পরিবহনকর্মীদের মোবাইল কোর্ট দেখানো আর পিটিয়ে মারাঃ গরীব বলে কথা

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 19 Oct 2015, 07:43 PM
Updated : 19 Oct 2015, 07:43 PM

কাল ঢাকায় হঠাৎ করে প্রায় সব বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর স্বাভাবিকভাবেই সেটা নিয়ে মানুষের ভোগান্তি ছিল দারুণ দুর্বিসহ। সব কয়টি পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টিভিতে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ খবর হিসাবেই এসেছে (বিস্তারিত)। আলোচনা চলেছে (অ)সামাজিক মাধমেও। অনেকের মন্তব্যে বেশ স্বস্তির ছাপ দেখেছি, অনেকে সরকারের 'অ্যাকশন' কে প্রশংসা করছেন।

কোন সন্দেহ নেই, সরকারিভাবে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর পর থেকে এই সেক্টরে এক ধরণের নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে (বিস্তারিত)। বিষয়টা মোটেও অভিনব নয়, প্রতিবার ভাড়া বাড়ানোর পরে এটাকে একরম ভবিতব্যই বলা যায়। এবার কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১০ পয়সা। কিন্তু পত্রিকাতেই রিপোর্ট এসেছে রুটভেদে ভাড়া বৃদ্ধির হার কিলোমিটার প্রতি ৫ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত হয়েছে। নিজেও বাসে চড়তে গিয়ে দেখছি ভাড়া নিয়ে যাত্রী আর পরিবহনকর্মীদের মধ্যে ঝগড়া প্রতিদিনকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রে সরকারের 'অ্যাকশন' নেয়া দরকার ছিল।

দেশে পূর্ণাঙ্গ বিচার ব্যাবস্থা থাকতেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব হাতে রাখতে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিরন্তর যুদ্ধ করে যাওয়ার কারণ কাল আবার দেখা গেল। বাড়তি ভাড়া আদায়ের কারণে আর্থিক জরিমানা করা হল, আর কারাদণ্ড দেয়া হল পরিবহনকর্মীদের। এই কারণেই হঠাৎ পরিবহন ধর্মঘটে রাজধানী অচল।

কিন্তু কাল স্তম্ভিত হয়েছি আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটদের কাণ্ড দেখে। অবাক হয়ে ভেবেছি, কোন সব মানুষকে আমরা আমাদের করের টাকায় পুষছি! এদের ঘটে কি এটুকু বুদ্ধি নেই যেটা দিয়ে এরা বুঝবে গণপরিবহনে সরকারি হারের চাইতে বেশি ভাড়া নির্ধারণের দায় পরিবহন মালিকের, কোনভাবেই কর্মীদের নয়। তো কেন ঐ মানুষগুলোকে মোবাইল কোর্ট দেখানো? নাকি কারণটা অন্যকিছু?

আমার ধারণা এর কারণটা আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত। প্রতিদিন যখন বাসে যাত্রীরা পরিবহনকর্মীদের সাথে ভাড়া নিয়ে ভয়ঙ্কর ঝগড়া করে, তখন অনেক পরিবহনকর্মীকে বলতে শুনি ভাড়া নির্ধারণের জন্য তাদের দায় নেই। মালিকের হিসেব মত ভাড়া না তুলতে পারলে তাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মানুষ চড়াও হয় পরিবহনকর্মীদের ওপরই। আর এই চড়াও হওয়াটা এমন পর্যায়েই গেছে যে ভাড়া নিয়ে ঝগড়ার জেরে রংপুরে বাসযাত্রীরা একজন পরিবহনকর্মীকে পিটিয়েই মেরে ফেলেছে আজ (বিস্তারিত)। সমস্যার মূলে না গিয়ে সামনের মানুষটির ওপর রাগ ঝাড়া আমাদের মজ্জাগত। রাগ ঝাড়ার সময়ও আমরা অবশ্য সবার ওপর ঝাড়ি না, কিছু হিসেব নিকেশ করি।

মাঝে মাঝেই রাস্তায় অনেককে দেখি নির্দিষ্ট গন্তব্যে না যাওয়া সহ নানা কারণে রিক্সাচালকদেরকে চড় মারতে। সেই মানুষগুলোই কি একটা ইয়েলো ক্যাব ড্রাইভারকে কখনো চড় মারে? সেই স্পর্ধা দেখায়? মালিক না হোক, এমনকি শ্রমিকের মধ্যেও যার অবস্থা কম প্রান্তিক সে আমাদের ক্রোধের চড় থেকে বেঁচে যায়।

এই ঘটনাটিই করে দেখালেন আমাদের মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেটগণ। তাঁরাও ভালভাবেই জানেন মালিকদেরকে 'হাইকোর্ট' দেখানো দূরেই থাকুক, মোবাইল কোর্ট দেখানোও কঠিন। তাই পরিবহনকর্মীই সই। আর এতেই 'অ্যাকশন' শুরু হয়েছে মনে করে আমরা অনেকে আহ্লাদে গদগদ। কারণ বাসে উঠলেই যে কোন অযুহাতে পরিবহনকর্মীদের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়া ছাড়া আমাদের অনেকেরই বাস ভ্রমণ 'জমে' না। মানি, কিছু ক্ষেত্রে ওদের ভুল থাকে, কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই (আমি অন্তত যতগুলো দেখেছি) যাত্রীদের কারণেই ঝগড়া হয়। কয়েকবার পরিবহনকর্মীদের সাথে অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজে যাত্রীদের রোষে পড়ার অভিজ্ঞতাও আমার আছে।

এই ব্লগে দীর্ঘদিনের লিখায় নানা পোস্টে আমি মাঝে মাঝেই দেখাতে চেষ্টা করেছি, এই সমাজের আইনি/বেআইনি সব ধরণের নির্যাতন মূলত সেই মানুষগুলোর ওপরই চেপে বসে যারা অনেক বেশি প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। গত দুই দিনে ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানা করা, কারাদণ্ড দেয়া থেকে শুরু করে পরিবহনকর্মীদের সাথে অন্যায় আচরণ করা, পিটিয়ে মেরে ফেলার মূল আসলে এক জায়গায় – এদের সাথে যাচ্ছেতাই করে পার পার পাওয়া যায় সহজেই – গরীব বলে কথা।