শিক্ষা-পণ্য, ভ্যাট আর সমাজতন্ত্রের বাকোয়াজ

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 13 Sept 2015, 02:18 PM
Updated : 13 Sept 2015, 02:18 PM

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি এর ওপরে ভ্যাট বসানোর প্রতিবাদে অভাবনীয় প্রতিবাদ হয়ে গেল রাজপথে আর এখনকার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী সেটা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পত্রিকায়, টিভির টক শো'তে। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে এই ব্লগেও – অনেক পোস্ট এসেছে ভ্যাটের বিরুদ্ধে, পক্ষেও দু-একটি। সব ক্ষেত্রেই ভ্যাট বিরোধী বক্তব্যগুলোর মূল যুক্তি ছিল শিক্ষা পণ্য নয়, তাই…..!

এই যাবতীয় আলোচনায় অবাক হয়ে দেখলাম, প্রায় সবাই কি এটা খেয়াল করছেন না, এই দেশে শিক্ষা অনেকদিন থেকেই পণ্য হয়েই আছে? কথাগুলো প্রকাশ্যে স্বীকার করাই সমস্যা!! শিক্ষা-পণ্য হল ভাসুর, মুখে নাম নেয়া যাবে না!! বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক, ওসবের অনুমোদন দেবার সময় ওই আইনে বলা হয়েছে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক; ট্রাস্টিরা কোন লাভ নিতে পারবেন না। স্টুডেন্টদের টিউশন ফি থেকে পাওয়া যাবতীয় আয় ব্যয় করা হবে ভার্সিটির অবকাঠামো আর শিক্ষার মানোন্নয়নে। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 'সেবামূলক প্রতিষ্ঠান' এই কথা বিশ্বাস করার মত আহাম্মক কি আমরা?

একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স পাবার জন্য রাঘব-বোয়ালদের পেছনে কত টাকাওয়ালা লোকদের লাইন – এসবই 'জনসেবা' করার জন্য করে তারা? অথচ অন্য ব্যবসার কথা বাদই দেই, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে দেবার শর্তে কোটি টাকা কামিয়ে নেবার অভিযোগ আছে কোন কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নেতারা যখন তাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় গগণবিদারী কন্ঠে যখন বলেন, "আমার কোন ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নেই, আমি রাজনীতি করি আপনাদের সেবার জন্য" তখন আমরা জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের নাটকের একটা সংলাপ অনুসরণ করি "দুই কান দিয়া ঢুকায়া নাক দিয়া ফোঁস কইরা বাইর কইরা দিবা"। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা ওগুলো থেকে ব্যবসা করেন না, এই বক্তব্যেও কি আমাদের একই কাজ করা উচিৎ না?

ভ্যাটবিরোধীদের অনেকেই বেশ জোর গলায় বলছেন, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই ধনীর সন্তান নয়; তাদের অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান – এমনকি কেউ কেউ ধার-কর্জ করে বা জমিজমা বেচে সন্তানকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। মানি এটা, কিন্তু এটা আমরা খেয়াল করছি না, কষ্ট করে হলেও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার কিন্তু এই বাজার থেকে বেশ উচ্চমূল্য দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কিনতে পারছেন। কিন্তু এই দেশের অসংখ্য পরিবার তাঁদের সন্তানদের জন্য কাঙ্ক্ষিত ডিগ্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেনার কথা কল্পণাও করতে পারেন না – এদের মধ্যে অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের চাইতে মেধাবি। শুধু দারিদ্র্যের কারণে তারা শিক্ষা কিনতে পারছে না। তাই ধনী হোক বা মধ্যবিত্ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা শুধু টাকা থাকার কারণে এই দেশের অনেক পরিবারের চাইতে এই বাজারে এগিয়ে গেল। মানে, তারা এই বাজারের সুবিধাভোগী। বাজারের সুবিধাভোগীদের মুখে 'শিক্ষা পণ্য না' এই শ্লোগান কি মানায়? ভার্সিটি যখন দফায় দফায় ফি বাড়ায় এই শিক্ষার্থীরাই কি প্রতিবাদ করে তখন? রাস্তায় নামে?

