বিমান দূর্ঘটনার আদ্যোপান্ত

ওয়াসীম সোবহান চৌধুরী
Published : 4 Sept 2015, 07:21 AM
Updated : 4 Sept 2015, 07:21 AM

…বেশীরভাগ বিমান দূর্ঘটনা ঘটে বিমান উড্ডয়নের প্রথম ৩ মিনিটের মধ্যে অথবা ল্যান্ডিং করার আগের শেষ ৮ মিনিটে। এই ১১ মিনিটই যাত্রীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর প্রকৃতপক্ষে বিমান মাটিতে আছড়ে পরার সময় যাত্রীরা মারা যায় না; বেশীরভাগ মারা যায় আছড়ে পরার পূর্বে বিষাক্ত গ্যাস ও ধোয়ার কারনে অথবা মাটিতে আছড়ে পরার পর বিস্ফোরন জনিত আগুনের কারনে।

বিমান দূর্ঘটনা মানুষকে গাড়ি, ট্রেন বা জাহা

জ দূর্ঘটনার তুলনায় বেশী আকর্ষণ করে কারন এ অনেক কম ঘটে। বাংলাদেশে এই হার তো আরও কম। ট্রান্সপোর্টেশান সেফটি বোর্ড ও এয়ার ক্র্যাশ তদন্তকারী সংস্থার হিশাব অনুযায়ী প্রতি ১.২ মিলিয়ন বিমান ফ্লাইটে ১ টি দূর্ঘটনা ঘটে। এর মানে একজন নিয়মিত বিমানযাত্রীর আকাশ পথে সঙ্কটে পড়ার সম্ভাবনা আসলে খুবই কম; নেই বললেই চলে। আহত হবার সম্ভাবনা আরো কম – প্রতি ১১ মিলিয়নে মাত্র ১। উন্নত দেশে গাড়ী দূর্ঘটনার হার হলো প্রতি ১২০০০ এ ১ এবং বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে প্রতি ২০০০ এ ১। তাই বলা হয় বিমান যাত্রা অনেক নিরাপদ। কিন্তু মিডিয়ায় বিমান দূর্ঘটনার সংবাদ বেশ গুরুত্তের সাথে প্রচার হওয়ায় এবং কিছুক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত হওয়ায় মানুষ একেই সবচাইতে ভয়ঙ্কর ও প্রানঘাতী ভাবে। তবে এটা ঠিক যে বিমানযাত্রার সময় যদি কোন ধরনের সমস্যা দেখা দেয় তখন মানুষের মনে একধরনের নিরাপত্তাহীনতা ভর করে যা গাড়ি, ট্রেন বা জাহাজের তুলনায় অনেক বেশী।

বিমানযাত্রা কিন্তু নিরাপদ করা সম্ভব। যাত্রীরা আগে আগে বোর্ডিং করে বিমানের পেছনের অংশে আসন নিতে পারে যা তাদের যাত্রাকে একটু হলেও নিরাপদ করবে। এয়ার ক্র্যাশ তদন্তকারী সংস্থা গবেষণা করে দেখেছে যে, দূর্ঘটনার সময় যারা পেছনের আসনে বসেন তাদের বেচে থাকার সম্ভাবনা তুলনামুলক ভাবে সামনের আসনের যাত্রীদের থেকে অনেক বেশী। আরেকটি উপায় বেচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে, সেটা হলো প্লেনে বসে মদ না খাওয়া, মানে মাতাল না হওয়া। বিপদের সময় সজাগ যাত্রীরা বিমান থেকে বের হওয়ার পথ খুজে নেয়, এমনকি যদিও কোন কিছু না দেখা যায় তখনও; কিন্তু এধরনের পরিস্থিতি থেকে মাতাল যাত্রীদের বের হবার সুযোগ কম থাকে। তবে মিসাইল দিয়ে বিমান উড়িয়ে দিলেতো আর বেচে থাকার উপায় নেই।

