মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আগে ফরজ, মুস্তাহাব পরে

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 12 Feb 2013, 10:38 AM
Updated : 12 Feb 2013, 10:38 AM

অন্ধ চাটুকার আর মেরুদন্ডহীন সাংসদদের টেবিল চাপড়ানোর শব্দে সিক্ত হয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পরশু সংসদে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ঘোষণাপত্র আর স্পিকারের কাছে দেয়া স্মারকলিপির সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

শাহবাগে ব্লগারদের আহ্বানে আন্দোলন শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এই আন্দোলনে বহুল চর্চিত কথা আর বিশ্লেষণের বাইরে আমার কিছু পর্যবেক্ষন আছে। আশা করি সেটা নিয়ে একটা পুরো পোস্ট লিখবো পরে।

আন্দোলন শুরুর পর থেকে একটা মজার বিষয় দেখা যাচ্ছে – নানা সেক্টরের আমাদের পরিচিত সব 'ক্লাউন' শাহবাগে যাচ্ছে আর দারুণ গদগদ ভাষায় প্রকাশ করছেন 'সংহতি'। তাদেরকে দেখি আর হাসি। তাদের এই সংহতির কারণটাও অনুমান করতে পারি – কিছুদিন আগে দিল্লীতে চলন্ত বাসে তরুণীর ধর্ষিত হওয়া আর মৃত্যুর প্রতিবাদে সারা দিল্লীতে অসংখ্য মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। ওই সময় দারুণ ধূর্ত একটি কাজ করেছিলেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। তিনি নিজেও রাস্তায় নেমে আমজনতার আন্দোলনে শরীক হয়ে গিয়েছিলেন। জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যদি সরকারের জন্য হুমকি হয়ে যায়!

যাই হোক আসা যাক সেদিনের সংসদের কথায় – ব্লগারদের স্মারকলিপির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন 'আমি তাদের দাবির প্রতিটি বাক্য পড়েছি। এ দাবী বাস্তবায়ন করতে যা যা দরকার, সবই করব'। দেখা যাক ওই স্মারকলিপির আমি ৩ নম্বর আর ৬ নম্বর দাবী কী কী। ৩ নম্বরটি হল – জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের হুমকি দাতা জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। ৬ নম্বরটি হল – যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, ফোকাস, রেটিনা কোচিং সেন্টারসহ সকল প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ ও তাদের সকল প্রকার আয়ের উৎস খুঁজে বের করা এবং তাদের গণমাধ্যম দিগন্ত টিভি, নয়াদিগন্ত, আমার দেশ, সংগ্রাম, সোনার বাংলা ব্লগসহ নিষিদ্ধ করতে হবে।

জামাতসহ সব ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীর সাথে কি প্রধানমন্ত্রী একমত? সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী বলে আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশধনী বাতিল হবার পরে তো জামাতসহ সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কোথায় গিয়েছিল? পরে আবার নতুন সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তো ছিলই সাথে ছিল জিয়ার ভুত (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম) আর এরশাদের ভুত (রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম)। সেটা আরেক আলোচনা।

মজার ব্যাপার এই আওয়ামী লীগই কিন্তু আইনের শাসনের প্রতি দারুন অনুরাগী হয়ে ওঠে যখন আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলকে 'অনিচ্ছাসত্ত্বেও' মেনে নেয়। আবার মানেনি সেই রায়েরই একটা পরামর্শ – আরো দুটো টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ কতটা নোংরা হতে পারে এই রায়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিক্রিয়া দেখলে সেটা বোঝা যায়।

