এই মৃত্যুর দায় কার?

ওয়াসিম ফারুক
Published : 17 Sept 2016, 05:33 AM
Updated : 17 Sept 2016, 05:33 AM

ঈদ মানেই আনন্দ। কিন্তু কখনো কখনো কোন ঘটনা ঈদের সব আনন্দকে কান্না তথা চিরকান্নায় পরিনত করে । প্রতি ঈদেই নাড়ির টানে রাড়ী ফেরা মানুষদের মধ্যে কারো কারো রাড়ী ফেরা হয় লাশ হয়ে । এবারের কোরবানির ঈদ ও এর ব্যতিক্রম হয়নি । প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ঘরমুখি মানুষের লাশ হওয়ার সংবাদ । প্রতিটি মৃত্যুই যন্ত্রনাদায়ক প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের কাদায় কিন্তু কোন কোন মৃত্যু মনের ভিতরে যন্ত্রনার বাসাটা গভীর ভাবে বাধে । বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ি ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সাড়াদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে তার মধ্যে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় একটি বাস উল্টে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে তাদের সাবই পোষাক শ্রমিক পরিবার পরিজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তারা ফিরছিল কর্মক্ষেত্রে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই ঈদ ই যে তাদের জীবনের শেষ ঈদ তা তারা কোন ভাবেই স্বপ্নেও ভাবেন নি । তবে যে দূর্ঘটনা আরো বেশি ব্যথিত করেছে তা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার শশই ইসলামপুর এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দূর্ঘটনা যাতে জীবন দিতে হয়ের অন্তত্য আটজনকে এতে একই পরিবারের পিতা পুত্র সহ চার জনকে জীবন দিতে হয়েছে । মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রুপশপুর গ্রামের হাদিউর রহমান ছেলে আবু সুফিয়ান কে বিয়ে করানোর জন্য মাইক্রোবাস যোগে সাথে আরো দুই ছেলে ভাই বেরাদর নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন কণে দেখার জন্য । হাদিউর রহমানের আর ছেলের জন্য কণে দেখা হলো না আবু সুফিয়ানের ও বর হয়ে বিয়ে করার আশা পূর্ন হলো সাথে জীবন দিতে হলো আবু সুফিয়ানের দুই ভাই সহ আরো কয়েক জন আত্মীয়কে । হাদিউর রহমানের বাড়ীতে আজ যেখানে আনন্দের বণ্যা বয়ে যাওয়ার কথা সেখানে শুধুই এখন শোকের মাতাম । সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশের একটি নিত্যদিনের ঘটনা । প্রতিদিন ই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা পরিবারের আপন জনকে হারিয়ে শোকে মাতাম করতে হয় কোন না কোন পরিবার কে । আমাদের দেশে এই ঘটনা কে 'সড়ক দুর্ঘটনা' বলে চালালে ও আমি তা মানতে নারাজ। আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া তথাকথিত সড়ক দুর্ঘটনা গুলি কখনোই দুর্ঘটনা বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। প্রতিটি দুর্ঘটনাই ঘটছে কারো না কারো অবহেলার কারণে। তাই কারো অবহেলার কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাকে কি কোন ভাবেই দুর্ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা যায়? তারপরও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে আমিও এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রশিক্ষিত চালকের অভাব সেই সাথে আমাদের বেহাল রাস্তাতো আছেই। বৈধ লাইসেন্স ছাড়া চালকের আসনে বসে যাওয়ার ঘটনা যেন কোন ঘটনাই না। সূত্র মতে দেশের ৬১ শতাংশ চালক পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স নিচ্ছেন, অন্যদিকে দেশের ১৬ লাখ চালক বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছেন, আর তারা যে গাড়ি গুলি চালাচ্ছেন তার বেশির ভাগই চলাচলের অনুপযোগী লক্কড়-ঝক্কড় কোম্পানির গাড়ি। ফিটনেসবিহীন কত যানবাহন যে দেশের সড়কপথে চলাচল করছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো কারোই দেয়া সম্ভব নয়। আর যারা প্রশিক্ষিত চালক তারা ও বাড়তি আয়ের আশায় লাগাম হীন ভাবে ডিউটি দিয়ে যাচ্ছেন । গত ২০ এপ্রিল রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকুরচালী এলাকায় ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন দিতে হয়েছে অন্তত তেরজন মানুষকে।সেদিন সৈয়দপুর থেকে রংপুরগামী তৃপ্তি পরিবহণ ও কুমিল্লা থেকে সৈয়দপুরগামী সায়মুন পরিবহনের সংঘর্ষ হয়। যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী চালক রাত এগারটার সময় কুমিল্লা থেকে সায়মন পরিবহনের বাসটি চালিয়ে আসছিল প্রায় বারো ঘন্টা চলানোর পর রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকুরচালী এলাকায় এসে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় বাসটি পথিমধ্যে চালক প্রায় নিদ্রাচ্ছন্ন চোখে ঝুমছিলেন এমন কি যাত্রীদের অনুরোধে বেশ করেক বার চোখে মুখে জল ও ছিটিয়ে নিয়েছিলেন চালক । বছরের বিশেষ কিছুসময় একজন বাস চালককে টানা ৩৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয় । কখনো কখনো সেটা ৫০-৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওঠে। এ সময় তাঁদের নাওয়া-খাওয়া নেই এমনকি ঘুমও।

