বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সাংবাদিক থাকবে না?

ওয়ালিউল্লাহ
Published : 1 May 2011, 04:37 AM
Updated : 1 May 2011, 04:37 AM

সংবাদপত্রকে বলা হয় একটি দেশের দর্পন। সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। বর্তমান যুগকে বলা হয় মিডিয়ার যুগ। আজকের সচেতন সমাজ নিশ্চয় দ্বিমত পোষণ করবে না যে সংবাদমাধ্যম একটি জাতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস।

ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো অনন্য ভূমিকা রেখেছে। আজ আমরা স্বাধীন দেশে মুখ উঁচু করে যে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি, এর পেছনে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ভূমিকা কতটুকু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু গত ২৪ এপ্রিল একটি অনলাইন পত্রিকায় একটি সংবাদ দেখে রীতিমত অবাক হলাম। সংবাদের শিরোনামটি ছিলো 'এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কোনো সাংবাদিক দেখতে চাই না'। আপনারাও নিশ্চয়ই অবাক হবেন নিচের পুরো সংবাদটি পড়লে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) 'মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ' এই ব্যানারে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক মানববন্ধন করে ক্যাম্পাসে সাংবাদিক না রাখার ব্যাপারে জোর দাবি তুলেছেন। মানববন্ধন পরবর্তী সংক্ষিপ্ত সমাবেশে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও শাবিপ্রবি সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক বলেন, 'এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কোনো সাংবাদিক দেখতে চাই না। গত সিন্ডিকেট বৈঠকেও আমি একই কথা বলেছি।' তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আরো বলেন, 'প্রশাসন সাংবাদিকদের তোষামোদ করার জন্য প্রেসক্লাবের ব্যবস্থা করেছে। ১০ বছর আগেই নিষেধ করেছিলাম এখানে কোন প্রেসক্লাবের প্রয়োজন নেই।' একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক থাকবে কি থাকবে না, সেটা নিশ্চয়ই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা সিন্ডিকেট সদস্য ঠিক করে দেবেন না। যদি সেই ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বা একজন শিক্ষকের কাছে থাকত, তাহলে কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক রাখতে দিতেন না। অবশ্য ওই শিক্ষক যদি ভবিষ্যতে প্রশাসনের বড় কোন পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু তার বুদ্ধিই যদি এই হয়ে থাকে, তাহলে আমি শঙ্কিত যে ,বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি কতটুকু। ওই শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য তার নিশ্চয় জানা থাকার কথা যে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়ে থাকে। যেমন, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, টেন্ডারে দুর্নীতি, ভর্তি বাণিজ্য ইত্যাদি। এখন যে কারো মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই শিক্ষক কি এমন অনিয়ম বা দুর্নীতির সাথে যুক্ত, যা সাংবাদিকরা জেনে যাবে, এই ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিক নিধনে আঁটসাঁট বেঁধে নেমেছেন। অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের জানা থাকা উচিত যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক নিয়োগ যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দেন না সেহেতু তার এই ধরনের বক্তব্য আমার মনে হয় শুধু প্রশাসনের আনুকূল্য পাওয়ার হীন চেষ্টা মাত্র। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসক্লাবের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা দেখবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দ। প্রেসক্লাবের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা সিন্ডিকেট সদস্য বুঝবেন না। অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের জ্ঞাতার্থে বলছি প্রত্যেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে শিক্ষক সমিতি আছে। আপনি নিশ্চয় একমত হবেন, এই শিক্ষক সমিতি আপনার অধিকার আদায়ে জন্য কাজ করে থাকে, যেহেতু আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অনুরূপ ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসক্লাব ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকদের অধিকার আদায়সহ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কাজ করে থাকে।

এর আগে ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ উদ্দিন বলেছেন, 'সাংবাদিক বলতে কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের সংবাদ পাঠানো লাগবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসক্লাবের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না'। ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, 'শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিলেট প্রেসক্লাব মাত্র দুই কিলোমিটারের পথ। তিন কিলোমিটার গেলে সব স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর অফিস পাওয়া যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সাংবাদিকের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। শহরের সাংবাদিকেরাই এখান থেকে নিয়মিত নিউজ করতে পারবে। এখানে অধ্যয়নরতদের শিক্ষানবিশ ও পার্টটাইমের কোন সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টে ছাত্রদের সাংবাদিক বলে আলাদা পরিচয় বহন করার মতো কাউকে অধিকার দেয়নি।' ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক আরো বলেন, 'সাংবাদিকদের শাস্তি দেয়া বিধান যদি দেশের আইনেও না থাকে তাহলেও আমরা দেব'।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বলা হয়, মানুষ গড়ার কারিগর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই যদি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে আমরা কি আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব, পারব আমাদের স্বপ্নকে পূরণ করতে যে স্বপ্ন দেখে এদেশের ত্রিশ লাখ মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছিল।

***
ওয়ালিউল্লাহ : ছাত্র ও সাংবাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
oliju10@gmail.com