সন্তানকে মানসিক চাপে রাখা যেভাবে বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে

এম এল গনিএম এল গনি
Published : 23 Feb 2012, 10:59 AM
Updated : 10 June 2022, 11:10 AM

ঘটনাটি ২০১০ সালের হলেও এ মামলার রায় হয়েছে প্রায় এক যুগ পরে এ বছরের পয়লা জুন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে 'দুই খালাতো বোনের মুখে অ্যাসিড, চট্টগ্রামে ভাইবোনের যাবজ্জীবন' শিরোনামের একটি খবর হঠাৎই নজর কাড়লো। খবর পড়তে গিয়ে জানা গেল, দুই বোনকে অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়ার কারণ হচ্ছে, 'বিয়ে নিয়ে ঈর্ষা।' 

বছর দুয়েকের ছোট খালাতো বোনের বিয়ের প্রস্তাব এলেও দণ্ডপ্রাপ্ত সাকি নামের মেয়েটির নিজের জন্য কেন তেমন প্রস্তাব আসছে না তা নিয়েই ঈর্ষা। পত্রিকান্তরে এভাবেই আমরা ঘটনাটা জানি। এর পেছনে কোন তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন ছিল কিনা তা জানা যায়নি। ঘটনার সময় সাকি ছিল ২২ বছরের তরুণী, আর, বিভৎস এসিড সন্ত্রাসের শিকার খালাতো বোন দুইজনের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৯ বছর ও ১৬ বছর।  

হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি মানব জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। কোন না কোন পর্যায়ে কমবেশি সবার মধ্যেই এ বিষয়গুলো কাজ করে। কিন্তু, তাই বলে আপন খালাতো বোনের মুখ অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেবার মতো ঈর্ষাপরায়ণতা খুব বেশি দেখা যায় না। সমাজ সংসার নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের মনে এ ঘটনা নাড়া দেবে নিঃসন্দেহে। প্রশ্ন জাগে, ঠিক কী কারণে সাকি নামের একটা তরুণী এতো অল্প বয়সে এমন ভয়ংকর ঈর্ষা পরায়ণ হয়ে উঠলো? কী এমন পরিবেশে মেয়েটি বেড়ে উঠেছিল যা তাকে এমন নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষে রূপান্তরিত হতে বাধ্য করেছিল? মেয়েটির বাবা-মায়ের প্যারেন্টিং এর কোথাও কি কোন ঘাটতি ছিল, যা তাকে আজ এ পরিণতি দিয়েছে? এ অপ্রত্যাশিত ঘটনা হতে অন্য বাবা-মায়েদের শিক্ষণীয় কিছু আছে কিনা তাও আমাদের ভাবতে হবে। 

বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতির সমস্যাসংকুল একটা ছোট্ট দেশে প্রতিষ্ঠা পেতে মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকাটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নানা স্তরের মানুষের মধ্যে এ প্রতিযোগিতা চলমান। এ অসম প্রতিযোগিতার অংশীদার কেবল বড়রা নন, শিশুরাও। জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেতে নানামুখী প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। বৈবাহিক সম্পর্কও এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজের রূঢ় বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা বড়রাই শিশুদের মনে খুব ছোটবেলা হতে প্রতিযোগিতার বীজ বপন করে দেই। অন্যথায়, তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে, সেখানেই যত ভয়, উৎকণ্ঠা আমাদের। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, ঠিক কতখানি প্রতিযোগিতার চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিলে একটা শিশু বা তরুণ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে চরম প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভেবে তাকে শারীরিক আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বসবে না? কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিয়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

ধরুন, আপনার সন্তান পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায়নি, কিন্তু, আপনার ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত কারো সন্তান গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আপনি কি আপনার সন্তানকে এমন কথা বলতে পারেন: 'তোমাকে তো সুযোগসুবিধা কম দেই নি, তারপরও মতি (ছদ্মনাম) গোল্ডেন জিপিএ পেলে তুমি পেলে না কেন? তোমার খারাপ ফলাফলের কারণে আমরা তো এখন কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। …' 

