দখল রাজ্যের আসহায় জাতি

ওয়াসিম ফারুক
Published : 26 May 2016, 07:10 AM
Updated : 26 May 2016, 07:10 AM

দখল একটি অতি প্রাচীন শব্দ। ছোট বেলায় আমরা চর দখলের কথা শুনতাম  পদ্মার বুকে জেগে উঠা চর নিয়ে কতই না লড়াই যেত। এ লড়াইয়ে প্রতিনয়তই কেউ না কেউ খুন হতো। এখন আর তেমন চর দখলের গল্প শুনা যায় না। দখল এখন চর থেকে শহরের রাস্তা নির্বাচন বা প্রশাসন সব জায়গায় বিস্তার করেছে। দখলের কথা বললেই প্রথম বলতে হয় আমাদের নির্বাচনের কথা। দেশে এখন পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে এর আগেও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন সহ সারাদেশে উপজেলা ও পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে। বিগত এসব নির্বাচন গুলিতে আমার দেশবাসী উপভোগ করেছিল বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের ভোট কেন্দ্র দখলের মহা-উৎসব। বর্তমানে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমরা যা উপভোগ করছি তাহলে ভোট কেন্দ্র নিয়ে সরকারীদলের লোকেরা নিজেরাই খুনা-খুনিতে লিপ্ত। এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় জীবন দিতে হয়েছে তিন ডজনেরও বেশি মানুষকে। প্রতিদিনই লাশের মিছিলে যোগ হচ্ছে কারো না করো নাম। নির্বাচনের এই দখলবাজিই দেশের সব কিছুই তলে দিয়েছে দখলবাজদের হাতে।

বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনটা কেন জানি ভীষন খারাপ হয়ে যায় একসময় এই বুড়িগঙ্গার কতইনা সাঁতার কেটেছি আজ এই বুড়িগঙ্গার মৃত্য প্রায় এর পাশদিয়ে যাওয়ার সময় নাকে কাপরের কোন বিকল্প নাই। বুড়িগঙ্গার মাঝ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে কেউ কেউ। পাকা বাড়ী কারখানা দোকান হিমাগার ইটভাটা বা বালির ভিটি সবই হয়েছে বুড়িগঙ্গাকে দখল করে। শুধু বুড়িগঙ্গার কথাই বলছি কেন শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ মেঘনা কিংবা ধলেশ্বরী সবই তো মরতে বসেছে দখলের অত্যাচারে। ঢাকার শহরের ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথের প্রায় সবটাই চলে গেছে দখলদারদের কবলে। ফুটপাত দিয়ে যেখানে সাধারন মানুষের হাটাচলার কথা তা না হয়ে ওখানে হয়েছে নানা পণ্যের দোকান। ঢাকার শহরে ফুটপাত থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার ও অনেক বেশি যায় মাস্তান, রাজনৈতিক নেতা পুলিশের পকেটে।

ঢাকা শহরের ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ দুই মেয়রের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে উচ্ছেদ বিকালে দখল, বিকালে উচ্ছেদ তো রাতেই দখল। উচ্ছেদ অভিযান এখন সিটি কর্পোরেশনের দৈনিক কর্মসূচির অংশ হলেও কোন ভাবেই দখল মুক্ত রাখতে পারছে না ঢাকার শহরের ফুটপাত। কিছু দিন আগে আমারা দেখেছি ঢাকা উত্তরের মেয়র মহদোয় কি না বিপদে পরেছিলেন তেঁজাগাও এ ট্রাক ওলাদের সড়াতে এসে। শেষ পর্যন্ত বেচারা নিরাপদ স্হানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফুটপাতের পাশিপাশি দখলে হয়ে গেছে ফুট ওভার ব্রীজ পর্যন্ত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল দখল এটার জন্ম হয়েছিল আমাদের পূর্বের সামরিক সরকারদের আমালে। এই হল দখল নিয়ে কত মেধাবী ছাত্রকেই না জীবন দিতে হয়েছে । তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নাম করে নিলজ্জভাবে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলির হল দখল। আজ এই দখল আর হল দখলেই সীমাবদ্ধ নয় দখল হয়ে যাচ্ছে সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র সংগঠন আজ দখল করে নিয়েছে দেশের সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আর এই দখলদারিত্বের কাছেই ধ্বংস হতে চলছে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্হা। টেন্ডারবাক্স দখল করে নিয়ে সরকারি দলের লোকেরাই ভাগা ভাগি করে নিচ্ছে নানা কাজের টেন্ডার রড আর সিমেন্টের পরিবর্তে বাঁশ আর বালি দিয়ে ই নির্মান হচ্ছে বহুতল দালান।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বি-৪৯৪ রেজিস্ট্রেশনের পরিবহন শ্রমিক সংগঠনটি পর্যন্ত বেমালুম বেদখল হয়ে গেছে। সরকারি কাগজপত্রে আলহাজ সফর আলীকে সভাপতি বলা হলেও অন্য চাঁদাবাজ গ্রুপ গোটা সংগঠন গিলে খেয়ে বসে আছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০০টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের শাখা-প্রশাখা ইউনিট কার্যালয়ের নামে দেড় সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা গজিয়ে উঠেছে। ঢাকার গুলশান-বনানী ও উত্তরার অভিজাত এলাকায় দখলবাজদের কৌশল ভিন্ন। সেখানে পাকিস্তানিদের অনেক বাড়িকে 'বিহারিদের সম্পদ' দেখিয়ে দফায় দফায় দখল-পাল্টা দখল হয়। পুরান ঢাকায় একজনের জায়গা-জমি, বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই অন্যজন দখল করে নিচ্ছে।

দখল হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় হল, ভোটকেন্দ্র, টেন্ডারবাক্স, প্রেসক্লাব, বাস-লঞ্চ টার্মিনাল, সরকারি খাসজমি, লেক, রেলের জমি, এমনকি পাহাড় পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। গেল এক দশকে দখলে গেছে রাজধানীর অন্তত ১২টি মাঠ ও শিশুপার্ক। রাজধানীর শিশুরা এখন খেলার জায়গা খুঁজে নিচ্ছে কম্পিউটারে, মোবাইলে। ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথের মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটারই এখন অবৈধ দখলে। এসব সড়ক দখল করে তা ভাড়া দিয়ে অর্জিত টাকার অংশ পৌঁছে যাচ্ছে উপর মহলে। অনেক সাবেক নেতা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত দখল করে নেন।

দখলবাজির ধকল থেকে শিল্প-সংস্কৃতি, সামাজিক কর্মকাণ্ডও রক্ষা পাচ্ছে না। একজনের নাট্য সংগঠন, আবৃত্তি পরিষদ পর্যন্ত অন্যজন দখল করে নিচ্ছেন। ফুটপাথ-রাস্তার দখলবাজি চলছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। ফুটপাথের হাজার হাজার দোকান থেকে দিনভিত্তিক চাঁদা তুলে চাঁদার টাকার সিংহভাগ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে গডফাদারদের কাছে।