কানে ধরে আমাদের জরুরী ‘শিক্ষা’ দিলেন; ধন্যবাদ সেলিম ওসমান

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 17 May 2016, 06:13 PM
Updated : 17 May 2016, 06:13 PM

গত কয়েকদিন ধরে মূল ধারার আর সামাজিক মিডিয়ায় তুমুল আলোচিত ঘটনা নারায়ণগঞ্জের এমপি সেলিম ওসমান কর্তৃক বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তির কান ধরে উঠবস করানো। আমরা ফেইসবুকীয় প্রতিবাদে ফেটে পড়ছি যার যার মতো করে। কিন্তু আমাদের অনেকেই বিষয়টার অন্যদিক দেখছি না সম্ভবতঃ। ওই ঘটনার পর থেকে নানা ঘটনা ঘটছে, নানা জনের নানা বিবৃতি আসছে আমাদের সামনে, যেগুলো আমাদের কানে ধরে অনেক জরুরি জিনিষ 'শিক্ষা' দিলো আমাদের। দেখা যাক কয়েকটা –

১. শেষ ঘটনা দিয়ে শুরু করি। আজকের খবরে দেখা যায়, শ্যামল কান্তি বরখাস্ত হয়েছেন (বিস্তারিত)। একটা বর্বরোচিত ঘটনার শিকার হবার পর সারা দেশের মানুষ যৌক্তিভাবেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠে দাঁড়িয়েছে শ্যামল কান্তির পক্ষে। এই ক্ষোভে ফেটে পড়ার মধ্যেই বরখাস্ত হতে হয় শ্যামল কান্তিকে। এক ব্যক্তি সেলিম ওসমান কোটি কোটি মানুষকে শিক্ষা দিলেন, কোটি কোটি মানুষকে তিনি 'পোঁছেন' না। (এটাই হবার কথা, একটা কথ্য প্রবচন মনে পড়লো "পাঁঠা কোঁদে খুঁটার জোরে"। এই 'পাঁঠা'র খুঁটা কে, দেশবাসী জানেন)।

২. আমরা শিখলাম, আপনি যদি এমন কোন চাকুরী করেন, যেটায় একজন ক্ষমতাশালী মানুষ (আর সেটা বিশেষ পরিবারের কেউ হলে তো কথাই নেই) তার পছন্দের কাউকে বসাতে চায়, তাহলে সসন্মানে সেটা ছেড়ে দিয়ে আসা উচিৎ। তাতে অন্তত হাজার হাজার মানুষের সামনে কানে ধরে উঠবস জাতীয় হেনস্তা হতে হবে না।

৩. ঘটনার দিন মসজিদের মাইকে ইসলাম অবমাননার ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করিয়ে ওইদিনের পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে। আমরা শিখলাম, আপনি যদি কোন ক্ষমতাবান এর চক্ষুশূল হন, তাহলে তিনি আপনার নামে এরকম কথা রটিয়ে আপনাকে অতি সহজেই হেনস্তা করতে পারেন। এমনকি চাইলে আপনাকে মেরেও ফেলতে পারেন 'গণপিটুনি' খাইয়ে।

৪. আমরা এটাও শিখলাম, মুসলিম হলে হয়তো ধর্ম অবমাননার অভিযোগ নিয়ে দুই বার ভাববে কেউ, কিন্তু ভীন্নধর্মী কেউ হলে দ্বিতীয় ভাবার সময়-ইচ্ছে কারো হবে না। এখানে রামু'র ঘটনা স্মর্তব্য।

৫. স্কুলে শ্যামল কান্তিকে নিয়ে যখন পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে তখন সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশের এসপি সবাই ছিলেন। এরপরও তাঁরা এমপি কে ডেকেছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের শেখানো হল, জনগণের টাকায় পোষা প্রশাসন এতোই অথর্ব, তাঁরা নিজেরা কয়েক শত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