অনেক বাবা-মা আরও আগ বাড়িয়ে সন্তানকে এমন কারণে মারধর পর্যন্ত করেন, বা বাড়ি হতে তাড়িয়ে দেন। একবারও ভাবেন না এমন মানসিক নিপীড়ণের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী কী ফলাফল হতে পারে? এ জাতীয় ঘটনায় অনেক সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদেরকে আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নিতে আমরা পত্রপত্রিকায় পড়েছি।  

পরিচিত কোন মেয়ের বিয়ে স্থির হয়েছে শুনে অনেক সময় নিজের কন্যাকে নিয়ে কটাক্ষ করে সরাসরি বা আকারে-ইঙ্গিতে আমরা বেফাঁস মন্তব্য করে বসি। যেন বলতে চাই, 'তোমার বয়সী বা তোমার চেয়ে ছোট মেয়েটির জন্য এত ভাল প্রস্তাব এলে তোমার জন্য কেউ প্রস্তাব দিচ্ছে না কেন? তুমি কেন ওর মতো হতে পারো না?' অর্থাৎ, উপযুক্ত পাত্র আসা না আসা যেন একান্তই মেয়েটির দোষ বা গুণ এর ব্যাপার। এটা অবশ্যই মানসিক নিপীড়ণ। এ ধরনের মানসিক চাপ প্রয়োগ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে এক সময় ভুক্তভোগী হতাশাগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে রূপান্তরিত হতে পারেন। ফলে, তিনি তার সমবয়সী অন্য মেয়েদের তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে চূড়ান্ত ক্ষেত্রে তার বা তাদের ক্ষয়ক্ষতি করারও চিন্তা করতে পারেন। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিহিংসামূলক চিন্তাচেতনা জাগ্রত হয়ে তার স্বাভাবিক বিবেচার বিবেচনা বা বুদ্ধি লোপ পেতে পারে। সাকি নামের মেয়েটি এমনই পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার কিনা তাও ভেবে দেখার বিষয়।  

নিজের অজান্তেই অনেকসময় বাবা-মা সন্তানকে মানসিক নিপীড়ণ করে থাকেন। প্রায়ই এসবে থাকে অসম প্রতিযোগিতা ও সামাজিক চাপ। বাবা-মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতার বলি হয় তাদের নির্দোষ সন্তান। এমনই একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা পাঠকের সাথে সহভাগ করি। কানাডার অভিবাসন পরামর্শক (আরসিআইসি) হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। 

বাংলাদেশ থেকে কানাডায় স্টাডি পারমিট নিয়ে পড়তে আসা বিশ বছর বয়সী এক ছাত্র কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয় হতে যোগাযোগ করলো আমার সাথে। সমস্যা, যে পড়াশোনার প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে এসেছে তা ঠিকমতো করতে পারছে না সে। তাই, স্টাডি প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে অন্য কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও সহজ প্রোগ্রামে স্থানান্তরিত হতে চায়। এ অবস্থায় ইমিগ্রেশন সহযোগিতা চায় সে। এই ছাত্রের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে জানতে চাইলাম, তারা তাদের সন্তানকে কানাডার এই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিশেষ প্রোগ্রামের পড়তে পাঠানোর চিন্তা কিভাবে করলেন? জানা গেল, ছেলেটি জিপিএ ৫ পেয়েছে,  এবং এই একই ধরনের ফলাফল করে তাদের এক প্রতিবেশীর ছেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রামে পড়তে গেছে। তাই, তারাও এই প্রোগ্রামে তাদের সন্তানকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু, সন্তান যে এই প্রোগ্রামটায় পড়াশোনায় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে এবং ঠিকমতো শেষ করতে পারবে না- তা তারা বুঝতে পারেননি। 

উপরের ঘটনা পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না, স্টাডি প্রোগ্রাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পছন্দ বা মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিবেশীর সন্তান কী পড়তে গেছে তা-ই এই দম্পতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠকই বলুন, স্টাডি প্রোগ্রাম কি এভাবে নির্বাচন করা উচিত? আরও দুঃখজনক বিষয় হলো এই, প্রতিবেশীর সন্তানটি আসলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেননি, তিনি এসেছেন অন্য এক জায়গায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে এ কিছুটা এগিয়ে আছে বলে তারা সামাজিক 'মর্যাদা' বাড়াতে সঠিক তথ্য পরিচিতজনদের দেননি। 