বাংলাদেশের সব অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মতো বাসচালকদেরও মজুরিটাই সম্বল। সারা জীবন গাড়ি চালিয়ে অবসরে গেলেও তাঁদের যেই কপাল সেই মাথা । জীবনের সাথে সংগ্রাম করে জীবনের শেষার্ধে এসে লন্হানা ছাড়া আর কিছুই জোটেনা এই পরিভন শ্রমিকদের । ছোট পরিবহন কোম্পানিগুলোর চালকদের অবস্থা তো আরও করুণ। কাজ না করতে পারলে জোটেনা পরিবার পরিজনের মুখে অন্ন। তাই তাঁরাও জীবন বাজী বারতি কিছু আয়ের আশায় এভাবে রাস্তায় নেমে যান। আমরা এই বাজীগরদের হাতে জীবনটা সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাসে বসে সুখনিদ্রায় কখনো গন্তব্যে পৌছতে পারি আবার কখনো চিরন্দ্রায় পারিজমাই পরোপারে।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহত হওয়ার পর অবৈধভাবে লাইসেন্স নেওয়া অদক্ষ চালকদের কারণে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের বিষয় নিয়ে যখন দেশবাসী ক্ষুব্ধ, তখনই তৎকালীন সময়ের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, 'গাড়ি চালানোর জন্য শিক্ষা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, চালকদের কিছু চিহ্ন চিনতে পারলেই হয়।' আমার মনে হয় মন্ত্রীর সেই কথা মতই কিছু চিহ্ন জানা লোক গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) তথ্যমতে, ২০১৫ সালে সারাদেশে ২ হাজার ৬২৬ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এই দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩ জন মারা যান, আহত হন ৬ হাজার ১৯৭ জন। আর ২০১৪ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২ হাজার ৭১৩টি এতে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৮২ জন। ২০১৫ সালে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই সংখ্যা ৩৫৯। এর মধ্যে রাজধানীতেই নিহত ২২৭ জন আর সবচেয়ে কম ২৮ জন মারা যান কুষ্টিয়া জেলায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ি ২০১৫ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৫৮১টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হন; আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।আর ভিন্ন এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের একটি সূত্রে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার লোক পঙ্গু হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গত বছর পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪৭ হাজার ৪৩৭ জন এবং ২০১৪ সালে ৪৬ হাজার ৫৮৪ জন চিকিৎসা নেয়। এদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশের চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। পরিসংখ্যান যাই বলুক আমাদের দেশে যে মানুষের একটি বড় অংশের অকাল মৃত্যুর কারণ যে সড়ক দুর্ঘটনায় এটা অস্বীকার করার উপায় বোধ হয় কারোই নেই।

সড়ক ও সড়কে গাড়ি থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে এটা অস্বীকার কোন উপায় নেই । পৃথিবীর এমন কোন দেশ নাই যেখানে সড়ক দূর্ঘটা না হয়ে । তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে সড়ক দূর্ঘটনার নানান যৌকতিক কারণ থাকে । তবে আমাদের দেশে সড়কে যে দূর্ঘটনা গুলি ঘটছে তার কতটা যৌকতিক কারন আছে সেটাই বড় প্রশ্ন ? আর যৌক্তিক কারণে বা সত্যিকার অর্থেই যে ধরনের দূর্ঘটনা গুলি ঘটে তাই আমরা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারি না বা পারছিনা । আর সেই না মেনে নেয়াটাই স্বাবাভিক । হাজারো অঘটনের কাছে একটি দুইটি বাস্তবতা মোটে ও গ্রহন যোগ্য হতে পারে না । তাই আমাদের দেশে সড়ক ও মহাসড়ক গুলিতে প্রতিনিয়ত মানুষের জীবন নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে তার দায় ভার সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিভাবে এড়িয়ে যাবে এটাই বড় প্রশ্ন?