৬. একজন এমপি'র এতোটা স্পর্ধা হয়েছে এই দেশে যে তিনি একজন পঞ্চাশোর্ধ শিক্ষককে এভাবে হেনস্তা করতে পারেন। অনেকগুলো পত্রিকা আর টিভির অনুসন্ধানী রিপোর্টে এসেছে শ্যামল কান্তি ধর্ম অবমাননা করার মতো কোন মন্তব্য করেননি, তবে তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই শ্যামল কান্তির ইসলাম অবমাননার অভিযোগ সত্যি, তারপরও কি একজন এমপি এভাবে তথাকথিত বিচার করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত? আমরা আবারো জানলাম, এটা একটা স্বাধীন দেশ না, এটা মগের মুলুক।

৭. ঘটনার পর দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের এসপি বলেছিলেন, এই ব্যাপারে তাঁর কিছু করার নেই, কারণ তিনি 'কোন অপরাধ ঘটতে দেখেননি'। আইনের হাত অনেক লম্বা বলে শোনা যায়, কিন্তু আবারো প্রমাণ হলো ওটা স্রেফ কথার কথা – আইনের হাত কখনোই পৌঁছে না ক্ষমতাশালীদের পর্যন্ত। এটাও জানলাম আমাদের এসপি দের বুদ্ধি বেশ ভালো – প্রবল পরাক্রমশালী পরিবারের বিরুদ্ধে যাবার বোকামি তাঁরা করেন না।

৮. গতকাল শিক্ষামন্ত্রীর, আর আজ আইনমন্ত্রীর বিবৃতি এসেছে মিডিয়ায়। একটা ঘটনা যেটা দেশে অনেক তোলপাড় ফেলে দেয়, সেটায় 'নগদ' কিছু বিবৃতি দিয়ে দেয়ার চর্চা আবার দেখলাম। একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনার স্পষ্ট ভিডিও আছে, অভিযুক্ত এমপি'র স্বীকারোক্তি আছে, এরপরও মন্ত্রীদ্বয়ের একজন বিব্রত হন (বিস্তারিত), আরেকজন এটাকে অপরাধ মনে করেন (বিস্তারিত)। আমাদের লোকজ প্রবাদ আছে, কথায় চিঁড়ে ভেজে না, কাজ দেখতে চেয়েছিল দেশবাসী – ওই অভিযুক্ত এমপি'র নামে মামলা আর তার গ্রেফতার দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু না, আমরা আবারো শিখলাম এই দেশের রাজনীতিকরা কথা দিয়ে চিঁড়ে ভেজানোর চেষ্টাতেই পটু, কাজে নয়।

৯. এই ঘটনার পর এখনো কোন মামলা হয়নি। ঘটনার দিন শ্যামল কান্তি কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মামলার ব্যাপারে। তিনি নিজের নিরাপত্তাহীনতা জনিত ভীতির কথা জানিয়েছিলেন। আইন সম্পর্কে ধারণা কম, কিন্তু পুলিশ নিজে কি কোন মামলা করতে পারে না? আমরা আবারো শিখলাম, 'আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে' বলে যা বলা হয় সেটা স্রেফ একটা বাকোয়াজ।

১০. নারায়ণগঞ্জের এই পরিবারটা একটার পর একটা কুখ্যাত ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, কিন্তু কারো কিছু করার নেই। আমাদের কান ধরে আবারো শিখিয়ে দেয়া হল, দেশের সর্বোচ্চ মহলের কাছে কোটি কোটি মানুষের চাইতে একটা পরিবার অনেক বড়।

আশা করি আমরা, সচেতনরা এটা থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নিয়েছি। এই দেশে বসবাস করতে গেলে এই অতি জরুরী শিক্ষাগুলো আমাদের থাকা দরকার। কম-বেশী এসব শিক্ষা আছেও আমাদের, কিন্তু এরকম প্রতিটি ঘটনার পর আমাদের আবার নতুন করে এই শিক্ষা নেয়া উচিৎ। কানে ধরে উঠবস করার ঘটনা জন্ম দিয়ে আমাদের এই দেশে বসবাসের এই অতি জরুরী শিক্ষা দেবার জন্য সেলিম ওসমান একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারেন।