিক্ষককে ওরা বরখাস্ত করে আর অন্যদের ভয়ের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে।

এক ধরনের শিক্ষক হচ্ছে যারা দীর্ঘদিন(৩ বছর প্লাস) ধরে ঐ সব প্রতিষ্টানে জব করে।এই ধরনের শিক্ষকদের বেতন সব মিলে ১০,০০০ প্লাস হয়।এখানে একটা কথা বলে রাখি,এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতি মাসে অথবা প্রতি ৬ মাস অন্তর ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা থাকে।এটা একটা অবশ্যই ভালো দিক।

কিন্তু এই ইনক্রিমেন্ট-ই এক সময় কাল হয়ে দাড়ায়।ঐ যে বললাম,বেতন যদি ১০,০০০ প্লাস হয় তখন আর ঐ সব হেডামছাড়াদের এতো টাকা একসাথে দিতে বুক আকুপাকু করে। হয়তবা তাই ১০,০০০ প্লাস কেতনধারী শিক্ষকদের অধ্যক্ষের রূমে ঢেকে নিয়ে বলে দেয়,"আগামীকাল থেকে আপনাকে আর আসতে হবেনা"

ঐ হতভাগা শিক্ষক ৫ মিনিট আগে ভাবতেও পারবেনা যে ঠিক ৫ মিনিট পরে তাকে এই রকম একটা সংবাদ শুনতে হবে। একবার ভাবুন,এই শিক্ষকের মনের অবস্থা তখন কি রকম হয়?
একটা প্রতিষ্ঠানে ৩ বছরের বেশি সময় ধরে জব করে এই রকম বিদায় কয় জনের ভাগ্য-ই বা ঘটে????????

আরেকধরনের শিক্ষক হচ্ছে যারা ফ্রেশ। হয়তবা কোন একদিন একজন শিক্ষকের ছুটি দরকার।
দরখাস্ত নিয়ে অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ এর পেছনে সারাদিন ঘুরল।
ছুটি পেলনা।বাধ্য হয়ে পরদিন সে প্রতিষ্ঠানে আসতে পারল না।
এর পরের দিন,আর কি।
"আগামীকাল থেকে আপনাকে আর আসতে হবেনা"
তার অপরাধ, কথার অবাধ্য হওয়া।
ব্যাপারটা যেন এই রকম।
"মালিক যখন যাহা বলিবে,কালবিলম্ব না করিয়া শিক্ষককে তাহা করিতে হইবে না হইলে গর্দান যাইবে"

২) টিচার্স রুমে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা!!

একটা টিচার্স রুম যেখানে শিক্ষকরা ক্লাস নেওয়ার ফাকে ফাকে একটু বসে।ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নোট তৈরি করে ।পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে।এইতো আর কী?
এখানে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার দরকারটা কী?
ঐ সব ব্যবসায়ীরা আসলে কি পর্যবেক্ষন করে?
কোন একজন শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের কোনো জিনিস চুরি করলো কিনা,শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রেমালাপ করছে কিনা নাকি ক্লাসে ঠিক সময়ে যাচ্ছে কিনা ?
যেটাই হোক , এসব আচরণ একজন শিক্ষকের জন্য চরম অপমানের নয় কী???

আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এই সব প্রতিষ্ঠান কি শিক্ষালয় নাকি কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান??

শুনেছি,কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নাকি মূল ফটকেও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো থাকে।
ধিক এই সব ব্যাবসায়ীদের যারা শিক্ষক সমাজকে সামান্য সম্মানটুকু দিতে শিখিনি।

এই সব ব্যবসায়ীদের শিক্ষকদের বেতনের টাকা ব্ল্যাকমেইল করার পদ্ধতি:

অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ নামের ব্যক্তিরা যদি কোনদিন দেখে যে,কোন একটা ক্লাস এর একজন ছাত্র কোন একটা বই আনেনি তবে তার জন্য ঐ বিষয় শিক্ষক পানিশম্যান্ট পাবে।
অথবা যদি দেখে যে,কোন একটা ক্লাসে হৈ-চৈ (ছাত্র-ছাত্রীদের লাউডলি পড়াকেও তারা হৈ-চৈ হিসাবে গন্য করে) হচ্ছে,তবে তার জন্যও পানিশম্যান্ট।
পানিশম্যান্ট এর জন্য তারা এম,এল এই ধরণের কিছু সংকেত ইউজ কর।

শিক্ষককের কোন একটা খুত পেলে তার নামে পাশে একটা এম বা এল বসিয়ে দিবে এবং মাস শেষে এই সব এম,এল এর সমীকরণ সাজিয়ে শিক্ষকদের বেতন কর্তন করে।
বেতন কর্তনের সমীকরণ:
১)একটা এম + একটা এল = একদিনের বেতন কর্তন।
২)তিনটা এল= একদিনের বেতন কর্তন।
৩)দুইটা এম = একদিনের বেতন কর্তন।
এভাবে দেখা যায় যে মাস শেষে একজন শিক্ষকের বেতন(যাদের মূল বেতন ৪০০০-৭০০০ টাকা) মূল বেতনের ২০%(মিনিমাম) ব্ল্যাকমেইল হয়ে যাই।

আরেকটা ব্যপার হচ্ছে,যদি কোন একজন শিক্ষককে তাৎক্ষনিক(কমপক্ষে ২ মাস আগে না জানিয়ে) চলে যেতে হয় তাহলে তাকে ঐ মাসের বেতনের(যে মাসে চলে যাবে) সমপরিমাণ টাকা দিয়ে যেতে হবে।আর এটা যদি করা না হয় তাহলে বিদায়ী শিক্ষককে তার সার্টিফিকেট ফেরত দিবে না,যেগুলো জয়েন করার সময় তাদের কাছে জমা রাখা হয়েছে।একজন শিক্ষক সারা মাস শ্রম দিয়ে যাওয়ার আগে তার বেতন টুকু নিয়ে যেতে পারবেনা।এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে।

পরিপূর্ণ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়।যা একজন শিক্ষক তথা শিক্ষক সমাজের জন্য চরম অপমানজনক।
আর আমাদের দেশের আইন তো আছে, যা ব্যবহার করে শিক্ষকগনকে নতমস্তকে রাখা ঐ সব ব্যাবসায়ীদের জন্য মামুলী ব্যাপার।
কথায় বলে না,"টাকা যার আইন তার"।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তথা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রতি বিশেষ অনুরোধ ,এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে একটু নজর দিন না হলে এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় কু-প্রভাব ফেলবে।