লিটনকে গ্রেফতারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশঃ কয়েকটি ভীতিকর সম্ভাবনা!!

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 14 Oct 2015, 04:38 PM
Updated : 14 Oct 2015, 04:38 PM

শিশুর পায়ে মদ্যপ এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের গুলি-কাণ্ড নিয়ে কথা হয়েছে বেশুমার। প্রতিবাদের বন্যা বয়ে গেছে পত্রিকায়, টিভির টক শো'তে, ফেইসবুকে এবং রাস্তায়। এমনকি তার এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতারা পর্যন্ত তার শাস্তির দাবীতে নেমেছে রাস্তায়। না, প্রতিবাদকারী আওয়ামীলীগ নেতারা মানবিক কারণে রাস্তায় নেমেছে, এটা মনে করার মত আহাম্মক নই আমি; বাগে পেয়ে অন্য গ্রুপের লোকজন তাকে একটু সাইজ করতে চাইছে আর কি।

ঘটনা যখন ঘটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিদেশে ছিলেন। দেশে ফিরেই (গুলির ঘটনার ৪ দিন পর) মন্ত্রীসভার বৈঠকে তিনি লিটনের কীর্তিতে উষ্মা প্রকাশ করেন এবং তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন (বিস্তারিত)। এই খবর সংবাদ মাধ্যমে আসার পর অনেককে পত্রিকায় কলাম লিখতে দেখেছি, টিভি'র টক শো'তেও অনেককে দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করছেন – তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন; দলীয় সাংসদকেও ছাড় দিচ্ছেন না!

অথচ হাতে গোনা দুই একজন ছাড়া কাউকে বলতে শুনলাম না, একজন মানুষের এমন সন্ত্রাসী কাজের পর তাকে গ্রেফতার করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লাগবে কেন? পুলিশ কী করছে তাহলে? আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তো এখন পূর্ণমন্ত্রী আছেন, তাই এখন তো বলাই যায়, এই মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক সব দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ প্রধানমন্ত্রী নন। এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন দেশেই ছিলেন। আসলে তাঁর এই নির্দেশে অবাক হইনি, দীর্ঘদিন থেকেই দেখছি, অতি সাধারণ ঘটনাও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া ঘটে না। মন্ত্রীরাও অনেক ক্ষেত্রেই যে কোন পদক্ষেপ নেবার আগে তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। এটা আমাদের জন্য ভীতিকর ব্যাপার, অবিশ্বাস্য পরিমাণ এক-কেন্দ্রীক একটা প্রশাসন এই দেশে চলছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও লিটন গ্রেফতার হয়নি কয়েকদিন পর্যন্ত। তারপর তিনি হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য আবেদন করেন। রায়ে তাকে ১৮ তারিখের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দেয়া হয়। এরপর সরকারী আপিলের ফলে হাইকোর্টের ওই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। এই রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যথার্থভাবেই ঘোষণা করেন, লিটনকে গ্রেফতারে আর কোন সমস্যা নেই (বিস্তারিত)। কিন্তু না, এখনো লিটন গ্রেফতার হয়নি।

প্রাথমিকভাবে খুঁজে পাওয়া না গেলেও হাইকোর্টে জামিন আবেদনের দিন কিন্তু তিনি এসেছিলেন। এরপর তার ওপর নজরদারী করাই যেতো, আর তাকে গ্রেফতার করা যেতো আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবার সাথে সাথেই। কিন্তু কিছুই হল না এখন পর্যন্ত। এই ক্ষেত্রেও দু'টো ব্যাখ্যা দেয়া যায়, এবং দু'টো ব্যাখ্যাই এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদের কাছে ভীতিকর।

প্রথম সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ধরে নেই, লিটনকে গ্রেফতার করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশ আন্তরিক, নেহায়েত পলিটিক্যাল স্টান্ট না। তাহলে প্রশ্ন, দেশের সর্বময় ক্ষমতায় অধিকারী মানুষটার আদেশ অমান্য করার মত শক্তিও এই দেশের সরকারের ভেতরে আছে কারো! অনেক দেশের মত আমাদেরও দৃশ্যমান সরকারের ভেতরে আরেক অদৃশ্য সরকারের অস্তিত্ব আছে, যেটা দৃশ্যমান সরকারের চাইতেও বেশী শক্তিশালী? সেই অদৃশ্য সরকারের প্রভাবেই কি লিটন গ্রেফতার হচ্ছেন না?

আর সম্ভাবনা যদি এটা হয় যে সারা দেশের সব পর্যায়ের মানুষের সমালোচনার জবাবে লিটনকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়াটা প্রধানমন্ত্রীর একটা রাজনৈতিক স্টান্ট, তাহলে সেটা অন্যরকম ভীতি তৈরি করে। এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানোর পরও শুধুমাত্র এমপি হবার কারণে একটা মানুষ আইনের বাইরে থেকে যাবে! এটা অবশ্য অভাবনীয় কোন ব্যাপার না, এই দেশে বাস করে এসব দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিছুদিন আগেও ইয়াবা পাচারের মূল হোতা বদিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, অল্পদিনের মধ্যেই আঙ্গুলে 'ভি' চিহ্ন দেখাতে দেখাতে বেরিয়ে এসেছিল সে। লিটনের ক্ষেত্রে এটাই যদি হয়ে থাকে তবে সেটা ক্ষমতাশালীদের বিচারহীনতার আরেকটা নজির হয়েই থাকবে।

হয়তো লিটন সহসাই গ্রেফতার হবে – এতো কিছুর পর একটা আইওয়াশ তো অন্তত দরকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, লিটনের বিচার হবে না। গরীবের ছেলে পায়ে গুলি খেয়েছে, কিছু টাকা দিয়েই হয়তো সমঝোতা করে ফেলা যাবে। না হলে 'অব্যর্থ দাওয়াই', হুমকি-ধামকি-মাইর তো আছেই।

এই দেশ ক্ষমতাবানদের দেশ, ক্ষমতাবান হতে পারলে এই দেশে যে কেউ আইন ভাঙার লাইসেন্স পেয়ে যায় – সেটা হোক রং সাইডে গাড়ি চালানো, বা মাতাল হয়ে মানুষকে গুলি করা। এমনকি নিজ গাড়িতে ড্রাইভার গুলি খেয়ে মরলেও সেটাকে দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু বানানো যায় অবলীলায়। তাই চারদিকে দেখি কেবলই ক্ষমতা অর্জনের মরিয়া চেষ্টা – আর্থিক, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক। আর যারা সেই চেষ্টায় নেই, বা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন, তারা 'আইনের হাত' বা 'আইনের নিজস্ব গতিতে চলা' দেখবেন অচিরেই।