মুহাম্মাদ আলি, গ্ল্যাডিয়েটর আর বিভৎস বিনোদনের কথা

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 4 June 2016, 06:06 PM
Updated : 4 June 2016, 06:06 PM

আজ সকালে বক্সার মুহাম্মাদ আলির মৃত্যু হয়েছে, সারা প্রথিবীর মতো বাংলাদেশেও আজ তিনি শিরোনামে থাকবেন। এটা স্বাভাবিক, বিবিসি সহ আরো কিছু স্বীকৃত সংস্থার বিচারে তিনি ছিলেন গত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ। অবশ্য তিনি যে 'খেলা'র কিংবদন্তি সেটাকে যদি আদৌ খেলা বলা যায়। এই একবিংশ শতাব্দীতে বক্সিং কি খেলা হতে পারে কোনোভাবে?

গ্ল্যাডিয়েটর শব্দটার সাথে আমরা কম বেশি পরিচিত। বিশেষ করে রিডলি স্কট পরিচালিত, রাসেল ক্রো অভিনীত 'গ্ল্যাডিয়েটর' সিনেমাটা ওই সময়ের কথা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। সেই সিনেমা আমাদের অনেকের কাছে গ্ল্যাডিয়েটরদের পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে শুরু হয়ে প্রায় এক হাজার বছর টিকে থাকলেও গ্ল্যাডিয়েটরদের স্বর্ণযুগ বলা যায়, রোম সাম্রাজ্যের সময়, প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে। মানুষের 'সৃজনশীলতা' আবিষ্কার করেছে নানা ফর্মের যুদ্ধ গ্ল্যাডিয়েটরদের সাথে অন্য গ্ল্যাডিয়েটর এর, ভয়ঙ্কর অপরাধীর, হিংস্র প্রাণীর। খেলার জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতো যে কোন একজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

এখানে খুব লক্ষণীয় ব্যাপার হলো মূলতঃ ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দী, আটককৃত ভয়ঙ্কর অপরাধীদেরকে গ্ল্যাডিয়েটর হতে বাধ্য করা হলেও সমাজের অনেক মানুষ স্বেচ্ছায় এই পেশায় যোগ দিতো, কারণ একজন গ্ল্যাডিয়েটর এর সামাজিক মর্যাদা, প্রতিপত্তি ছিল অনেক উঁচুতে। এই বীভৎসতা কত মানুষকে বিনোদিত করতো সেটার সাক্ষী হয়ে প্রকান্ড কলোসিয়াম আজও রোম শহরে দাঁড়িয়ে আছে।

বিভৎসতা দেখা আমাদের বিনোদিত করে, সেটা হোক আদিতে, কিংবা এখন। আমাদের জন্মগত কিছু বৈশিষ্ট্য যেগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় 'id' বলে সেগুলো আমাদের মধ্যে এখনও আছে খুব প্রবলভাবে। বিদ্যমান সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেটাকে ক্রমাগতভাবে উস্কে দিচ্ছে। তাই আজকের পৃথিবীতেও রোমের বীভৎসতা ভর করে। আজকের পৃথিবীতে ঘোষণা দিয়ে পরাজিতকে মেরে ফেলা হয়তো যায় না, কিন্তু খেলার নামে চরম হিংস্রভাবে একজন মানুষ অপরজনকে মারতে পারে। আর এটা দেখে এখনও বিনোদিত হই আমরা।

কিছুদিন আগের ঘটনায় ফিরে যাই। বক্সিং এর একটা ফাইট, যেটাকে ঘোষণা করা হয়েছে "Fight of the Century" বলে, সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুললো। শিরোপার জন্য ফ্লয়েড মেওয়েদার লড়েছিলেন ম্যানি প্যাকিয়াও এর সাথে। ওই ফাইট এর কিছু পরিসংখ্যান –

