মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন ও ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ

ওয়াসিম ফারুক
Published : 19 Sept 2017, 03:55 AM
Updated : 19 Sept 2017, 03:55 AM

মিয়ানমারের কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ধর্মগুরু অসিন উইরাথুর কথা সবারই মনে আছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিন যার উপাধি দিয়েছিল 'ফেইস অব টেরর' বা সন্ত্রসীর চেহারা। ২০০৩ সালে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে তার ২৫ বছরের জেল হলেও মুসলিমবিরোধী প্রচারণার কারণে ২০০৩ সাল থেকে ৭ বছর জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে কারা মুক্ত হয়ে নিজেকে মিয়ানমারের 'ওসামা বিন লাদেন' হিসেবে প্রচার করেন। ২০০১ সালে থেকেই মুসলিমবিদ্বেষী গোষ্ঠী '৯৬৯ মুভমেন্ট' এর নেতৃত্ব দিয়ে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টায় লিপ্ত আছেন অসিন উইরাথু।

অন্যান্য রাষ্ট্রের মত মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতারাও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চাননি। ক্ষমতায় আধিষ্টিত হওয়ার জন্য ধর্ম একটি বিশেষ মাধ্যম, তাই মিয়ানমারের সামরিক ও তথাকথিত গনতান্ত্রিক সরকার তার দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের মতের বাইরে যেতে পারেননি। তারাও নানা কৌশলে মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতি গোষ্ঠিকে সন্তষ্ট রাখার যথা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতনের সূচনা সেই ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর থেকেই। এর পর ১৯৭৮, ১৯৯১, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ভয়াবহ নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যার সংখ্যা আজ প্রায় আট লাখেরও বেশি।

নির্যাতনের মুখে সব হারিয়ে এভাবে দলে দলে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা

২৫ আগস্ট ২০১৭ মিয়ানমারের পশ্চিম-উত্তর প্রদেশ রাখাইনে নবগঠিত আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (আরসা) বুথিডংসহ কয়েকটি জায়গায় সশস্ত্র হামলা চালায়। ওই হামলার পর থেকেই নতুন করে মূলত উত্তর রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক ও সীমান্ত পুলিশ বাহিনী এবং রাখাইন অঞ্চলের বৌদ্ধ চরমপন্থীরা নৃশংস অভিযান চালাচ্ছে। এতে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে, নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে লাখ লাখ মানুষ জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ এসে জীবন রক্ষা করেছেন।

সম্প্রতি মিয়ানমারের শাসকদের এই অভিযানকে হত্যাযজ্ঞ ও এথনিক ক্লিঞ্জিং বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও একে 'গণহত্যা' বলে আখ্যায়িত করেছে। যদিও মিয়ানমারের তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সান সুচি আরসার আক্রমণকে জঙ্গি হামলা বলে আখ্যায়িত করলেও মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাত নতুন নয়। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বার্মায় জাতিগত সংঘাতের জন্ম। তবে ১৯৬২ সালের সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখল এবং বার্মা ইউনিয়ন বাতিলের পর এই সংঘাত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ওই সময় বার্মার সামরিক বাহিনীতে কারেন, চীন, কাচিনসহ অন্যরা সামরিক বাহিনী থেকে তাদের সদস্যদের প্রত্যাহার নিজ নিজ বাহিনী গঠন করে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যার প্রভাব পড়ে রাখাইন রাজ্যে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপরও। বর্তমানে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমরে আটটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত। আতীতের আরএসও এবং বর্তমানের আরসা শুধু তাদের নাগরিকত্বের দাবির জন্য মাঠে নেমেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমার সরকার যে নিধন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপের প্রতি তার বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারে সমরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ মৌলবাদীরা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশ। হয়তো মিয়ানমরের ধারণা বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে দুর্বল। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি গত করেক দিনে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ও ড্রোনের আকাশ সীমা লংঘনের মধ্যদিয়ে।

রোহিঙ্গা বিষয়ে সন্তোষজনক সমাধান না হলে এই দুই দেশের সম্পর্ক শত চেষ্টাতেও ভালো হওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যেহেতু শান্তিতে বিশ্বাসী তাই পরশীদের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখাই আমাদের কাম্য। তবে নিজেদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার খাতিরে বাংলাদেশকে আরও শক্ত অবস্থানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকেই রাজনীতির বাহিরে এসে জাতীয় এই সংকট মুহূর্তে একত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। সরকারের উচিত হবে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন এর মাধ্যমে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা।