বঙ্গবাহাদুরের মৃত্যু ও আমাদের অক্ষমতা

ওয়াসিম ফারুক
Published : 16 August 2016, 07:56 PM
Updated : 16 August 2016, 07:56 PM

বেশ কিছু দিন যাবৎ একটা হাতি ও বাগেরহাটের রামপালে কয়লা ভিত্তিক উৎপাদন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে । বাগের হাটের রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মানের প্রতিবাদে আজ সমগ্রজাতি প্রায় একত্রিত । রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের কাথায় যাওয়ার আগে আমি বলতে চাই ঐ হাতিটি কথা যেই হাতিটা গত ২৮ জুন ভারতের আসাম থেকে বন্যার পানিতে ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যাকে উপাধি দেয়া হয়েছিল " বঙ্গ বাহাদুর " । দীর্ঘ একমাস নদ নদী বালুচড় পেরিয়ে গত ২৭ জুলাই " বঙ্গ বাহাদুর " খেতাবে ভূসিত হাতিটি যখন ঢোকে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলায় এর পর ই হাতিটিকে বশে আনার জন্য তৎপর হয়ে উঠে প্রশাসন । হাতিটি উদ্ধারে জন্য ভারতের আসাম থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল ও এসেছিল বাংলাদেশে , তারা কোন উপায়ন্ত না করতে পারে খালি হাতেই ফিরে যায় নিজ দেশে । এর পরের চেষ্টা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর। আমাদের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মীরা বেশ কেয়েক দিন চেষ্টা করে বশে আনতে অর্থাৎ উদ্ধার করতে পারেনি হাতিটিকে । বরং তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে দায়িত্বে অবহেলা সহ ব্যর্থতার অভিযোগ । হাতিটি মারা যাবার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে স্হানীয়রা আভোযোগ " বন বিভাগের লোকজন এসে হাতিটাকে মেরে ফেলছে " । অবশ্য আমাদের বনবিভাগের কর্মীরা তাদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়েই হাতিটিকে বসে আনার চেস্টা করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।নানা চেষ্টার পর ১১ আগস্ট প্রথম বার হাতিটিকে ট্র্যাঙ্কুলাইজারগানের মাধ্যমে অচেতন করা সম্ভব হয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্মীদের তবে প্রথমেই গলদ বাধে তাদের কাজে । ট্র্যাঙ্কুলাইজারগানের মাধ্যমে অচেতন ইনজেকশন পুশকরার বেশ কিছুক্ষণ পর হাতিটি পাশের এক ডোবায় নেমে পড়ে এবং জ্ঞান হারায়। তখন ভেটেরিনারি সার্জন গ্রামের মানুষদের ডাকেন হাতিটিকে উদ্ধার করার জন্য। গ্রামের সাধারন কয়েক শত মানুষ টেনে হেচরে ডাঙ্গায় তুলেন হাতিটিকে এর পর শিকল আর রশি দিয়ে গছের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন হাতিটিকে । এর পর ধীরে ধীরে চেতনা ফিয়ে পেতে শুরু করে বঙ্গ বাহাদুর ।

১৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে শিকল ও দঁড়ি ছিঁড়ে ছুট দেয় বঙ্গ বাহাদুর । বঙ্গ বাহাদুরে পিছনে পিছনে ও ছুটতে থাকেন বঙ্গ বাহাদুরকে উদ্ধারে কর্মীরা টানা দুই ঘন্টায় বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বঙ্গ বাহাদুরকে পুনরায় ট্র্যাঙ্কুলাইজারগানের মাধ্যমে অচেতন করতে সক্ষম হয়েছে উদ্ধারকারী দল। অচেতন হওয়ার পর থেকে সারা দিন কাদাময় খেতে খোলা আকাশের নিচে পড়ে ছিল বঙ্গ বাহাদুর।কয়েকবার চেতনানাশকের প্রয়োগে দূর্বল হয়ে পরে হাতিটি তার উপর খাওয়াদাওয়াও হয়নি। দীর্ঘ ৪৯ দিনের পথচলায় হাতিটি হয়ে পরেছিল শারীরিক ভাবে দূর্বল এর সাথে বাংলাদেশের জনবসতির কাছাকাছি আসার পর থেকেই অত্যন্ত মানসিক চাপের মধ্যে ছিল। হাতিটির শারিরীক দূর্বলতা কাটানোর জন্য নাকি বারো লিটারের মত স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল তাতে ও কাজ হয় নি শেষ পর্যন্ত আর সাফারি পার্কে ফিরে যাওয়া হলো না বঙ্গ বাহাদুরের । একেবারেই না ফেরার দেশে যেত হলো তাকে । হাতি উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, এ ধরনের বন্য প্রাণীকে বাগে আনা বা তাকে বাঁচানোর মতো দক্ষতা আমাদের নেই। উদ্ধারকারীরা তাদের কাজে যথেষ্ট অবহেলা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন ।আর এই অবহেলা ও অদক্ষতার জন্যই জীবন দিতে হলো বঙ্গ বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হাতিটিকে ।

হাতি আর সুন্দর বন একই সূত্রে গাঁথা । ভূচর প্রাণীদের মধ্যে হাতি ই সবচেয়ে বড় আর সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য ই ভারত থেকে আসা ব্যবসায়িরা আমাদের সরকার কে সাথে নিয়ে সুন্দরবনের আতি নিকটে বাগেরহাট জেলার রামপালে নির্মান করতে যাচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র । বিশেষজ্ঞদের অনেকের ই ধারনা রামপালে বিদ্যুৎউৎপাদন কেন্দ্র নির্মান হলে ধ্বংসের মুখো মুখি দাঁড়াবে আমাদের সুন্দরবন । সুন্দরবন রক্ষায় আমি ও বলতে চাই ভারত বা বাংলাদেশের যেখানেই হউক সুন্দরবনের পাশে কোথাও সুন্দরবন ধ্বংসকারী কোন স্হাপনা চাই না যা সুন্দরবন কে শেষ করে দিবে। যদি ও আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তি ও রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মানের সাথে সংশ্লিষ্ট রার রার ই বলে আসছে এতে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবেনা বা ক্ষতির মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখতে তারা সক্ষম । বঙ্গ বাহাদুরের মৃত্যু তাদের সেই সক্ষমতাকে নানা ভাবে নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখিন করেছে । যেখানে আমাদের সরকার ও তার প্রশাসন ভারত থেকে পথ ভুলে আসা একটা হাতিকেই রক্ষা করতে ব্যর্থ সেখানে সুন্দরবনের অতিনিকটে নির্মিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিষাক্ত ছোবল থেকে কিভাবে সুন্দরবনকে রক্ষা করেবেন ? আমাদের সরকার ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের অবহেলার কারনে ভারত থেকে আসা প্রকৃতিপ্রদত্ত হাতি রক্ষায় আমরা যেমন ব্যর্থ হয়েছি ঠিক তেমনি ভারতীয় কোম্পানির সহযোগিতায় সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিতর্কিত বিদ্যুৎ উৎপান কেন্দ্র নির্মান হলে ও আমরা সুন্দর বন রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ হবো । ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের সুন্দরবন । বঙ্গ বাহাদুরের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করেছে কিন্তু সুন্দরবনের মৃত্যু আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সেটাই ভেবে দেখার বিষয় ।