ট্রান্সপোর্টেশান সেফটি বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী বেশীরভাগ বিমান দূর্ঘটনা ঘটে পাইলটের ভূলের কারনে অথবা যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে।এখন পর্যন্ত পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ৪৫% বিমান দূর্ঘটনার জন্য পাইলটরাই দায়ী ছিল, যার মধ্যে খারাপ আবহাওয়ার সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া অর্ন্তভূক্ত। ২২% দূর্ঘটনা ঘটে বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে। আর কিছু দূর্ঘটনা ঘটে যখন পাইলট যন্ত্রপাতির সংকেত ভূল নির্নয় করে বা যান্ত্রিক ত্রুটি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়।

যে কোন বাণিজ্যিক বিমান দূর্ঘটনা ঘটার পরপরই ব্লাকবক্স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বস্তু হয়ে ওঠে। এর কারণ হলো দূর্ঘটনার সময় এটি বিমানের গতির তথ্য, উচ্চতা, জ্বালানী প্রবাহ ও ককপিটের কথোপকোথন রেকর্ড করে রাখে। ব্লাকবক্স কিন্তু দেখতে কাল নয়; এগুলো কমলা রঙের। ব্লাকবক্সে দুইটি অংশ থাকে। এর মধ্যে একটি ফ্লাইট রেকর্ডার এবং আরেকটি ককপিটের ভয়েস রেকর্ডার। ব্লাক বক্স সাধারনত বিমানের পেছনের অংশে বসানো থাকে। ব্লাকবক্স অধ্বংশনীয় ও প্রায় অবিনাশী; এগুলো ১১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়, ৫০০০ পাউন্ড চাপসহ লবনাক্ত পানিতে ও জেট ফুয়েলেও অক্ষত থাকতে পারে।
বিমানের অক্সিজেন মাস্ক, লাইট, হার্ড ল্যান্ডিং, মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং হেডসেট সম্পর্কে অনেক ভুল ধারনা প্রচলিত আছে। যেমন কেবিনক্রু বা পাইলটরা কখনও বলেনা রাতে ল্যান্ডিং এর সময় ভেতরের লাইটগুলো কেন নিভু নিভু হয়ে যায়। যাত্রীরাও এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনা কারন তারা মনে করে এটি ল্যান্ডিং এর একটি পক্রিয়া। লাইট নিভু নিভু করার কারন হলো যাত্রীদের দৃষ্টি সচল রাখা; নিভু নিভু লাইটের কারনে যাত্রীদের চোখ অন্ধকারের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। জরুরী অবতরনের সময় এটা কাজে লাগে। আর একটি ভুল ধারনা আছে হার্ড ল্যান্ডিং এর ব্যপারে। খারাপ আবহাওয়ার কারনে পাইলটরা হার্ড ল্যান্ডিং করে যাতে পানিতে বিমানটি পিছলিয়ে না যায়। কিন্তু যাত্রীরা মনে করে এটা পাইলটের ভুলের কারনে হয়েছে। অন্য একটা ভুল ধারনা প্রচলিত আছে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ে। বিমানে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়। মোবাইল ফোন ব্যবহারে একটি বিমান কখনও মাটিতে পরে যায় না কিন্তু এটি পাইলটদের জন্য বিরক্তিকর কারন হেডফোনে তারা অনবরত সিগন্যাল পেতে থাকে। আবার যে হেডফোনগুলো যাত্রীদের দেওয়া হয় সেগুলো কিন্তু নতুন নয়, যদিও নতুন নতুন লাগে কারণ সেগুলো নতুন ব্যাগে মোড়ানো থাকে।

যখন বিমানের দরজা বন্ধ হয় তখন ক্যাপ্টেন সীমাহীন ক্ষমতা পেয়ে যায়। একবার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে বিমানের ক্যাপ্টেন কোন যাত্রিকে গ্রেপ্তারের, জরিমানা করার এবং মূমুর্ষ যাত্রীর শেষ ইচ্ছা গ্রহন করার ক্ষমতা পেয়ে থাকে। এমনকি দেশের প্রেসিডেন্টও যদি বিমানে অবস্থান করেন, তাহলেও ক্যাপ্টেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকেন।

**এই লেখাটি গতবছরের। লিখেছিলাম  Malaysia Airlines MH370 ফ্লাইটটি নিখোজ হবার পর। কাল খবরে দেখলাম  বিমানটির ধ্বংসাবসেশ পাওয়া গেছে রিইউনিয়ন দ্বীপে। তাই পুরনো এই লেখা এখানে তুলে দিলাম।