‘অভিযুক্ত’ রাষ্ট্রের কাছে ‘পিটিয়ে হত্যা’র বিচার চাই না

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 13 July 2015, 03:54 AM
Updated : 13 July 2015, 03:54 AM

কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিটিয়ে মেরে ফেলা আমাদের সমাজে 'জায়েজ'। আমরা, 'শিক্ষিত' 'ভদ্রলোক'রাও মেনে নিয়েছি, চোর-ডাকাত-পকেটমার-ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলা 'জায়েজ' আছে; অনেকেই হাতও লাগাই সেই 'পূণ্যে'। কিন্তু যদি কখনো অপরাধী মনে করে কোন নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তখন সেটা আমাদের বিবেককে (জানি না, এই বস্তুটার অস্তিত্ব আমাদের মধ্যে আদৌ আছে কিনা) নাড়া দেয়। কয়েক বছর আগে সাভারে শবে বরাতের রাতে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে কয়েক তরুণের হত্যার পর আমাদের বিবেক জেগেছিল, কারণ তারা ডাকাত ছিল না!

আর কাল আবার জেগেছে আমাদের 'বিবেক' – সিলেটের কুমারগাঁওয়ে ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার খবর আর সেটার ভিডিও দেখে। বোধ করি রাজন সত্যি সত্যি চোর হলেও আমাদের 'বিবেক' জাগতো, কারণ রাজন নেহায়েত বাচ্চা একটা ছেলে, আর কী মায়াময় তার চেহারা!! আজ আমাদের অনেক বেশী আবেগাপ্লুত অবস্থা দেখে 'আদিখ্যেতা' শব্দটাই মনে আসলো, কারণ রাজনদের এভাবে মরে যাবার পেছনে আমাদের অপরাধী পিটিয়ে মেরে ফেলাকে জায়েজ ভাবার মানসিকতাই দায়ী।

যে রাষ্ট্র নিজে তার নাগরিককে মেরে ফেলে ক্রসফায়ারের নামে, আর সেই হত্যার যৌক্তিকতা দিতে মাঠে নামেন সরকারের দায়ীত্বশীলরা আর কিছু 'বুদ্ধিজীবী' সেই রাষ্ট্রে মানুষও এটা করে যাবে এটাই স্বাভাবিক। ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে আমার একটা পোস্টের (ডাকাত শহীদের আবার মানবাধিকার!) মন্তব্য দেখলেই বোঝা যাবে অনেক 'শিক্ষিত' মানুষ কী ভয়ঙ্কর ভাবনা লালন করেন। মানি, এই দেশে 'ক্রসফায়ার' শুরু হবার আগেও গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা হয়েছে; কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভীন্ন। এখন এই ধরণের হত্যার বিচার করার অধিকার রাষ্ট্র নিজে রাখে না, কারণ রাষ্ট্র নিজেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। একজন সাধারণ মানুষ যখন কাউকে হত্যা করে, সেটা যতোটা ভয়ঙ্কর, রাষ্ট্রের সি অপরাধ করা তার চাইতে হাজার গুন বিভৎস। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের (অপরাধীসহ) রক্ষক হবার কথা ছিল।

বিডিনিউজের এই খবরে দেখা যায় রাজনের মা লুবনা বলেন, "আমার ছেলে চোর না- এই কথা সারা এলাকার মানুষ জানে। আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।" কী চমৎকারভাবে তিনি আমাদের মধ্যকার চিন্তাটা প্রকাশ করে দিলেন!! তিনি কিন্তু বললেন না, তাঁর সন্তান চোর-ডাকাত যাই হোক না কেন, তাকে কেউ এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে রাখে না। হতে পারতো রাজন বড় হয়ে হাতেনাতে চোর-ডাকাত ধরে ফেলতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলায় নিজেই হাত লাগাতো। দোষ রাজনের না, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র তাকে এই সব হত্যার 'বৈধতা' দেয়। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এটা শকতভাবে বলে না, কোন মানুষকে, সে যত ভয়ঙ্কর অপরাধীই হোক না কেন, পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় না। এটা নিয়ে আমার অনেক আগের একটা পোস্ট (ধরে নিলাম ওরা ভয়ঙ্কর ডাকাত…) প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।

আমি জানি শিশু রাজন হত্যার ঘটনা অচিরেই আমরা ভুলে যাবো। অনলাইন 'প্রতিবাদ' এর মধ্যেই চাপা পড়েছে ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিজয়ের নীচে। টিভির স্ক্রলে সব সময়ের মত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকারের অভিনন্দন জানানো চলছে। কিন্তু রাজনের জন্য, কোন শোকবানী নেই রাষ্টের দন্ডমুন্ডের কর্তাদের। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি এতে স্পষ্ট না?

ফেইসবুকে ঢুকলেই দেখা যায় রাজন হত্যার বিচার চেয়ে নানা রকমের পোস্টের ছড়াছড়ি; ক্ষণিকের আবেগে ভেসে যাওয়ার আরেক উদাহরণ। মজার ব্যাপার, সেই মানুষগুলোও একটু পরেই আবার ভেসে গেছেন বাংলাদেশের জয়ের আনন্দের স্ট্যাটসে। রাজন হত্যার বিচারের দাবীর পোস্টে লাইক দিয়ে কর্তব্য সম্পাদিত হয়ে গেছে না আমাদের!!

আমি কিন্তু বিচার চাই না রাজন হত্যার। যে রাষ্ট্র নিজেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত, সেই রাষ্টের কাছে এই বিচার চাওয়ার মত আহাম্মক আমি নই।

ক্রমাগত এসব ঘটনা ঘটে যাওয়া এটাই প্রমাণ করে এমন ঘটনা ঘটার মত পরিস্থিতি আমাদের সমাজে বিরাজমান। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী সবাইকে নিয়ে গভীর অনুসন্ধান, গবেষণা হওয়া উচিৎ। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে সমাজে ভয়ঙ্কর সব মূল্যবোধ বিরাজ করে, সেই সমাজের মানুষের মানুষকে প্রথমেই সমাজের পচনকে স্বীকার করে নিতে হবে। সবাইকে তার অনুপাতের দায় মাথা পেতে নিতে হবে (এই দায় আপনার আমার মত সব সাধারণ মানুষেরও আছে)। এরপর কাজ করতে হবে মূলের সমস্যা নিয়ে। আমার অনেক পোস্টে আমি লিখেছি, শুধুমাত্র বিচার করে/ফাঁসি দিয়ে দিলে এসব বিষয়ে আমাদের নিজেদের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের দায়কে স্রেফ ধামাচাপা দেয়া হয়, কাজের কাজ হয় না কিছুই।

আর সবকিছুর আগে উচিৎ ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা অন্য কোন নামে হোক যে কোন ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাওয়া। রাষ্ট্র তার নিজের চরিত্র না বদলে জনগনের চরিত্র বদলাতে চেষ্টা করবে, এটা আশা করা বাতুলতা। তাই ওটা হবার আগে যাবতীয় প্রতিবাদ, বিচার কামণা স্রেফ কয়েক ঘন্টার বা দিনের 'অনলাইন হাউকাউ' হয়েই থাকবে।

পূনশ্চঃ রাজনের খবর বাসি হতে না হতেই কাল রাতের খবর – গভীর রাতে গণপিটুনিতে নিহত ৩। এমন খবর তো আকছারই দেখা যায়। আমাদের বিবেক তো জাগে না ওতে! কারণ ওরা তো শিশু নয়।