সময় হল ‘ক্রিকেট আফিমে’ বুঁদ হয়ে দেশপ্রেমিক সাজার

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 10 June 2015, 06:19 PM
Updated : 10 June 2015, 06:19 PM

আজ থেকে আবার ক্রিকেট – শুরু হল ভারতের বাংলাদেশ ট্যুর। আজ থেকে আবার দারুণ উৎসবে মজে যাবো আমরা। ক্রিকেটের হ্যাংওভার কাটছেই না। কিছুদিন আগে বিশ্বকাপ হল, আমাদের দল ভাল করলো। তারপর পাকিস্তান এলো দেশে, ওরা হোয়াইটওয়াশ হল (আদিখ্যেতা করে নাম দেয়া হয়েছে 'বাংলাওয়াশ') – আরেক ডিগ্রী চড়লো ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার পারদ, দীর্ঘায়িত হল হ্যাংওভার। এরপর আইপিএল; আমাদের দেশ না খেললেও ওই আফিম আমাদেরও বুঁদ করে, শুধু তাই ই না ওটাকে ভিত্তি করে আরেক নেশা, জুয়ার আখড়ায় পরিণত হয় দেশের অনেক স্থান। এবার এলো ভারত। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ভারতের সাথে বিতর্কিত ম্যাচের ইতিহাস আমাদেরকে তাতিয়ে রেখেছে – এই আবেগের সুযোগ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিজ্ঞাপন – 'Bamboo is on'. বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ এই বিজ্ঞাপন নিয়ে অনেকে খুব সমালোচনা করেছেন, আমি করি না। এসব বিজ্ঞাপণ তৈরি হয় কারণ এসব আমরা 'খাই'। ওই স্লোগানের মত করেই বলা যায় – Cricket hangover is on.

খেলা মানুষের কাছে নিছক বিনোদন হয়ে থাকলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হল সারা পৃথিবীতে খেলা এখন বিরাট বানিজ্য। তাই এর নানা রকম ইন্টারপ্রিটেশন তৈরি করছে বাজারে এর বিক্রেতারা। এর একটা হল, ক্রিকেট দিয়ে দেশপ্রেমিক হওয়া (আমি বলি দেশপ্রেমিক সাজা)। গ্যালারীতে নানা বেশে দেশপ্রেমের পসরা সাজায় দর্শকরা। কেউ গালে আঁকে পতাকা, কেউ মাথায় বাঁধে পতাকা, কেউ পোষাক পরে পতাকার রঙে, কারো হাতে থাকে পতাকা, আর কেউ তো সারা গায়ে রঙ মেখে সঙ (বাঘ) সাজে।

মিডিয়া তো এসব উস্কে দেয়ই, দেয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও। অতি তুচ্ছ খেলায় (দুর্বল জিম্বাবুয়ের সাথে) জিতলেও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর অভিনন্দন জানানোর হিড়িক পড়ে যায়। ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সামান্য ভাইরাস জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাকে দেখতে যান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সবাই মিলে আমাদেরকে শেখান 'ক্রিকেটীয় দেশপ্রেম'। এটা করেন, কারণ এতে আসলে লাভ আছে তাদের; সেই আলোচনায় আসছি পরে।

কিছুদিন আগে ফিরে যাই। বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে আম্পায়ারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, আমাদের দলের হার, লোটাস কামালের কিছু মন্তব্য, তারপর তাকে নিয়ে আইসিসির চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসনের অন্যায় আচরণ, সবকিছু আমাদের দারুণ ক্ষুব্ধ করে। আমাদের দেশের মানুষের 'দেশপ্রেম' জেগে ওঠে, তারা ক্ষোভ উগরে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় – ভারতীয়দের সাথে রীতিমত যুদ্ধ বেধে যায় আমাদের দেশের মানুষদের। এমনকি আমাদের দেশের নানা ক্ষেত্রের 'তারকা'রাও কোমর বেঁধে শামিল হন সেই 'যুদ্ধে'। আমার পরিচিত একজন আমাকে একটা ফেইসবুক লিঙ্ক দিয়ে বলে সেখানকার কাইজ্যায় শামিল হতে। হইনি আমি, আমার এই 'দেশপ্রেম' কম।

ভারতের ক্রিকেট দলের সফরের টাইমং টা কী চমৎকার!! ঠিক নরেন্দ্র মোদীর সফরের পর পর। ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয় বলে বিশ্বাস হয় না। দুইদিন না যেতেই আমরা বন্ধ করে দেবো, মোদির স্টান্টবাজি করে ভারতের স্বার্থসিদ্ধি নিয়ে করা সব 'প্যাঁচাল'। ভারত আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায্য অধিকার তো দিলোই না, উল্টো শুকনো আশ্বাস দিয়ে আর এই দেশের 'বড়' দুই দলের মেরুদন্ডহীনতার সুযোগ নিয়ে নিজের কী কী স্বার্থসিদ্ধি করে নিলো সেইসব আলোচনা করে দেশপ্রেম দেখাতে আর হবে না। ওদিকে স্থলভাগের গ্যাসও বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। 'দেশপ্রেম' দেখানোর মোক্ষম গ্রাউন্ড তৈরি আছে ফতুল্লায়, আর মিরপুর স্টেডিয়ামে। আজ থেকে দেশপ্রেম দেখানো শুরু হবে খেলোয়াড়দের ব্যাটে-বলে আর দেশবাসীর সমস্বরে চ্যাঁচানোতে।

ক্রিকেটের জন্য রাস্তায় বিজয় মিছিল হবে, কিন্তু দেশের দেশের হাজার স্বার্থ নষ্ট হয়ে গেলেও সেটা নিয়ে রাস্তায় নামা দূরেই থাকুক চায়ের আড্ডায় কথা হবে না, সামাজিক মাধ্যমেও না। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসে শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেন নিজেও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, মানব উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবগুলো সূচকে অনেক নীচুতে থাকার পরও ভারতের পত্রিকা দেখলে তাঁর অবাক লাগে – ওই দেশে ক্রিকেট আর সিনেমা হল মূল আলোচনার বিষয়; পত্রিকায় থাকে না অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়।

আসলে বাজার চায়, সরকারগুলো চায় মানুষ মেতে থাকুক নান রকম 'আফিম' নিয়ে; হোক সেটা গাঁজা-ইয়াবা, ফেইসবুক, পর্ণ বা আপাত 'নির্দোষ বিনোদন' ক্রিকেট। এতে তাদের ক্ষমতার আর বানিজ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয় না, করে যেতে পারে তাদের যা খুশি তা। আর আমরাও এতোটা মেরুদন্ডহীন হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত যে আমাদের দেশপ্রেম দেখানোর দৌড় এসে ঠেকেছে ক্রিকেট। এতে খেলার উত্তেজনাও পাওয়া যায় আর দারুণ ভেক ধরা যায় দারুণ দেশপ্রেমিকের – কী দারুণ 'রথ দেখা আর কলা বেচা'। ক্রিকেটে যেহেতু আমাদের দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ প্রদর্শনী হয়ে যায়, তাই আর সব বিষয়ে দেশপ্রেম দেখানোর কী দরকার?

তাই বাদ থাকুক আর সব বিষয়, আসুন সবাই 'ক্রিকেট-আফিম' এ বুঁদ হই, আর সাজি দারুণ 'দেশপ্রেমিক'।