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে স্রেফ ব্যবসার উদ্দেশ্যেই চলছে তার প্রমাণ হল, এগুলো বাজারে চালু পণ্যই বিক্রি করছে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশেষ কিছু বিষয়ই পড়ায়, আমরা জানি সেগুলোর নাম। ওসব বিষয়ের প্রাধান্য থাকবে, এটা মেনেই নেয়া যায়, কিন্তু জ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাসিক বিষয় (যেমন, পদার্থবিদ্যা, গণিত, দর্শন, ইতিহাস) কেউ নামকাওয়াস্তেও পড়ায় না; অথচ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল 'সেবামূলক প্রতিষ্ঠান'!! এখন সরকার পড়েছে বিপদে, কাগজে কলমে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের কাছে তো আর কর্পোরেট ট্যাক্স চাওয়া যায় না, তাই ভ্যাটই সই।

আমরা শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে ভ্যাট নিয়ে ইদানিং খুব কথা বলছি, অথচ বিলাসদ্রব্য নয়, কিন্তু আমাদের নিত্য ব্যবহার্য অনেক জিনিষে ভ্যাট আছে। নীতিগতভাবেই ভ্যাট (পরোক্ষ কর) একটা নিপীড়নমূলক ট্যাক্স। কারণ এটা সব আয়ের মানুষদের কাছ থেকেই একই পরিমাণ ট্যাক্স নেয়। পেঁয়াজের ওপর ভ্যাট থাকলে একজন রিক্সাচালক বা গৃহকর্মী প্রতি কেজিতে যে পরিমাণ ট্যাক্স দেয় একজন শত কোটি টাকার মালিকও দেয় ঠিক সেই পরিমাণ। এটা অনৈতিক। কিন্তু এই দেশের সরকারগুলো বড়লোকের স্বার্থ রক্ষা করে প্রত্যক্ষ কর (ইনকাম ট্যাক্স) নিয়ে মাথা ব্যাথা করে না, স্টিমরোলার চালায় আর্থিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠীর উপরেই। আমরা কিন্তু সেসব নিয়ে কথা বলি না।

এই পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের উচিৎ ছিল মূল সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করা। শিক্ষা নিয়ে আমাদের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী, সেটা মানুষের সামনে নিয়ে আসা। কিন্তু আমরা করছি না সেটা, বরাবরের মতোই আমরা মেতে আছি উপসর্গ নিয়েই। দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের সরকারগুলো বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মত উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র থেকে যে রাষ্ট্রকে সরিয়ে আনছেন ধীরে ধীরে, সেটা আমরা অনেকেই খেয়াল করছি না (দেখুন – Bangladesh – Higher Education Quality Enhancement Project)। বলাই বাহুল্য এই প্রস্তাব পুর বাস্তবায়িত হলে এমনকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও গরীবের পরাশনা আর হবে না। জনগণের বারোটা বাজুক তাতে কি, বিশ্বব্যাংকের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্তা, আমাদের অর্থমন্ত্রী যে সেই চেষ্টাকে বেগবান করবেন এতে অবাক হবার কী আছে?

