নারিকেল গাছ ‘গাছ’ নয়; ‘মানুষ’ নয়, গরীব মানুষ

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 29 Jan 2016, 10:57 AM
Updated : 29 Jan 2016, 10:57 AM

বিডিনিউজ২৪ এর গতকালের একটি শিরোনামে চোখ আটকে গেল। ক্লিক করতে করতেই ভাবছিলাম, কী হতে পারে বিষয়টা। খবরটা পড়লাম, আর আবারো বুঝলাম, মানুষের অতি চালাকি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! খবরটা হলো, ভারতের গোয়া রাজ্যে নারিকেল গাছকে গাছের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আইনটির পক্ষে গোয়ার পরিবেশ মন্ত্রী রাজেন্দ্র আর্লেকারের মন্তব্য, "উদ্ভিদবিদ্যা অনুযায়ী নারিকেল গাছকে 'গাছ' বলা যায় না, কারণ এতে কোনো 'শাখা' নেই"।

এই পর্যন্ত পড়ে মনে কৌতুহল উঁকি দিতেই পারে, ওই সরকার কেন এই রকম ফালতু কথা বলে নারিকেল গাছের নাম গাছের খাতা থেকে কেটে দিচ্ছে? আরেকটু পড়তেই সেটা স্পষ্ট হয় অনেকটা – "নতুন এই আইন হওয়ায় গোয়ায় নারিকেল গাছ কাটতে আর আগের মতো বনবিভাগের অনুমতি নিতে হবে না"।

বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া গাছ কাটার ক্ষমতা দেবার কারণ একেবারে পরিষ্কার ওখানকার পরিবেশবাদীদের বক্তব্যে। ওই রিপোর্টেই আছে, "অবশ্য পরিবেশবিদরা গোয়া সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের ভাষ্য, রিয়েল এস্টেট ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই সরকার এই 'আত্মঘাতী' সিদ্ধান্তের দিকে ঝুঁকেছে। আগের আইনে দুই হেক্টরের বেশি জমিতে গাছ কাটতে বাধা ছিলো, যার ফলে চাষের জমি ও পাহাড়ি অঞ্চলে বড় ধরনের নির্মাণ সম্ভব হচ্ছিল না। নতুন আইনে সেই বাধা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে', বলেন গোয়ার পরিবেশবিদ ক্লাউড আলভারেজ"। বিস্তারিত রিপোর্ট এখানে

এবার তাকানো যাক বাংলাদেশের দিকে। দেশব্যাপী সরকারের কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে, যার জন্য ইতোমধ্যে চান্দপুর চা বাগান এলাকায় ৫১১ একর জমি বরাদ্দ করেছে সরকার। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই জমির ভোগ-দখল চা শ্রমিকদের হাতে, কিন্তু এই অধিগ্রহণে উচ্ছেদ হবে ১৬ হাজার 'মানুষ'। ৬৯ টাকা 'মজুরি' পাওয়া চা শ্রমিকদের জীবনটাকে কোন রকমে টেনে নিয়ে যেতে ওই জমির ফসল যে অনেক বড় প্রভাব রাখতো, সেটা বলাই বাহুল্য। তাই ভূমি রক্ষার্থে আন্দোলনে নামতে হয়েছে তাঁদের। (বিস্তারিত)

এবার একটা বস্তির কথা, নাম 'পোড়া বস্তি'; নামেই স্পষ্ট, কোন এক কালে এই বস্তি পুড়েছিল (পড়ুন, আগুন লাগানো হয়েছিল)। কিন্তু সরকারী জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই বস্তি উচ্ছেদ করতে গিয়ে ঘটলো লঙ্কাকান্ড। এরপর হাইকোর্টে রিট, এবং তিন মাসের জন্য হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা (বিস্তারিত)। কিন্তু না, বস্তিবাসীর কপালে সুখ সইলো না, পরেরদিনই লাগলো উচ্ছেদের আগুন (বিস্তারিত)। এই বস্তির নাম কি এখন থেকে হবে 'ডাবল পোড়া বস্তি'?

এই দেশের সরকারী জমিতে অবৈধ দখল আছে দীর্ঘকাল থেকেই। এই দেশের প্রভাবশালীদের সম্পদের এক বিরাট উৎস হলো সরকারী সম্পত্তি দখল। জমি তো বটেই এদের দ্বারাই দখল হয়ে ভরাট হয়ে গেছে নদীও। কিন্তু, মাঝে মাঝে এদেরকে উচ্ছেদের 'নাটক' করা হলেও এরা থেকে যায় বহাল তবিয়তেই।

প্রায়ই বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই বলা হয়, 'উন্নয়ন' এর মাসুল আছে – কিছু মানুষ এর ভুক্তভোগী হয়। আপাতদৃষ্টিতে কথাটাকে ঠিকই মনে হয়। তবে সমস্যা হলো, আমাদের অভিজ্ঞতা; ভুক্তভোগী হয় শুধু গরিবরাই, ক্ষমতাবানরা থেকে যায় উন্নয়নের মাসুল থেকে বহু দূরে।

"কম গণতন্ত্র, বেশী উন্নয়ন" স্লোগান দেয়া আমাদের বর্তমান সরকার গোয়া সরকারের বুদ্ধি নিতে পারে। তারা একটা আইন প্রণয়ন করুক – গরীব মানুষ, মানুষ না। মুখে যাই বলি না কেন, গরীবকে মানুষ বলে মনে করি না আমরা। এবার এটাকে আইনে পরিণত করলেই হয়। শাখা না থাকার জন্য নারিকেল গাছ যেমন গাছ না, ঠিক তেমন একটা 'যৌক্তিক' কারণ সরকারী থিঙ্কট্যাঙ্ক অবশ্যই বের করবে। এই আইন করা গেলে 'উন্নয়ন' এর জন্য ওদেরকে উচ্ছেদ করতে গেলে কেউ আইনী ব্যবস্থা নিতে পারবে না।

গরীব দেশগুলো "উন্নয়নের মহাসড়কে" যখন তুমুল বেগে ধাবিত হয়, তখন শাসক, আর ক্ষমতাবানদের কাছে 'ভাবালুতা'র জায়গা কোথায়? উন্নয়নের যান পিষ্ট করে যাবে তার পথে 'নীচু জাত' এর যাই আসুক – হোক সেটা নারিকেল গাছ, কিংবা গরীব মানুষ।