মেঘালয়ের মায়াবতী

জাফর ইদ্রিস
Published : 1 Nov 2011, 05:08 PM
Updated : 1 Nov 2011, 05:08 PM

গ্রামের নাম বালি গাঁ,ডাকঘর মুন্সির হাট
থানা হালুয়াঘাট,জেলা মোমেনশাহী
আসামের মেঘালয়ের পাদদেশে
পাহাড়ি ললনা মায়াবতী।
বাবা পাঠশালায় পড়ান
যতদূর মনে পড়ে
মাতা গৃহিনী,
দুই ভাই,
এক বোন
সুখের
সংসার।

সে অনেক দিন আগের কথা। অজপাড়া গাঁয়ের ছেলে কলেজ জীবন শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য বের হই ঘর থেকে। অবশেষে খোদ রাজধানীতে। এক সময় মনে পড়ল এক বন্ধুর কথা যিনি বয়সে বছর পাঁচেক বড় চাকুরী করে বিডিআরে। জিলা ময়মনসিংহ,থানা হালুয়াঘাট ডাকঘর মুন্সির হাট,গ্রাম বালু গাঁ। এতটুকু খামে লিখা ঠিকানার সূত্র ধরে ছুটে যাই বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমানা হালুয়াঘাটে সেই সীমান্ত প্রহরীর ছোট ভাইয়ের সূত্র ধরে একদিন পৌঁছে গেলাম মায়াবতি পাহাড়ি ললনার আশ্রমে। সেই সুখ স্মৃতি আজও পোড়ায়। স্মৃতি রোমাঞ্চে ব্যথা নিরসনে আজ আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াশ।সকাল বেলা কমলাপুর রেলে স্টেশনে গেলাম গন্তব্য ময়মনসিংহ। জীবনের প্রথম রেল ভ্রমণ। রেল বিহীন জেলার অধিবাসি। দুপুরে ময়মনসিংহ পৌঁছলাম,রিক্সায় শম্ভুগঞ্জ ঘাট তারপর বাসে হালুয়াঘাটে, সন্ধ্যায় হালুয়া ঘাট । এখনও দশ বার মাইল বাকি বালি গাঁ বিডিআর ক্যাম্প পৌছাতে। কাঁচা রাস্তা পায় হাঁটা পথ । বৃষ্টি হচ্ছে ,রাস্তায় হাঁটু সমান কাঁদা, অন্ধকার রাত।সময়টা ১৯৭৫ পরবর্তী।সীমান্ত অনেক স্থানের বিডিআর চেক পোষ্ট,তল্লাসীর সম্মুখীন হতে হল বহুবার।বালিগাঁও বিডিআর ক্যাম্পে পৌঁছলাম রাত দশটায়।হাটু কাঁদা,কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ,হাতে জুতা। গেটে পরিচয় দেয়ার পর জানা গেল বন্ধুটি কিছু দিন আগে বদলি হয়েছে অন্য ক্যাম্পে। শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।ডেকে নেওয়া হলো ক্যাম্প অফিসে। ওয়ারলেসে বন্ধুটির সাথে কথা হল এরই মধ্যে তার এক ঘনিষ্ট সৈনিক বন্ধু আমার কাছে ছুটে আসলেন যার কথা ইতিমধ্যে বন্ধুটি ওয়ারলেসে বলেছিলেন ।আমি যেন তার তত্ত্বাবধানে থাকি। যথেষ্ট সমাদর করা হল। এলাকাটা ছিল ভারতের আসাম প্রদেশের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে একটা অনুন্নত এলাকা।ক্যাম্প অফিসটি ছিল একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাঁচা টিনের ঘর,সৈনিকেরা থাকে গ্রাম্য বাসিন্দাদের বাড়িতে। কিছু দূরে পাহাড়ের ঢালুতে ভারতীয় বিএসএফ এর ক্যাম্প । কতক্ষণ পর পর গর্জে উঠছিল কামানের গোলার আওয়াজ ভীষণ ভয়ও লাগছিল। সময়টা ছিল যেহেতু পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক তেমন ভাল ছিলনা।রাতে বন্ধুর সৈনিক বন্ধুটির সাথে রইলাম। সে আমাকে আমার বন্ধুটির পারিবারিক কিছু প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নের ধরন বুঝে আমি সতর্ক হলাম। প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল,সে বিবাহ করেছে কিনা? সকাল বেলাই বন্ধুটি আসলেন । বন্ধুটির সাথে আলাপচারিতায় জানলাম এক প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকের মেয়ের সাথে তার বিবাহ ইতিপূর্বে ঠিক হয়ে আছে। আমাকেই তার ছোট ভাইয়ের ভুমিকা টি পালন করতে হবে। ছোট ভাইয়ের পরিচয়ে সেই বাড়িতে চলে গেলাম।

