মেঘালয়ের সীমান্তে বন্যপ্রাণি পাচার কেন্দ্র

হোসেন সোহেল
Published : 3 March 2012, 02:10 PM
Updated : 3 March 2012, 02:10 PM

বিকেল চারটায় একটা ফোন আসে নেত্রকোণা থেকে। উনিশটি মেছো বাঘে বাচ্চা বিক্রি হতে চলেছে নেত্রকোনার কলমাকান্দা সীমান্তে। ঠিকানা কাগজে লিখে রাখলাম। সীমান্ত এলাকায় মেছোবাঘ বেচা-কেনার বিষয়টি একটু নাড়া দিলো। রাত আটটা নগাদ ঢাকা ছাড়লাম সেই সাথে পরিবেশবিদ ড. আনিসুজ্জামানকে ঘটনাটি বলতেই তিনি নড়েচড়ে গিয়ে আমার সফরসঙ্গী হলেন। দ্রুত পথ অতিক্রম করবো বলে একটি গাড়ি নিলেও রাস্তা খুব খারাপ হওয়াতে সময় মতো পৌছাতে পারবো কিনা সন্দেহ থেকেই গেলো।

ময়মনসিংহ অতিক্রমকালে সাথে নেওয়া ম্যাপ বের করে টর্চ জ্বালিয়ে গাড়িতেই দেখলাম মেঘালয়ের পাদদেশে কালাপানি' নামে একটি গ্রাম রয়েছে। আমাদের গন্তব্য কালাপানি' গ্রামে। বন্যপ্রাণি পাচারের অলাপে গাড়িতে বসেই ড. আনিস যোগ করলেন মেছোবাঘ গুলো যে লোকটি বিক্রি করবেন আগেও সে অনেক বন্যপ্রাণি বেচা-কেনা করেছে এটা বলাই যায়। মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা শুধু মেছোবাঘ নয় সেখানে মায়া হরিণ, সাম্বার হরিণ, সজারু, অজগর, বনরুইসহ অনেক প্রাণির বাস। পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালী-আদিবাসিরা কোন বন্যপ্রাণি পেলেই খেয়ে ফেলে অথচ ইদানিং এগুলো না খেয়ে তারা বিক্রি করছে। বাচ্চাগুলো খাওয়ার অনুপযুক্ত হওয়াতে বিক্রির দিকে ঝুকে পড়ছে এই মানুষগুলো। বারো মাসের ছয়টি ঋতুতে অসংখ্য বন্যপ্রাণির পদচারনা রয়েছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুরের পাহাড়ী সীমান্তে।

আকাশে ভোরের আভা ফুটি ফুটি করছে। আমরা কলমাকান্দার কাছে। পাহাড় নিকটবর্তী হওয়াতে শীতল হাওয়া গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে মুখে লাগে। ঋতুতে আবার বর্ষা মৌসুম। আধো ঘুমে সবাই গা এলিয়ে দিলেও আনিস ভাই বলেন আর কিছুদুর এগুলে লেংগুড়া বাজার। রাস্তার অবস্থা এতোটাই খারাপ গাড়ির গতি রাখতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ কি: মি:।

সূর্যের আলোতে ভোর কেটে সকাল হয়ে যায়। আমরা লেংগুড়া বাজারে। পাহাড়ের কোলে বাস করা মানুষগুলো এর মধ্যে বাজারে পসরা সাজিয়েছে। দিনটি ছিলো লেংগুড়ার সাপ্তাহিক হাটবার। মুখে পানি আর পেটে খাবার দিতে গাড়ি থেকে নেমে যাই সেই সাথে কালাপানির' সঠিক রাস্তা কোন দিকে তাও জানতে হবে। আনিস ভাই নামলেন না। চোখ বন্ধ করে তিনি একটু ঘুমোতে চাইলেন। বাজারের এক বৃদ্ধ গারো চাচাকে পেয়ে বলি কালাপানি কোথায়? তিনি যেভাবে বললেন তাতে কালাপানি যাওয়ার পথ বেশি সহজ মনে হলো না।