হেরে গিয়েও প্যাকিয়াও পেয়েছিলেন প্রায় ১১০০ কোটি টাকা; জিতে মেওয়েদার পেয়েছিলেন প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা। ১৬,৫০০ আসনের এমজিএম অডিটোরিয়ামে এই ফাইট হয়েছিল, সেটায় প্রবেশের সাধারন টিকেটের মূল্য ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে নয় লাখ টাকা। বক্সিং রিং এর কাছে বিশেষ টিকিটের মূল্য ছিল আশি লাখ টাকা। কে ছিল না সেই দর্শকের সারিতে, সব অঙ্গনের সেলিব্রিটির মেলা বসেছিল ওই অডিটোরিয়ামে। আপনার যথেষ্ট টাকা নেই? তাহলে বাসায় টিভিতে দেখুন, কিন্তু চ্যানেল থাকলেও শুধু এই ফাইট টিভিতে দেখার জন্য আপনাকে আলাদাভাবে দিতে হবে ৮ হাজার টাকা।

রোমের কলোসিয়ামের ভেতরে রক্ত আর মৃত্যু দেখতে দেখতে উল্লাস করা সেকালের দর্শকদের সাথে কোথায় পার্থক্য একালের এমজিএম অডিটোরিয়ামের ভেতরের সুবেশী দর্শকদের? একজন মানুষ আরেকজনকে মেরে চেষ্টা করছে 'নক আউট' করতে যেন সে আর উঠে দাঁড়াতে না পারে। সেটা দেখে আমরা হাততালি দেই, উল্লাস করি। এমন বীভৎস বিনোদন আজও পাই আমরা।

গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো তাৎক্ষণিক মৃত্যু না হলেও বক্সিং রিং এ মৃত্যু বেশ কমন ঘটনা। উইকিপিডিয়ার এই লিংকে দেখা যায় বক্সিং রিং এ রেকর্ডেড মৃত্যুর সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি (আন-রেকর্ডেড মৃত্যু এর কয়েকগুন হবে নিশ্চয়ই)। কিন্তু এরপরও এই খেলায় কেন যায় মানুষ? উত্তরটা জানা যাবে এই লিংকে – পৃথিবীর সবচাইতে বেশি উপার্জন করা ক্রীড়াবিদদের যে তালিকা ফোর্বস ম্যাগাজিন করেছে, তাতে রোনালদো, মেসি, ফেদেরার ল্যাব্রন জেমস দের পেছনে ফেলে সবার উপরের নাম দু'টি এই পোস্টেই উল্লেখ করা দুই বক্সারের।

দুঃখিত, বক্সিংকে আমি খেলা মনে করি না। এই বিভৎসতাকে কোনভাবেই খেলা হিসাবে মেনে নিতে পারি না আমি। দুঃখিত, এই খেলা দেখে যারা বিনোদিত হন, যারা সেই বিনোদন যোগাতে আসেন তাদের কাউকেই আমি সন্মানের চোখে দেখি না। কামনা করি এই 'খেলা' নিষিদ্ধ হোক।

বক্সিং দেখুক, না দেখুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই আজ মুহাম্মাদ আলিকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন – স্রোতের সাথে থাকতে হবে না? সত্যি বলতে একজন বিশ্বজয়ী বক্সার হিসাবে আমার কাছে ন্যূনতম সন্মানের যোগ্য আলি নন। তবে তাঁকে সন্মান করি, সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে, যার জন্য তাঁর জেল হয়, খেতাব হারান তিনি। তাঁকে সন্মান করি কারণ কালো মানুষদের অধিকারের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন নিরলস।

হ্যাঁ, আলির মৃত্যুতে আমি দুঃখিত, উপরের কারণের জন্য, আর জন ডান এর বিখ্যাত কবিতা "ফর হোম দ্য বেল টোলস" এর মতো আমি নিজেকে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনে করি না, বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষ বৃহত্তর মানব সত্ত্বার অংশ। তাই কারো মৃত্যু ঘোষণায় গির্জার ঘন্টা বাজলে সেটা আমাদের সবার জন্যও বাজে।