সঙ্গত কারণেই, উচ্চতর র‌্যাংকিং এর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে বেশ সংখ্যক মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্রছাত্রীর সমাহার। সেই পরিবেশে সাধারণ মানের কোনও শিক্ষার্থী সহজে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এক্ষেত্রেও বাবা-মায়ের অসম প্রতিযোগিতার বলি হতে হচ্ছে আমার সাথে যোগাযোগ করা ছেলেটি। ছাত্রটিকে অবশেষে একটা মাঝারি মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার পছন্দসই একটি প্রোগ্রাম এ স্থানান্তর করে স্টুডেন্ট ভিসা হালনাগাদ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এ কাজটি করা না গেলে তাকে হয়তোবা পড়াশুনা অসম্পূর্ণ রেখেই কানাডা ছাড়তে হতো, বা কানাডায় অবৈধভাবে বসবাস করতে হতো। 

নিজের পরিবারের একটি ক্ষুদ্র ঘটনা দিয়ে এ লেখা শেষ করি। কানাডায় আমাদের কন্যা অয়ন যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তখন প্যারেন্ট-টিচার মিটিংয়ের সময় আমি তার শ্রেণিশিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম অয়ন তার ক্লাসের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় পড়াশোনায় কেমন করছে? যারা জানেন না তাদের জন্য বলা, কানাডার স্কুল-কলেজে বাংলাদেশের মতো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি স্থান দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের চিহ্নিত করা হয় না। সত্যি বলতে কি, এদেশে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্যতামূলক কোন পরীক্ষাও নেই। এক শ্রেণির পড়া শেষ হলে তারা এমনিতেই বছর শেষে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে যায়। অর্থাৎ, শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা দূরের কথা, বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত নেওয়া হয় না। সহজ ভাষায়, শিশুদের কোনওপ্রকার মানসিক চাপে ফেলতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নারাজ।

যাই হোক, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমি কন্যার শিক্ষকের কাছে যে তার প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি র‌্যাংকিং বিষয়ে জানতে চাইছিলাম তা শিক্ষক ঠিকই ধরতে পেরেছেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আমাকে বললেন, "দেখুন মিস্টার গনি, আপনারা যে দেশ হতে এসেছেন সেখানে বাচ্চাদের স্কুলে র‌্যাংকিং পদ্ধতি আছে, ফলে সেখানে শিশুদের মধ্যে পড়াশোনায় তীব্র প্রতিযোগিতাও থাকে; কিন্তু, কানাডায় সে বিষয়টি আপনি দেখবেন না। কেবল আমাদের বিদ্যালয় বলে কথা নেই, অন্যসব স্কুলেও এ ধরনের র‌্যাংকিং সিস্টেম নেই। আমরা এক শিক্ষার্থীর সাথে অন্যের তুলনা সেভাবে করি না। তবে, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনার কন্যার কাছ থেকে তার সেরাটি বের করে নেবার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে আমাদের।…" 

ইতোমধ্যে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সে আমলে ওই শিক্ষকের কথাগুলোর মর্মার্থ যথাযথ উপলব্ধি করতে না পেরে ধরে নিয়েছিলাম কানাডার পড়ালেখা সম্ভবত বাংলাদেশের মতো ততটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ বা মানসম্মত নয়। অথচ, আজ যখন দেখলাম লেখাপড়ায় তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করে আমাদের সেই অয়ন কানাডায় চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তখন স্বীকার না করে উপায় নেই যে কানাডার এই আপাত প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশের অসম প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশের চেয়ে বহুগুণে বেশি উন্নত ও কার্যকর। 

সবশেষে একটি কথাই বলবো, সামাজিক চাপের প্রতিযোগিতায় জিততে আপনার সন্তানকে বিভিন্নক্ষেত্রে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের সন্তানদের সাথে তুলনা করে তাকে অহেতুক মানসিক চাপে রাখবেন না। রাখলে, তাতে তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, এবং ফলে, সে ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে পরিণত হতে পারে, যার অনাকাঙ্খিত ফল হতে পারে আপনজনদের সাথেও চূড়ান্ত পর্যায়ের ঈর্ষাকাতরতা। প্রতিহিংসা বা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে অ্যাসিড সন্ত্রাসের মতো সহিংস ঘটনা যেন আর শুনতে না হয় সে লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান হতে সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যেতেই হবে।