রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে

ওয়াসিম ফারুক
Published : 22 Nov 2016, 02:08 AM
Updated : 22 Nov 2016, 02:08 AM

মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন নতুন কিছুই না। জাতিসংঘের তথ্য মতে বিশ্বের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষই হলো সবচেয়ে বেশি অত্যাচার নির্যাতনের শিকার। এই নির্যাতন কখনো কখনো আবার গণহত্যায় রূপ নেয়। নির্যাতনের থেকে নিজেদের জীবন রক্ষা করতে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই উদ্বাস্ত হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষকে। বর্তমান সময়ে আবারও নতুন করে সেখানে শুরু হয়েছে নির্যাতন ও গণহত্যা।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় এবং সেই অভিযানে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর দাবি, সেনা হামলায় নিহতরা জঙ্গি। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনী। সেখানে যে অভিযান চালিয়েছে তাতে মূলত বেসামরিক নাগরিকই নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি।

গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তের তিনটি চেকপোস্টে নয় জন পুলিশ নিহত হওয়ার পর থেকেই রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। বিশেষ করে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী মংডু তে চলে অভিযানের নামে নির্যাতন আর গণহত্যা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই ঘটনার পর থেকে কথিত হামলাকারীদের খুঁজে বের করার অভিযানে ১৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাড়ি ছাড়া হয়েছে এবং অন্তত ১৩০ জনকে নানা ভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১২০০টিরও অধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। মংডুর উত্তরাঞ্চলীয় একটি গ্রামে গত ১৩ই নভেম্বর অন্তত ৯ জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ওই দিনের পর থেকে ওই গ্রামের আরো ৯০ জন নারী-পুরুষ-শিশুর সন্ধান আজো পাওয়া যায়নি। হাজারো রোহিঙ্গা জীবন রক্ষায় সাগড় পথ সহ নানা পথে যে যেদিকে পারছে সেদিকেই ছুটছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ১৩০ জন রোহিঙ্গা কে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনি। যদিও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

মানুষ মানুষের জন্য এটাই বাস্তব কথা। আমরা বাংলাদেশীরা মানবিকতার জন্য ত্যাগ করতে সর্বদাই প্রস্তুত। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর "নাগামান" ("ড্রাগন রাজা") অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৯১-৯২ সালের দাঙ্গায় প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মিয়ানমার থেকে জীবন রক্ষার জন্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। এরপরও বিভিন্ন সময় নির্যাতিত রোহিঙ্গারা নানাভাবে এসে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন, মিয়ানমারে কি কোন যুদ্ধাবস্থা বা যুদ্ধ চলছে নাকি মিয়ানমার কোন বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত যে ওখান থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের আমাদের আশ্রয় দিতে হবে? মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সাথে যেটা হচ্ছে সেটা হলো জাতিগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা, যা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে জাতিসংঘ সহ অর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় কে এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে কখনোই আমরা দেখিনি। অথচ তাদের কর্তব্য ছিল রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের সীমান্তের দরজা খোলার অনুরোধ না করে মিয়ানমার সরকারের উপর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

মিয়ানমার দীর্ঘদিন সামরিক সরকারের গেরাকলে ছিল। জাতিসংঘ সহ অর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় সবসময়ই মিয়ানমারে কিভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় এনিয়েই সোচ্চার ছিলেন। আমরাও চেয়েছি আমার পার্শ্ববর্তী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রে যেভাবেই হউক অতি দ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হউক। সকলের সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সান সুচির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাভার গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই বিশ্ববাসী আশা করেছিল যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সমস্যার একটা সুরাহা হবে। মিয়ানমারের জনগণ ঐ নির্বাচনকে "মুক্তির সুযোগ" হিসেবে দেখেছিল বটে কিন্তু মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্য এ নির্বাচন যে কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না তা অনেক বিশ্লেষকই ইঙ্গিত করেছিলেন।

সুচি অবশ্য রোহিঙ্গাদের "রোহিঙ্গা" বলতে নারাজ। তিনি দেশটির অন্যতম জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের "বাংলাদেশি বংশোদ্ভূ" হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন যা সত্যি ই দুঃখজনক। তদুপরি রোহিঙ্গাদের সমস্যার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক লোক দেখানোর জন্য হলেও কিছুটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

কিছু দিন আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত কফি আনানের নেতৃত্বে একটি রাখাইন উপদেষ্টা কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাঁদের মূল কাজ হলো নাকি আরাকান সংকটের অবসান ঘটানো। তবে অনেকেরই ধারণা, আনান কমিশন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তেমন ভূমিকা রাখতে পারবেন না। এর বিশেষ কারণই হলো আরাকান ও মিয়ানমারের রাজনীতির কয়েকটি প্রভাবশালী মহল বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা যারা রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে মানেন না, তারা সবাই একযোগে সু চির কফি আনান কমিশন গঠনের তীব্র বিরোধিতা করছেন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির মনোভাবও বিতর্কিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তেমনটিই মনে হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিতর্কিত ভূমিকার কারণেই অং সান সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে অনেক সংগঠন ও মানুষ। চেঞ্জ ডট ওআরজির সু চির নোবেল ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদনে ইতোমধ্যে বেশকয়েক লাখ মানুষ স্বাক্ষর করেছে।

মিয়ানমারের আরাকানে এখন শুধুই মুসলিম রোহিঙ্গাদের লাশের গন্ধ। আরকানের আকাশে বাতাসে শুধুই নিরাপরাধ মুসলিম রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকার। রোহিঙ্গারা যে যেদিকে পারছে জীবন বাঁচাতে ছুটছে। আজ রোহিঙ্গারা অন্ন বস্ত্র বাসস্থানসহ সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি যারা নিজেদের বিশ্ব বিবেক বলে আখ্যায়িত করেন, নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা অযুহাতে মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়ে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যায় অংশ নিয়েছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বরাবরই নিশ্চুপ! এতে করেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সহ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের উপর হামলা নির্যাতন ও হত্যায় উৎসাহ পেয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সমস্যায় দ্রুত হস্তক্ষেপ করা, তা না হলে একটি মানবিক বিপর্যয় বিশ্বের জনগণকে নিরব দর্শক হিসেবেই প্রত্যক্ষ করতে হবে।

লেখক: ওয়াসিম ফারুক, কলামিস্ট