সেই একই রাজনৈতিক সুবিধাবাদ দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর সংসদে দেয়া বক্তৃতায়। যদিও তাঁর সংহতি প্রকাশকে অনেকেই খুব প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছেন, প্রশংসা করছেন। আচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় সংহতি দেখানোর কী দরকার ছিল? প্রধানমন্ত্রীর সংহতি প্রকাশ করতে হলে যা করা দরকার সেটা হল – হল ওই স্মারকলিপির দাবীগুলোকে বাস্তবায়িত করা। করবেন কি তিনি সেটা? জামাতসহ ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করবেন? জামাতিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করবেন? (ব্লগারদের ওসব প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধের দাবী ভুল হয়েছে)। একটা কথা মনে পড়ল, এই তো মাত্র কয়দিন আগেই ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে মোটা স্পন্সর মানি নিয়ে বিশ্বকাপের শানশওকত বাড়িয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকার – আর ঢাকা ছেয়ে গিয়েছিল ইসলামী ব্যাংকের বড় বড় বিলবোর্ডে।

কেউ কেউ বলবেন দেখা যাক না কী হয়, প্রধানমন্ত্রী করতেও তো পারেন। আমি বলি দেখা যাচ্ছে সব এখনই, দেখা যাচ্ছিল বহুদিন থেকেই – আমরা 'অন্ধ' হয়ে গেছি বলে দেখতে পাই না। এই দেশের দুই 'বড় দল' এর চরিত্র বুঝতে আর বাঁকি নেই। ওই দুইটি দাবীর কিছুই করবেন না তিনি। তবে কেন বললেন 'আমি তাদের দাবির প্রতিটি বাক্য পড়েছি। এ দাবী বাস্তবায়ন করতে যা যা দরকার, সবই করব'। এটা স্রেফ সস্তা রাজনৈতিক স্টান্টবাজি।

আমাদের দেশের মত এমন সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ (এটা শুধু এই প্রধানমন্ত্রীই না, সব প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। তাঁর ক্ষমতাকে শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় রাজা – রানীর সাথেই তুলনা করা যায়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অন্ততঃ দুইটির (আইন প্রনয়ন, প্রশাসন) অফিসিয়াল প্রধান তিনি – তিনি প্রধানমন্ত্রী আবার তিনিই সংসদ নেত্রী। বাকি অঙ্গটার (বিচার বিভাগ) আনঅফিসিয়াল প্রধানও কিন্তু তিনি, যদিও মাঝে নাঝেই সরকারের পক্ষ থেকে খুব গলা চড়িয়ে বলা হয় 'বিচার বিভাগ স্বাধীন' (জানিনা কথাটা আদালত অবমাননা হয়ে গেল কিনা)। এই দেশের সব ক্ষেত্রের দন্ডমুন্ডের একমাত্র কর্তা এই দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাই কথার ফুলঝুরি ছোটানোর দরকার নেই, প্রবল প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী চাইলেই তাঁর ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি কথা বলবেন আর মেরুদন্ডহীন সাংসদদের টেবিল চাপড়ানো উপভোগ করবেন। কাজগুলো তিনি করবেন না, কারন এর মধ্যে বিরাট রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ আছে – সময় করতে পারলে সেটা নিয়ে লিখব।

বক্তৃতার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বেশ আবেগী ভাষায় বলেন, 'বৃদ্ধ বয়সে আমারও মন ছুটে যায়, ইচ্ছে করে তাদের সাথে যোগ দিতে'। না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শাহবাগে এসে কাজ নেই। ওখানে যাবার জন্য তাঁকে ক্ষমতায় পাঠানো হয়নি। তিনি নিজের কার্যালয়েই থাকুন। ওখানে বসেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে সত্যিকার সংহতি প্রকাশ করুন। এগুলো বাস্তবায়ন করা ফরজ, আর শাহবাগে যাওয়া তাঁর জন্য বড় জোর মুস্তাহাব হতে পারে। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগে ফরজ পালন করে পরে মুস্তাহাব নিয়ে কথা বলবেন। অবশ্য কে না জানে, ফরজ বাদ দিয়ে মুস্তাহাব নিয়ে টানাটানি করার রোগ বাঙালীর চিরন্তন।