এখনই বন্ধ করতে হবে সীমান্ত হত্যা

ওয়াসিম ফারুক
Published : 28 Sept 2016, 07:10 PM
Updated : 28 Sept 2016, 07:10 PM

ভারত আমাদের সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান কোন ভাবেই অস্বীকার করার মত নয়। স্বাধীনতার পর নানা অপদে বিপদে আমরা বাংলাদেশীরা পাশে পেয়েছি ভারতকে। আজো আমরা মনে করি ভারত আমাদের পরম বন্ধু রাষ্ট্র কিন্তু বন্ধুর বন্দুকের বুলেট যখন আরেক বন্ধুর বুকের রক্ত ঝরায় তখন সেখানে বন্ধুত্বের আন্তরিকতা নিয়ে উঠে নানা প্রশ্ন । বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত যেন এক মৃত্যু পুরি কেউ কেউ আবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে এশিয়ার বধ্যভূমি হিসেবে ও আখ্যায়িত করেন । যদিও দুই দেশের কর্তাব্যাক্তিরা প্রায় ই মিটিং করেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েই বলছেন যে ভাবেই হউক সীমান্তে এই ধরনের হত্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে কিন্তু ঐ কথা কেন জানি আমাদের জন্য শুধুই আশার বানী । গত এক সপ্তাহে ও কুড়িগ্রাম ও ঝিনাইদ সীমান্তে দুই বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যাকরেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহীনি ।গরু চোরাচালানের কারণেই নাকি সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব নয় এমন তত্ত্ব আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ শুনে আসছি ।তবে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এর এক ঘোষনার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে । অবশ্য তার প্রমান এবারের কোরবানীর ঈদের ও আমরা দেখেছি । ঢাকা সহ সমগ্রদেশের গরূ হাট গুলি ছিল দেশীয় খামারিদের গরু দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ শেষ পর্যন্ত দেশী খামারিদের গরুর যে কি দামে বিক্রি হয়েছে তা ও আমরা দেখেছি ।গরু চোরাচালানের জন্যই যে সীমান্ত হত্যা হয় তা ভূল প্রমান করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর একটি সংবাদ ১ ডিসেম্বর ২০১৫ সংবাদ মাধ্যমটি একটি সংবাদ পরিবেশন করেন যার শিরোনাম ছিল " কমেছে গরু পাচার, বেড়েছে সীমান্ত হত্যা ! " সংবাদটিতে বলা হয়েছিল বিএসএফকে দেওয়া ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর নির্দেশনার পর গত সাত মাসে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ গরু চোরাচালান কমে গেছে । তবে এর বিপরীতে সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। রাজনাথ সিং-এর ঘোষণার পর ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে নিহত হয়েছেন ২৪ বাংলাদেশী আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ১০ বাংলাদেশি৷

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর তথ্য অনুযায়ি ১ জানুয়ারি ২০০০ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে ১০৮৪ জন বাংলাদেশিকে আর আহত হয়েছে ৯৮৭ জন । আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, গত তিন বছরে অর্থাৎ ২০১৩ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বেড়েছে৷ এই হত্যাকাণ্ড গুলি ঘটছে গোলাগুলি ও নির্যাতনের কারণে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ বাকি একজনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা জানা যায়নি৷এরপর ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ এরমধ্যে গুলি ও নির্যাতনে সমান সংখ্যক বাংলাদেশিকে হত্যা করা কথা বলা হয়েছে৷ গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ৪২ জনকে, আহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে৷ গত তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে৷ ২০১৬ জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই আট মাসে বিএসএফ এর হাতে খুন হতে হয়েছে ২৩ জন বাংলাদেশী কে আর আহত হয়েছে ২৫ জন ।তবে যে চিত্রটি সবচেয়ে অবাক করার মত তা হলো পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত । তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে মোট ১০২ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলেও এই একই সময়ে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৪৬ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হয়৷ নিহত পাকিস্তানি নগারিকদের বড় একটি অংশ সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য৷ তবে বাংলাদেশের নিহত নাগরিকরা সবাই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ৷

ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে যে হত্যাকন্ডটি বাংলাদেশ-ভারত সহ সাড়া বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল তা হলো শিশু ফেলানী হত্যাকান্ড ।৭ই জানুয়ারি ২০১১ কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে ১৫ বছরের এক শিশু ফেলানী কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় জড়িয়ে পা ফসকে ঝুলে পড়েছিল সে। তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করে আবেদন করছিল শিশুটি । বিএসএফ-এর রক্ত পিপাসু ঘাতকরা সে আবেদনের সাড়া না দিয়ে তাকে গুলী করে হত্যা করে তেমনি ঝুলন্ত অবস্থায়ই। ঐ নরঘাতকরা তাকে হত্যা করে তার লাশ নামিয়ে নিয়ে যায়নি। বরং পরবর্তী পাঁচ ঘণ্টা ফেলানীর লাশ ঝুলেছিল কাঁটাতারের বেড়ার ওপরই।বিএসএফ হয়তো সেদিন সমগ্র বাঙ্গালীকে জানান দিতে চেয়েছিল দেখে না্য বাংলাদেশীরা এই সীমান্ত তোমাদের জন্য কতটা ভয়ংকর কাছে এলেই গুলি করে এভাবে মানুষদের জানান দিতে চেয়েছিল যে, সীমান্তের কাছাকাছি এলে এভাবেই গুলি করে কাঁটাতারের বেড়ার ঝুলিয়ে রাখবো । কাঁটাতারের বেড়ার ফেলানীর ঝুলন্ত সেই লাল ছবি ভারত-বাংলাদের বিভিন্ন গনমাধ্যম প্রচারের পর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বিবেকবান মানুষের মনে ।পরে অবশ্য ২০১১ সালে ই বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি স্বাক্ষর করে৷ তার পর হয়তো ভেবে ছিলাম হয়তো আমাদের পরম বন্ধু রাষ্ট্রের বুলেট আঘাত করবে না কোন বাংলাদেশীকে খালি হবে আর কোন মায়ের বুক । কিন্তু আমাদের সেই আশা শুধুই গুড়ে বালি ।

গত কয়েকবছরে সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষ৷ এদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর হাতে৷ অন্যদিকে, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-র গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিকের প্রাণহানির খবর গত কয়েক বছরে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না৷ তার মানে এই নয় যে কোন ভারতীয় নাগরিক অবৈধ ভাবে সীমান্ত পার হয়ে বানঘলাদেশে আসছেনন না । আর যদি বলি চোরাকারবারীদের কথা সে ক্ষেত্রে একই জালে আবদ্ধ ভারতীয় ও বাংলাদেশী চোরাকারবারিবা । আমরা যত টুকু জানি আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি এর হাতে যখনই কোন অবৈধ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারি ধরাপরে তাদের কে নিরাপদে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর হাতে তুলে দেয়া হয় আর বিএসএফ নির্বিচারে গুলি করে হত্যাকরছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ৷ বিএসএফ এর মনোভাবটা এমন যেন তারা সকল জবাবদিহিতার উর্দ্ধে ৷

শুধুমাত্র ভারত- বাংলাদেশর সীমান্তেই কড়াকড়ি এমন টি ই নয় বিশ্বের আরো অনেক দেশের সীমান্তে ই কড়াকড়ি আছে, থাকবে৷অনেক সীমান্তে আবার যুদ্ধ ও চলছে । বাংলাদেশ -ভারত সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের একসময় ছিলাম একত্রে দেশভাগের পর অনেক পরিবার ই আজ বিচ্ছিন্ন ।ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে জেগে উঠেছে কাটাতারের বেড়া৷ বৈধ, অবৈধ পথে সেই বেড়া ডিঙাতে হয় অনেকের জীবনের প্রয়োজনে৷ তাই বলে কি তাদের পাখির মতো গুলি করে মারতে হবে ? তাই দুই বন্ধু রাষ্ট্রের সীমান্তে অসংখ্য প্রাণহানি এটা কোন সুস্হ্য বিবেক মেনে নিতে পারে না বা পারাও কাথা না ৷ আমি বলছি না, ইউরোপের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ-ভারত উন্মক্ত করে দেয়া হোক এমন কি এটা ভাবা ও কল্পনাতীত ৷কিন্তু কেউ যদি আইন অমান্যকরে অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিতে চায় তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হউক ৷ তবে তাদের গুলিকরে হত্যা করা কোন সুষ্ঠ জাতি বা সু-শৃংখল বাহিনীর কাজ বা দায়িত্ব হতে পারে না ৷বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চিরদিন বজায় থাকবে এটা আমাদের সবার ই প্রত্যাশ তবে এ বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে এক্ষুনি৷আর যে কারনে সীমান্তে হত্যা সংগঠিত হচ্ছে তা দুই দেশের সরকার কে খুজে বের করে এর আশুসমাধান করাটাই জরুরী ।