সকালের খাবার খেয়ে বাজারে একটু হাঁটছি। সকাল আটটার মধ্যেই হাট জমে উঠেছে। দেশের অনেক হাট-বাজার থেকে লেংগুড়া বাজারটি অনেক পরিচ্ছন্ন। মানুষের পায়ের আনাগোনার সাথে হালকা দরদামের গুনগুন কানে আসে। ভালোই লাগছে সরল মানুষের এ পরিবেশ। এভাবে কিছুদুর হাটতে হাটতেই চোখে পড়লো মাটিতে সটান পেতে রাখা একটি লাল কাপড়ের উপর। চোখটা একটু ঘষে নিয়ে আবার চেষ্টা, কি দেখছি এটা আস্ত বাঘের একটি মাথা লাল কাপড়ের উপরে রাখা। আমি কাছে গেলাম দাঁতসহ বাঘের পূর্নাঙ্গ কংকাল। মাথাটির সাথে একটি বুনো ছাগলের মাথা, একটি বনরুইয়ের চামড়ার সাথে আরও কিছু দেহাংশ। কাছে যেতেই লোকটি কাচুমাচু করে আমাকে দেখলো। আমার অবাক দমাতে না পেরে বলেই ফেলি এটা কিসের মাথা, কোথায় পেলেন, উত্তর আসলো না। আবারও বলি ভাই এটা কোথায় পেলেন? এবার অস্ফুট কন্ঠে 'এটা পাকিস্তানের লাহোর থেকে নিয়ে আসা সে আরও বলে এটা বেঙ্গল টাইগারের মাথা। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভাবি লাহোর থেকে 'বেঙ্গল টাইগারের' মাথা !!

তার সাথে আর কথা বাড়িয়ে গাড়ির কাছে পৌছালাম। আনিস ভাই ঘুমিয়ে আছে। ক্যামেরা পারসন গিয়াসউদ্দিনকে সাথে নিয়ে আবার ফিরে এলাম। কিন্তু একি লোকটি সব গুটিয়ে ব্যাগে ভরছে। আমি বললাম ভাই আপনার একটি সাক্ষাতকার নেবো। তিনি রাজি হলেন না। তাহলে এসব দ্রব্য-সামগ্রীর কিছু ছবি নিবো। তিনি পুরো রাজি না হলেও ছবি তুলতে দিলেন। তবে বাঘের মাথাটি তার হাত থেকে নামানো গেলো না। বরং অনেক আটো-সাটো করে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে রাখলো। তাকে বুঝালাম তোমার জন্য আমি কোন ক্ষতিকর জীব না। মাথা দিয়ে কিভাবে তাবিজ বানান উত্তর আসে 'ভাই এটা রাখি মানুষের মনোবল বৃদ্ধির জন্য, সাথে কোন যৌন দূর্বল-অক্ষম মানুষের গায়ে একটু ছুয়েঁ দিলে মানুষটি শক্ত-সার্মথ্য হয়ে উঠে। কথা বলা শেষ করেই সবকিছু দ্রুত ব্যাগে ভরে নিলেন।

গায়ে একটু বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করলো। ব্যস্তবতার আকাশের গায়ে কখন এ মেঘ জমেছিলো বুঝতে পারিনি। বনরুইয়ের চামড়া দিয়ে তাবিজ বা টোটকা ওষুধের ব্যবহার এর আগে বেশ দেখেছি। কিন্তু আস্ত একটা বেঙ্গল টাইগারের মাথা সামনে রেখে তাবিজ বিক্রির এ দৃশ্য বিরল। ম্যাপ দেখলে লেংগুড়া বাজার নেত্রোকনা সীমান্ত এলাকার শেষ একটি বাজার। কালাপানি' গ্রামে না যেতেই এমন একটি দৃশ্য আরও চিন্তিত করে তুললো। খোদ সে বাঘের মাথাটির আর্ন্তজাতিক মূল্য হবে লাখো টাকা। সারাবিশ্বে বিশেষ করে চীনে এমন একটি বাঘের মাথা আরও চড়া দামে বেচা-কেনা হয়। সেটিও হাতুরি ডাক্তারের বিশেষ উপাদান হিসেবে সাথে রাখে।

গাড়িতে ফিরে এলাম। আনিস ভাইকে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন এসব হকার সাধারন মানুষ থেকে অনেক বেশি চালাক। মুসলিম এলাকায় তারা বলে লাহোর আর হিন্দু স¤প্রদায়ের কাছে রাজস্থান অথবা ভারতের নাম উল্লেখ করে। কারন তাদের এ বেচা-কেনার সাথে ধর্মকেও তারা পূজি করে।