রাতের বেলা প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। দেখলাম যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি । আসামের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল সমভূমিতে নেমে আসছে সে এক অপূর্ব দৃশ্য। পানির সাথে পাহাড়ি বড় বড় গাছও চলে আসছে। আবার স্থানীয় লোকেরা মোটা রশি দিয়ে গাছগুলো স্থানীয় গাছে বেঁধে আটকাতে চাচ্ছে। কখনও বা সফল হচ্ছে । ছোট ছোট নদী গুলো হিংস্র বাঘের গর্জনে মত আওয়াজ তুলে দ্রুত বইছে। সকাল দশটায় বন্ধুটি হবু শশুর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে কাল বিলম্ব না করে কর্ম স্থানে চলে গেলেন। যেহেতু সামরিক বাহিনীর চাকুরী। ইতিপূর্বে হবু জামাইর ছোট ভাইয়ের আগমন বার্তাটি সবাই জেনে গেছে।মায়াবতির প্রতিক্ষার প্রহর গুনছি তাদের বৈঠক খানায়, কখন আসবে স্বপ্নের মায়াবতি যাহার নাম শুনেছি,সে এক অপরূপা পাহাড়ী ললনা।তার দশ বছরের ছোট্ট ভাইটি ততক্ষণ আমার সঙ্গ দেওয়ার কার্য টি করে যাচ্ছিল।

সড়কের পাশেই বাড়িটি মোটামুটি বৃক্ষহীন দুএকটা নতুন সুপারি গাছ। ঘরের পাশে বৃহদাকার একটি বাতাবি লেবু গাছ। একটি চৌচালা বসত ঘর ও তৎসংলগ্ন একটি রান্নাঘর,নাতি দূরে পানি শূন্য একটা পুকুর।পাহাড়ী পুকুর বৃষ্টির পরে পানি শূণ্য হয়ে যায়।দূরে আকাশ ছুয়ে দাঁড়িয়ে মেঘালয় পাহাড়,বুকে রাশি মেঘ মালা। থেকে থেকে বি এস এফ এর ভারী কামানের গোলা মাঝে মাঝে জানান দিচ্ছে ,হুশিয়ার,সাবধান। বিডিআর জোয়ানরা ও সমান তালে জবাব দিয়ে যাচ্ছে।

একটি চিরকুট লিখে তাঁর ছোট ভাইটিকে দিয়ে পাঠালাম যার বিষয় বস্তু ছিল তুমি আমার ভাবী হবে কি আনন্দ মনে তোমায় দেখার জন্য গভীর আগ্রহে বসে আছি ইত্যাদি। ইতি পূর্বে তাঁর বাবা এসে পরিচয় পর্ব সেরে গেছেন। এক সময় ডালায় হরেক পিঠা পায়েস সাজিয়ে স্বর্গের অপ্সরা মায়াবতি হাজির হলেন এক অপরূপা রশ্মি ছড়ায়। মুহূর্তটি ধারন করে বর্ণনা করা এ অধমের সাধ্যাতীত। শুধু এতটুকু বলব যে ছোট ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয়ের মানসে এসে তা স্বার্থক রুপ নিল,শ্রদ্ধাবনত হল আপাদ মস্তক,পরিসমাপ্তি ঘটল পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধান্তে। প্রথম দর্শনেই ছোট ভাইটিকে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। স্মৃতি ঝাঁপসা হয়ে গেছে। বন্ধুটির শুভ কর্মটি দুদিনের মধ্যে সম্পন্ন হলো,সপ্তম দিনে আমার বিদায় ক্ষণটি এসে গেল।ভাবী দুয়ারে দাঁড়ায়ে। মনে মনে ভাবলাম, কে তুমি এলে মোর
জীবনে কী মাল্য দিব তোমায় বরণে হাজার সালাম তোমার চরণে।এই অজানা অচেনা বিভুঁইয়ে ধন্য আমি তোমার পরশে এতটুকু বোধ হয়নি যে আছি প্রবাসে।বাহির হইব যখন পথে এসে দাঁড়াল সে দুয়ারে,জড়ায়ে ধরল দুহাতে,বলল আবার আসবে ফিরে কথা দাও মোরে। হারিয়ে গেলাম ক্ষণিকের মায়ায়,বললাম আমি আঁখি ইশারায়,আসবো কথা দিলাম তোমায়।আজও সেই বিদায় বেলার কাঁদো আঁখির মেলা ,বাড়িয়ে দিল হৃদয় জ্বালা।*ঢাকায় ফিরে ভাবিকে পদ্যে যে চিঠিটা লিখেছিলাম সেটি হুবহু নিম্নে দিলাম ।

*ভাবী,
কি দিয়ে তোমায় পুঁজিব দেবী
আমার লিপি কাতে
সদা তুমি লুকিয়ে থাকো
আমার আঁখি পাতে।
কর্ম ক্লান্তি অবসানে
যখন হয়ে যাই আনমনা
তোমার মায়ার স্মৃতিগুলো
হৃদয়ে এসে দেয় হানা।
ভুলা নাহি যায় গো ভাবি
তোমার করুন মায়ার ছবি
ভাইটিকে আজ দূরে ফেলে
অনেক দূরে চলে গেলে।
কাছে যখন ছিলাম আমি
কত সোহাগ করতে তুমি।
ছায়ার মত থাকতে কাছে
হারায় যেন না যাই পিছে।
খুব সকালে উঠে এসে
দেখতে আমায় ঘুমের বেশে
ঘুম ভাঙ্গত সাতটা বাজে
ঘটায় জল রেখে দিতে।
রেখে যেতে চুপিসাড়ে
থাকতাম যবে ঘুমের ঘোরে।
হাত মুখটি ধুতে না ধুতে
নাস্তা নিয়ে হাজির হতে।
স্বভাব আমার একটা ছিল
একা কভু খেতাম নারে।
বেলা দশটা হতে না হতে
খাবার ঘরে ডেকে নিতে
ভাইবোনেরা একই সাথে
যেমনি হাটে বাজার মেলে।
খানা নিয়ে লুকোচুরি
বেশী দিবার ধরাধরি
ছিলাম আমি বরিশালি
বুঝতে না মোর হাতের চালি।
কম খেয়ে উঠলে আমি
ভাবতে তবে হেরেছ তুমি
হারে হারে ঠকে ঠকে
বীর বিক্রমে ডাকতে মাকে
মাতা ছিলেন অদ্বিতীয়া
হাজির হতেন তখন গিয়ে
যতই আমি বলতাম তারে
খেয়েছি মা উদর পুরে
বৃথাই মোর মিনতি বাজে
আসতো না তা কোন কাজে।
মনে পড়ে সকল কথা
হৃদয় পটে জাগে ব্যথা।
আরো অনেক মনে পড়ে
বৃষ্টি কাঁদায় ভিজি ভিজি
টোপ ফেলেছি পুকুর জলে
মাছ রাখতে ভাজি ভাজি
ভাজি দেবার ধরা ধরি
আবার বাজতো কাড়াকাড়ি
এমন সময় বাবা এসে
বসতেন আমার মাথা ঘেঁসে
বলতেন তিনি সোহাগ ভরে
খাও বাবা উদর পুরে
কাছে যখন আসতেন মোর
হয়ে যেতাম অমনি চোর
চোরের মত নুইয়ে মাথা
শুনতাম তাঁর সকল কথা।
দিবা নিশির অধিক ক্ষণে
কেটে দিতেম আলাপনে
গেঁয়ো ভাষা নিয়ে কত
হাসি ঠাট্টা করতাম যত।
পাগলা ভাবি আর পুঁথি ভাই
তাদের কথা ভুলি নাই
পুঁথি শুনার আয়োজনে
বসতাম রাতে গভীর মনে
ছন্দ হারা পুঁথি গুলো
শুনতে খুব লাগতো ভালো
এমনি অনেক হাজার কথা
হৃদয় পটে জাগায় ব্যথা।
ইতি
ছোট ভাই
ইদ্রিস

*১৯৭৬ সাল
(দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে বেশী দিন সেই
বন্ধুটির সাথে ভাবির ঘর করা সম্ভব হয়নি )