ভাষার জন্য মমতা

Umar Abdullah
Published : 7 May 2016, 08:44 PM
Updated : 7 May 2016, 08:44 PM

ওর সাথে আমার পরিচয় সেই বাল্যকালের।

গ্রীষ্মের দুপুরে উচু গাছে উঠে লাফিয়ে পানিতে পড়ে দাপাদাপি, বিকেলে দখিনা বাতাসে ঘুড়ি ওড়ানো আর আম চুরি করে লবণ- মরিচ মেখে খাওয়া কালের থেকে সে আমার বন্ধু।

মাকে নিয়ে আমরা ক'ভাই –বোন থাকতাম গাঁয়েই। বাবা ডাক বিভাগের ২য় শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন। নিয়তিই হোক বা অন্য যেকোনো কারণে হোক সরকারি অফিসের বদলি গাড়িতে বাবাকে প্রায়ই চড়তে হত। আজ বান্দরবান তো কাল পঞ্চগড়, পরশু শ্যামনগর তো তরশু টেকনাফ।  এভাবেই চলছিল।

সামান্য বেতন যা পেতেন তা দিয়ে আমাদের পাঁচ ছয়জন সদস্যের গাড়িটা গাঁয়ের রাস্তায় চলতেই হিমশিম খেত, তাই আমরা কখনো বাবার সাথে কর্মস্থলে বদলি হতে পারতাম না। বছরে সরকারি ছুটি ছাড়া তার বাড়ি আসা হত না, তবে দু'দিন পরপর চিঠি আসত একটা করে। মা জবাব লেখাতেন আমাকে দিয়ে, হাতের লেখাটা আমার একটু স্পষ্ট ছিল বোধহয়। গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ছিল, লেখার মধ্যে সেই বয়স থেকেই তাই বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে পারতাম আর বানান ভুল হতনা।

বাবা বানান ভুল মোটেই সহ্য করতে পারতেন না, আর তা যদি বাংলা ভাষা হয় তাহলে তো আরো রেগে যেতেন।  বলতেন

"দেখ খোকন! আমাদের কত বড় ভাগ্য যে আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার অধিকারের জন্য প্রাণ দিয়েছে, আবার দুর্ভাগ্য এটাই যে আমরা তার যথার্থ মূল্য দিতে পারি নি। রাস্তাঘাটে সর্বত্রই বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা। বানান ভুলের ছড়াছড়ি।

কোথাও গড়গড় করে দু লাইন ইংরিজি বলতে পারলেই তাকে মানুষ স্যালুট করে পা ধুয়ে পানি খায়, অথচ শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলা লোক হাতে গোণা কয়েকজনই বলতে পারিস। তাদের কোনো কদর নেই।

এই যে আমি কত চেষ্টা করছি ডাক বিভাগের যে সব জায়গায় বাংলা লিখলে চলে সেখানে বাংলায়ই লিখি। অথচ এই নিয়ে মানুষ কত হাসাহাসি করে। সেই বৃটিশ আমলে তৈরি করা ইংরেজি কাগজপত্র এখনো চলছে সবখানে। দেশের আইন আদালত বড় সরকারি বেসরকারি কার্যালয় সব জায়গাতেই বাংলা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ।

তাহলে কি দরকার ছিল ৫২'র ভাষা আন্দোলনের? কি দরকার ছিল ভাষা শহীদদের জীবন দেয়ার?"

আমি অতকিছু বুঝতাম না তবে দেখতাম আবেগে বাবার চোখ ছলছল করছে, আরেকটু হলেই বোধহয় কেঁদে ফেলবেন। কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলতেন

" দেখিস খোকন! এরকম সবসময় থাকবে না। মানুষ একদিন সত্যিই জাগবে। তোকেই পারতে হবে, কি পারবি না? আমি বলতাম পারব।

বাবা কিছুক্ষণ দুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চেপে ধরতেন।