আমরা এবার ছুটলাম কালাপানির' দিকে। সীমান্ত এলাকার অনেক কাছকাছি। এক পর্যায়ে আধো পাকা রাস্তা শেষ করে পায়ে হাটা কাচাঁ রাস্তায় এসে ঠেকলাম। গাড়ি রেখে এবার পায়ে হেটে চললাম কালাপানির' পথে।

ঝিরিপথ ও পাহাড়ী পথে হাটতে গিয়ে পথেই পেলাম এক ছেলেকে। বাড়ি বাড়ি আলো ফুটাতে সৌরবিদ্যুত সংযোগ দেয়। তথ্যটি শুনে ভালো লাগলো সীমান্তে আলো। আমাদের সন্ধান নুসায়ে'র বাড়ি। ছেলেটি না চিনলেও আমাদের চিনিয়ে দেবে বলে পথ চলি। ছেলেটিকে প্রায় সবই খুলে বললাম। কাউকে তো বিশ্বাস করতে হবে।

প্রায় ৫ কি: মি: দুরুত্ব আমাদের অতিক্রম করতে হবে। হাটতে হাটতে পা গরম যে মূর্হুতে, তখনই সামনে পেয়ে যাই একটি ঝিরি পথ। পানি বয়ে চলেছে কল কল শব্দ করে। পানিতে পা দিতেই ঠান্ডা অনুভুত হলো। পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ সে পানিতে বালি চিকচিক করছে। পানির গভীরতা হাটু পানি হওয়াতে বেশ খানিকখন পা চুবিয়ে রাখলাম। যাই হোক আবার পথ চলা। পাহাড়ের মাঝে ছোট একটি সমতল ভুমির নাম কালাপানি' এমনটি আমাদের চোখে ধরা দিলো। এগিয়ে যাই, আমাদের অনুসন্ধানী চোখ আরও সোচ্চার হতে থাকে। সাথে থাকা ছেলেটি খুজতে আরম্ভ করেছে নুসাইয়ের বাড়িটি কোন দিকে।

এ পর্যায়ে আমরা নুসাইয়ে বাড়ির উঠোনে দাড়িয়ে। নুসাই আমাদের সামনে। ড. আনিস নুসাইকে বলে আমরা ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি আপনাদের গ্রামে। আর আমি চোখ রাখি বাড়িটির ভৌগলিক অবস্থান। মাত্র শ'দুয়েক দুরে ভারত বাংলাদেশ সীমানা রেখা। বলা যায় নুসাইয়ে বাড়ির উঠোন দিয়েই সিমান্ত রেখা চলে গেছে। নুসাই আমাদের বসতে দিয়ে একটু পানি খাওয়ালো। সঙ্গে আসা ছেলেটি ঘরের ভিতরে বাইরে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার কথা বলে সবদিক বন্যপ্রাণির সন্ধান করে পেলো না কিছুই। এবার ড. আনিস বলেন নুসাইকে তোমাদের বাড়িতো একবাওে মেঘালয় পাহাড়ের সাথে লাগোয়া। তোমার বাড়িতে বসে বুঝার উপায় নেই আমরা কোন সাীমানায় বসে আছি। কথা শুনে নুসাই হাসে।

এবার ড. আনিস কাজের কথায় আসে, তোমাদের এ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করতে গিয়ে তোমরা কি পশু-পাখি দেখতে পাও। নুসাইয়ের চেহারায় কোন পরিবর্তন দেখা তো গেলোই না বরং সে বলে এখানে আগের মতো অনেক জন্তু-জানোয়ার দেখা না গেলেও মাঝে মাঝে কিছু চোখে পড়ে। যাক কাজ কিছুটা এগিয়ে গেলো। আমি কিছুু টাকা দিলাম নুসাইয়ের হাতে দুপুরে কিছু ডাল ভাতের আয়োজন করার জন্য। আমরা বুঝলাম এতো অল্প সময়ে কিছু হবে না। আমরা তো প্রশাসনের কেউ নই যে এসেই বলবো বের করো নুসাই তোমার কাছে যা যা আছে। অবশ্য বাস্তবে এমনটাও যদি হতো বিশেষ করে বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাহলে সংরক্ষন সর্ম্পকিত বিষয়টি কিছুটা হয়তো এগিয়ে যেতো।