এই লিঙ্কে গেলে দেখা যাবে, জিডিপি'র শতাংশ হিসাবে শিক্ষাখাতে ব্যায়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর একেবারে তলানির দেশ, আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপে এই ব্যয় আমাদের চাইতে বেশী। এমনকি এই বছরের বাজেটেও শতাংশ হিসাবে শিক্ষায় বরাদ্ধ আরো কমেছে (দেখুন)। এই পোস্টে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক না হলেও জানিয়ে রাখি, স্বাস্থ্যখাতেও জিডিপি'র অনুপাতে বরাদ্ধ কমছে। ফ্লাইওভার আর পদ্মাসেতু দেখিয়ে তলে তলে এই করে যাচ্ছে আমাদের সরকার।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ফি বাড়িয়ে সরকারী শিক্ষা থেকে ভর্তুকি কমানো, বেসিরকারী শিক্ষায় ভ্যাট বসানো, এসবই হল উপসর্গ; রোগটা হল শিক্ষা থেকে রাষ্ট্রের সরে আসা। ধাপে ধাপে আমরা বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ মেনে নিচ্ছি, হাটছি 'আমেরিকা হবার পথে', যেখানে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রায় অনুপস্থিত। কিন্তু এই পৃথিবীরই অনেক দেশ আছে যারা পুঁজিবাদী দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়নি, আর সব মৌলিক অধিকারের মত রাষ্ট্রই সেটার ব্যবস্থা করে। নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানির মত অনেক ওয়েলফেয়ার স্টেইট সেই কাজটি করে। আমাদের প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ছিল; সেটা অনেককাল নির্বাসিত থেকে আবার ফিরে এসেছে সংবিধানে। সমাজতন্ত্র বাদই দেই একটা পুঁজিবাদী ওয়েলফেয়ার স্টেইট এর মডেলও কি এই সরকার গ্রহণ পারে না?

অর্থিনীতিবিদদের মতে আমাদের মত স্বল্পোন্নত দেশকে সত্যিকারের উন্নয়নের পথে নিতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। তাঁরা এটাও বলেন এমন একটি দেশকে মানবসম্পদে সমৃদ্ধ করতে হলে জিডিপি'র কমপক্ষে ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিৎ। সেই আমরা দুই শতাংশের কিছু বেশী বরাদ্ধ থেকে নামতে নামতে এই বছর এটা ১.৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছি আমরা! (দেখুন)। তাও এমন এক সরকারের সময়, যারা সংবিধানে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপন করেছে, আর যেই সরকারের শিক্ষামন্ত্রী একজন প্রাক্তন সমাজতন্ত্রী এবং যে সরকার সাবেক-বর্তমান সমাজতন্ত্রী আর 'বৈজ্ঞানিক' সমাজতন্ত্রীতে ভর্তি।

আমরা আহাম্মক নই, সরকারের আচরণে আমরা খুব ভালভাবে বুঝে গেছি, সরকারের মুখে সমাজতন্ত্রের কথা স্রেফ স্টান্টবাজি, বাকোয়াজ; বরং এই সরকার পুঁজিবাদের নোংরাতম রূপ মিল্টন ফ্রিডম্যানীয় মুক্তবাজার অর্থনীতির পথেই চলছে, চলবে। আসলে আমাদের, জনগণের এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই দেশকে আমরা কোন আদলে গড়তে চাই। আমি নিশ্চিত হাতে গোনা কিছু অতি ধনী মানুষ ছাড়া প্রায় সব 'সাধারণ' মানুষই চাইবে দেই দেশকে ধীরে ধীরে একটা ওয়েলফেয়ার স্টেইটে পরিণত করতে। তাই সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ তৈরি করে যেতে হবে সেই উদ্দেশ্যে। তবে আমি খুব ভালভাবেই জানি, আমাদের দেশে পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় থাকা 'বড়' দুই দলকে চাপ দিয়ে ফল হবে না আদৌ। ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাট করাই যেসব দলের উদ্দেশ্য, তারা কোনদিনও কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরি তো করবেই না, কেউ করতে চাইলেও সর্বস্ব দিয়ে বাধা দেবে।

তাই আমাদের প্রতীক্ষা করতে হবে, গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে, একটা সত্যিকার 'সোশ্যাল ডেমোক্রেট' রাজনৈতিক দলের। না হলে আজকের আন্দোলনে এ যাত্রা হয়তো ভ্যাট বন্ধ হবে, কিন্তু পরেরদিন আবার এই রাষ্ট্র শোষণের নতুন নতুন পথ বের করবে। আশা করি নতুন দলের জন্য সেই প্রতীক্ষা অনন্তকাল তো হবেই না, খুব দীর্ঘও হবে না।