মানবিকতার বাংলাদেশে দানবিকতা কেন?

ওয়াসিম ফারুক
Published : 2 Oct 2017, 08:10 AM
Updated : 2 Oct 2017, 08:10 AM

বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে এক নতুন রূপে পরিচয় পেয়েছে। কিছুদিন আগেও বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচয় মিলত বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, দুর্নীতি ইত্যদি বিষয়ে। মানব পাচারের দেশ হিসেবেও পরিচয় মিললো বাংলাদেশের যখন কিনা থাইল্যান্ড মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া হাজারো হতভাগা মানুষের গণকবরের সন্ধান মিললো। ইসলামিক উগ্রবাদীদের দ্বারা একের পর এক ব্লগার লেখক প্রকাশ হত্যা সেই সাথে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভিন্ন মতার্দশ ও ভিনদেশী নাগরিকদের হত্যায় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ পরিচয় মিলতে থাকে ইসলামিক উগ্রবাদীদের নিরাপদ ভূমি হিসেবে।

সবকিছু ছাপিয়ে এবার বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচয় মিলেছে মানবিকতার দেশ হিসেবে। মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী সেই সাথে সে দেশের বৌদ্ধ উগ্র মৌলবাদীদের জাতিগত নিধনের কৌশল হিসেবে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষ। আজ পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশ্বমিডিয়া ও রাজনীতি।

এত মানবিকতা এত সহনশীলতার মাঝেও আমাদের দেশের ভিতর মানুষ রূপী কিছু দানবের আবির্ভাব হয়। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যে যেদিক দিয়ে যেভাবেই পারছে বাংলাদেশের আসছে। তাদের একটি অংশ সমুদ্র পথে নৌকায় পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি নৌকাডুবির ঘটনায় জীবন দিতে হয়েছে প্রায় শ' খানেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আর শিশুকে।

বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব নৌকা ডুবির ভয়ংকর কাহিনী। প্রায় সবকটি নৌকাডুবির ঘটনাই ইচ্ছাকৃত। রোহিঙ্গাদের নাফ নদী পার পারের বাণিজ্যে লিপ্ত টেকনাফের স্থানীয় কিছু দালাল চক্র। এই চক্রে নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত জড়িত। এই দালাল চক্র নদী পারাপারের নাম করে অসহায় রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। রোহিঙ্গারা দালালদের চাহিদা মত টাকা দিতে ব্যর্থ হলেই ঘটছে নৌকা ডুবির ঘটনা। এতে জীবন দিতে হচ্ছে অনেক শিশু ও নারীদের।

এছাড়াও একশ্রেণীর স্থানীয় দালাল সরকারী জমি কিংবা পাহাড়ে বোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ভাবে ঘড় তুলে দেয়ার কথা বলে আদায় করছে টাকা, এমনকি কোন কোন দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যেতে ও বিদেশ পাঠানোর নাম করে আদায় করে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। আর গুটি কয়েক দালালের এহন কর্মকান্ড ম্লান করেতে বসেছে আমাদের সরকার ও সাধারণ মানুষের সমস্ত অর্জন। এতো গেল রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের দেশের কিছু দানবের কথা।

আমাদের ভিতর আরো কিছু দানব আছে যারা বারা বার প্রশ্নের মুখে ফেলছে আমাদের মানবতাকে আমাদের উদারতাকে আমাদের সভ্যতাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব দানবদের হাতে বিশেষ শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। একদিকে এসব দানবেরা যেমন নারী ও শিশুদের ধর্ষণের উল্লাসে মেতে উঠেছে অন্য দিকে জনসম্মুখে শিশুদের পিটিয়ে বা পায়ু পথে বাতাস ঠুকিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় হত্যা করছে। সিলেটের রাজন খুলনার রাকিব বরগুনার রবিউল লক্ষ্মীপুরের আলাউদ্দিন রংপুরের আতিক এমন অনেক শিশুর জীবনই কেড়ে নিয়েছে আমাদের সমাজে থাকা ঐ সব দানবেরা।

২০১৫ সালের ৮ জুলাই মোবাইল ফোন চুরি করেছে এমন সন্দেহে সিলেটের শেখপাড়ায় কিশোর রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ৩ আগস্ট খুলনায় গ্যারেজ থেকে চাকরি ছাড়ার অপরাধে শিশুশ্রমিক রাকিবকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছর বরগুনার তালতলীতে মাছ চুরির অভিযোগ এনে রবিউল নামের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার অপরাধে বেকারি কারখানার শিশুশ্রমিক আলাউদ্দিনকে পিটিয়ে হত্যা করে বেকারির মালিকসহ আরও কয়েকজন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে আতিক নামের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করে তার চাচা।

সম্প্রতি এমন ই নৃশংস খুনের তালিকায় যোগ হয়েছে ময়মনসিংহে সাগর ও বগুড়ার রাসেলের নাম। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় চোর সন্দেহে সাগর নামের ষোল বছর বয়সী দরিদ্র ফেরিওয়ালা বাবার সন্তান সাগরকে পানি তোলার কাজের মোটর চুরির অভিযোগ এনে আক্কাস নামের এক হ্যাচারি মালিক ও তার সহযোগীরা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। নির্যাতনকারীরা সাগরকে হত্যার পর তার লাশ একটি কাশবনের মধ্যে রেখে পালিয়ে যায়।

বগুড়ায় কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে রাসেল মিয়া নামে উনিশ বছরের এক যুবককে হত্যা করেছে তারই সহকর্মী। বগুড়ার কাহালু উপজেলার বীরকেদার এলাকায় এবিসি টাইলস নামে একটি সিরামিক কারখানার শ্রমিক রুবেল হোসেন নামের সহকর্মী রাসেল মিয়ার পায়ুপথে জোরপূর্বক বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাসেল অসুস্থ হয়ে পড়লে কারখানার লোকজন তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে রাসেল। যদিও পুলিশ সাগর ও রাসেলের খুনিদের খুব তাড়াতাড়িই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।

রাজন ও রাকিব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশ বিদেশে থাকা সকল বাংলাদেশীর ভিতরেই যন্ত্রণা দিয়েছিল। এই নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ায় রাজনের মূল হত্যাকারীকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে বাধ্য হয় সরকার। রাজন হত্যা মামলায় প্রধান আসামিসহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রাকিব হত্যা মামলায় দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে যদিও উচ্চআদালত রাকিবের দুই হত্যাকারীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছে কিন্তু রাজন হত্যাকারী চার জনের মৃত্যুদণ্ড আজও কার্যকর হয়নি। আসহায় রোহিঙ্গাদের নৌকাডুবিয়ে হত্যা ছোট্ট শিশুটিকে সামান্য চুরির অপবাদ এনে পিটিয়ে কিংবা কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা এটা কোন সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না বা মেনে নেয়ারও কথা না।

তাই আজ যারা আসহায় রোহিঙ্গাদের জিম্মিকরে নৌকাডুবিয়ে মারছে কিংবা সমান্য অযুহাতে নানা ভাবে শিশুদের হত্যাকরছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ যে মানবিক দেশ হিসেবে পরিচয় মিলেছে সেই পরিচয় ধরে রাখা সম্ভব হবে না।