হিমালয় ছুঁয়ে ফেলেছি

জাফর ইদ্রিস
Published : 29 Dec 2011, 11:23 AM
Updated : 29 Dec 2011, 11:23 AM

আমি আমার সফলতার কথা বলছি।
আমি আমার আশা পুরণের কথা বলছি।
আমি আমার জীবনের স্বার্থকতার কথা বলছি।

নিন্দুকেরা যাহাই বলুক, আমি অকপটে আমার জীবনের সকল পাওয়া গুলো বলে যাব। ১৯৭৬ সালের ২৫শে মে যে কিশোর মাত্র তিন শত টাকা সম্বল নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় প্রথম পা রেখেছিল ঢাকার সদর ঘাটের মাটিতে এবং তার প্রথম রজনী কেটেছিল সদর ঘাটের অলস অবস্থানরত একটি লঞ্চের ছাদে,কারণ যে আত্মীয়টির ভরসায় ঢাকায় এসেছিল সেও ছিল একজন কর্মহীণ এবং তার বাসায় রাত্রি যাপন করার কোন অনুমতি বাড়িওয়ালার ছিলনা। গভীর রাতে যখন মুষল ধারায় বৃষ্টি নামল তখন লঞ্চের ছাদের নিচে খালাসিদের অনুমতি নিয়ে বসে বাকি রাতটা কাটাতে হয়েছিল। পরবর্তীতে বেশ কটি রাত বাড়িওয়ালার অজান্তে ছাদে কেটে ছিল কিন্তু সেই আশ্রয়টুকু হারাতে হয়েছিল যখন নিশি যাপনের কাহিনীটি বাড়িওয়ালা জেনে যান। স্থানটা ছিল পুরান ঢাকার লাল চান মকিম লেন।

আমি খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে আমার ফেলে আসা দিনগুলির একটা খন্ড চিত্র আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। এবং এখান থেকেই আপনারা ও আমার সন্তানেরা আমার বিভীষিকাময় জীবন গাঁথা জানতে পারবে। সফলতা যদি জীবনে না পেতাম তবে কোন দিনই এই দুঃখগুলো জানাতাম না। সপ্তাহখানিকের মধ্যে জগন্নাথ কলেজে নৈশ শাখায় বি,কম এ ভর্তি হয়ে আশ্রয় এবং কর্ম সংস্থানে পিছু ছুটলাম। অনেক দুর্বিসহ জীবন পার করেছি কিন্তু ঘরে ফিরে যাইনি। সাথের অনেকেই ঘরে ফিরে গেছে। জীবনে যা হতে চেয়ে ছিলাম তা হতে পারিনি এবং সেই দুর্বলতাটুকু আজ আর বলতে চাই না।

১৯৮২ সালে নিজ জেলারই এক মেয়ের সাথে আমার বিবাহের প্রস্তাব আসে এবং তাকে বিয়ে করার পক্ষে যে যুক্তিটা আসে তা ছিল সে এইচ,এস, সি, পাশ করেছে কিন্তু অসুস্থতার কারণে প্রথম বিভাগ পায়নি। তবে মেয়েদের মেধার তালিকায় বোর্ডের ১৯তম হয়ে বৃত্তি পেয়েছে এবং ৫ম ,৮ম শ্রেণীতে টেলেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছে আর এস এস সি তে জেলার মেধায় প্রথম হয়ে বৃত্তি পায়। তবে কৃষক পিতার পক্ষে পড়া
অব্যহত রাখা সম্বব নয়। আমি রাজি হয়ে ১৯৮২ সালে ২ আগষ্ট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম এবং ঢাকায় এনে বি এসসি তে বদরুন্নেছা কলেজে ভর্তি করে দিলাম। সেখান থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বি এসসি তে দ্বিতীয় শ্রণী পেয়ে প্রাইভেটে এম এ পাশ করে এবং বর্তমানে একটা সরকারী ব্যাংকে এফ.এ.জি.এম ও এক গর্ভরত্না মা।

আমি চাকুরী জীবনে প্রথমে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করতাম এবং পরবর্তীতে নিজেই মতিঝিলে চাকুরীর অভিজ্ঞতা নিয়ে একই জাতীয় একটা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে জমি কিনে বাড়ীর কাজে হাত দিলাম।প্রথমে আমাদের ঘরে আসল একটা কন্যা সন্তান। দ্বিতীয় কন্যা, তৃতীয় কন্যা। বুঝতে পারেন তখন বিশেষ করে মায়ের মানসিক অবস্থা। জনসংখ্যা বেরেই চলছে।

অবশেষে এলো "হাসিবুল হাসান হাসিব" চারটা সন্তানই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র/ছাত্রী। বড় মেয়ে ২০০৪ এ এইচ এস সি তে এ+ পায় এবং তার পরের দিন ঢাকার প্রায় সকল নেত্রীস্থানীয় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে তার ছবি দেখতে পেলাম। এবং সেই থেকে শুরু হল আমাদের পাওয়া। বড় মেয়ে এম বি বি এস কোর্সে চান্স পায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। এ বছরই সে ডাক্তার হয়ে বের হল। বড় মেয়ে স্বামীও ডাক্তার। দ্বিতীয় মেয়ে ডাবল এ+ এবং সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এ্যাপ্লাইড ক্যামিষ্ট্রি এন্ড কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অনার্স শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত এবং ডিপার্টমেন্টে মেধার তালিকা সে দ্বিতীয়। তৃতীয় মেয়ে ৫ম শ্রেণীতে টেলেন্টপুলে সরকারী বৃত্তি পেয়েছে এবং এ বৎসর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় এ + পেয়েছে।

এবার একটু পিছনে যাই। বড় এবং মেজো মেয়ে জনতা ব্যাকের থেকে দুইটি গোল্ড মেডেল পেয়েছে এবং দুই জনই মেডিকেল ও ইউনিভার্সিটিতে সরকারী বৃত্তি পেয়ে আসছে।

এখন হিমালয় ছোঁয়ার গল্প বলি। বাকি রইল ছেলে। প্রতিবেশীরা বলতো আপনার মেয়েরা প্রতিভাবান তখন ভাবতাম বর্তমান আর্তসামাজিক অবস্থায় ছেলেকে কি মেয়েদের মত গড়তে পারবো? ছেলেটাকে বেশী সময় পড়ার টেবিলে বসানো কঠিন ছিল। মেয়েরা মেধা নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে আমাদের ভিটা কি মেধা শূণ্য হয়ে পরে থাকবে ? ছেলেটা ৫ম শ্রেণীতে এ + পেয়ে হিমালয়টা মা বাবার
হাতের মুঠোয় এনে দিল।

মনের আবেগে এতক্ষণ যা কিছু বলেছি তাতে যদি পাঠকের কোন রূপ বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে তবে ক্ষমা করে দিবেন। আমি বাচাল বাবা এখন ওদের নিয়ে প্রবন্ধ লিখি,গান লিখি, কবিতা লিখি। সব শেষে আর একটা পূর্ণতার কথা না বললে লেখাটি অপূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের বাসভবনের ছয় তলার কাজটিও সম্পূর্ণ হয়েছে।

সব শেষে একটা দুঃখ নিয়েই বিদায় নিলাম আর তা হলো আমার বাবা মাকে আমার সুখের ঘরটি দেখাতে পারলাম না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আমাদের সুখের স্থায়ীত্বটি দীর্ঘ হয়।

আমার মায়ের মূত্যু দিবস ৩১.১২, তাই মাকেই আমার এ লেখাটি উৎসর্গ করলাম।

২৯.১২.২০১১