দুপুরে ভাত খেতে বসে নুসাইকে ড. আনিস সরাসরি বললেন তোমার কাছে কি ধরনের বাঘ আছে? আমাকে দেখাও আমি একটু ছবি তুলতে চাই। তোমার কোন ক্ষতি করবো না বরং তোমাকে আমি কিছু টাকা দেবো। নুসাই আমাদের বললেন আমার কাছে তো কিছু নেই। আমি দেখাবো কোথায় থেকে। যাই হোক খাবার খেয়ে তাকে আবারও বুঝাতে আরম্ভ করলাম আমরা। এবার সে বললো আমার কাছে কিছু নেই তবে ওপারে আমার এক আতœীয় আছে তার কাছে কিছু আছে। তবে সবগুলো তো দেখাতে পারবো না। আমরা আর আর্শ্চয হলাম না। কারন এবার আমরা আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চলেছি। বরং আমরা তাকে বলি আর কি কি আছে আপনার কাছে। সে বলে আপনি যা চাইবেন তাই দেওয়া যাবে। বিশেষ করে ভাল্লুর বাচ্চা, হরিনের বাচ্চা এবার আমরা অবাক হতে চলেছি নুসাই বলে যায় বাঘের বাচ্চা আছে উনিশটা, সাম্বার হরিণের বাচ্চাও আছে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করলে আপনাদের একটা নমুনা দেখাতে পারি। আমরা তো বলিআমি ও ড. আনিস দুজনেই একে অপরের দিকে চোখ রাখি। আর চোখের ভাষায় বলি শুধু এক ঘন্টা কেনো তোমার কাছে রাখা বাবু বাচ্চা গুলো দেখার জন্য আমরা অনেকদিন অপেক্ষা করতে পারি।

সে একটা লোককে পাঠিয়ে দিলো সীমান্তেও ওপারে। লোকটি দুশো' গজ দুরত্বে থাকা ভারত সিমান্ত রেখা অতিক্রম করে চলে গেলো সহজে। আমরা অপেক্ষায় আছি সীমান্তের ওপারে যাওয়া লোকটি কখন ফিরবে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলে আমরা দেখতে পেলাম লোকটি ফিরছে। কিস্তু সেকি তার হাতে ব্যাগ তাও আবার দড়ি দিয়ে মুখ বাধা। কাছে আসতেই বলি ব্যাগের মুখটা খুলে ফেলেন তা না হলে তো ভিতরে থাকা প্রাণিটি যেটাই হোক মারা যেতে পারে। ব্যাগের মুখ খুলতেই চোখে এলো তুলতুলে দুটি মেছো বাঘের বাচ্চা। মাসখানেক হবে বাচ্চা দুটির বয়স বললেন ড. আনিস। তিনি আরও বললেন এদের বেঁচে থাকা অনেক কঠিন হবে। হয়তো বাঁচবে না এ প্রকৃতিতে। বাঘের বাচ্চাগুলো কতো করে বিক্রি করো নুসাই প্রশ্ন করতে উত্তর আসে বাঘের বাচ্চা সাত হাজার টাকা, ভাল্লুর বাচ্চা (ভাল্লুকের বাচ্চা) দশ হাজার আর হরিণ বড়টা (সাম্বার) দশ হাজার টাকা সেই সাথে ছোট হরিণ সাত হাজার করে বিক্রি করি। এগুলো কোথায় থেকে ধরে আনো উত্তরে এগুলো ধরার জন্য আলাদা লোক আছে। বড় যেগুলো পাই সেগুলোকে খেয়ে ফেলি আর ছোট গুলোর মাংস কম হওয়াতে এগুলো বিক্রি করি। কারা এগুলো বেশি কেনে উত্তরে নুসাই বলে ঢাকার লোক আসে ওরাই কেনে। আমরা আরও জানতে পারলাম এই প্রাণিগুলো পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজার ও কাটাবন সহ অনেক জায়গায় বিক্রি হয়।

আমরা আমাদের ছবি তুলতে পারলাম শুধু বাঘগুলোর (মেছো বাঘ)। সেই সাথে স্বর্গপুরী মেঘালয়ের পাদদেশের একটি এলাকা কালাপানি' ও আজ বন্যপ্রাণি বেচা-কেনার একটি কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করলো। আর অন্যদিকে বাংলাদেশ বনবিভাগ নীরব ভুমিকায় থেকে এই ধ্বংসলীলা পর্যবেক্ষন করছে শুধুমাত্র জনবলের অভাবের দোহায় দিয়ে। তারাও হয়তো জানে না দেশের সীমান্ত এলাকায় এমনই বেচা-কেনা হয়।

এই লেখাটি ছাপা হয় ইত্তেফাক' পত্রিকায় ।