মন্ত্রীদের ওপর ‘আশি’ আসুক নেমে

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 8 June 2016, 07:00 PM
Updated : 8 June 2016, 07:00 PM

বাংলার স্বাপ্নিক কবি সুকান্ত "আঠারো বছর বয়স" কবিতায় আঠারো বছর বয়সের নানা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন। দুঃসাহসে, বীরত্বে, স্পর্ধায়, শপথে আঠারো বছর বয়সের নানা গুণগান করার পর তিনি স্বপ্ন দেখেছেন আঠারো বছর বয়সের সব বৈশিষ্ট্য দেশের সবার ওপরে নেমে আসবে। তিনি কবিতাটা শেষ করেছেন এভাবে –

"এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।"

এই কবিতার শেষ বাক্যটির অনুকরণেই এই পোস্টের শিরোনাম লিখা হয়েছে। শিরোনামটি মাথায় এসেছে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীর একটি উক্তি থেকে।

দীর্ঘকাল থেকে খেয়াল করছি, বিএনপি'র সরকার হোক বা আওয়ামী লীগের, সব মন্ত্রী একটা রোগে আক্রান্ত – 'ডিনায়াল সিনড্রোম'। দেশে যাচ্ছেতাই হবে, মিডিয়া সেগুলো আমাদের সামনে নিয়ে আসবে। কিন্তু মন্ত্রীদের কাছে যখন জিজ্ঞেস করবেন, তিনি অস্বীকার করবেন। রোজায় কিছু পণ্যের দাম অবিশ্বাস্য পরিমান বাড়লো রোজার আগে, কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন দাম খুব একটা বাড়েনি। বিএনপি'র সময় তো একবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বয়ং খালেদা জিয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বলেছিলেন, "বাজারে দাম বাড়েনি, বেড়েছে পত্রিকায়"।

দেশে খুন, ডাকাতি ছিনতাই বাড়বে, কিন্তু যে কোন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলবেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। বিএনপি'র সময় তো বাংলা ভাই রাজত্ব কায়েম করে, মানুষ মেরে রীতিমত গাছে ঝুলিয়ে রাখতো, কিন্তু তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিজামীর 'বাংলা ভাই বাস্তবে নেই, মিডিয়ার সৃষ্টি' মন্তব্য আজও আমাদের কানে বাজে।

এই সরকারের সময় প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, ফাঁস করা হওয়া প্রশ্ন ফেইসবুকে সবার হাতে হাতে চলে গেছে। সরকারেরই কাছের মানুষ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ক্রমাগত চেঁচিয়ে গেছেন, কিন্তু আমাদের শিক্ষামন্ত্রী দীর্ঘদিন স্বীকারই করেননি। ফিরিস্তি দিতে গেলে হাজার হাজার শব্দ লিখা যাবে, তাই ক্ষান্ত দিচ্ছি আপাতত, আর একটু খোঁজখবর যারা রাখেন তাদের সবই মনে থাকারই কথা।

কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, মন্ত্রীদের কথা কি আমরা বিশ্বাস করি? তো তাঁদের ডিনায়াল এ আমাদের কী আসে যায়? আসলে ভীষণ রকম দুঃশাসনের মধ্যে বসবাস করতে করতে মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস উঠে যায় এই দেশে, তার ওপর যখন মন্ত্রীরা এসব কথা বলেন, তখন যা হয়, সেটাকে বাংলা প্রবাদ জানায় এভাবে – 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা'।

আর ডিনাই না করে সমস্যার স্বীকৃতি দিলে আমাদের সরকারগুলো কোনোদিন তাদের ভুল কিছুটা হলেও শুধরে আমাদের সুশাসন দেবার চেষ্টা করবে, এই দিবাস্বপ্ন আমরা দেখতে পারতাম। মন্ত্রীদের ডিনায়াল দেখে দেখে কোন কালে আমাদের দেশে কিছুটা হলেও সুশাসন হবে, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও এই যৌক্তিক আশা করা দূরে থাকুক এটাকে দিবাস্বপ্ন হিসাবেও দেখার সাহস পাই না আমরা। তাই আমরা দেখতে চাই রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান না হলেও কোন ক্রাইসিস এর পরে মন্ত্রীরা অন্তত সমস্যাটা আমাদের সামনে স্বীকার করুন।

একটা উল্টো উদাহরণ দেয়া যাক। আমারদের দারুণ চটপটে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখি ঈদের রাস্তাঘাটের সমস্যা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সেটা স্বীকার করেন, দুঃখ প্রকাশ করেন – এতে মানুষের কষ্টের ক্ষতে অন্তত কিছুটা মলম পড়ে, অন্যদের মতো ক্ষতে লবন ছিটিয়ে যান না তিনি। কেউ যদি নির্মোহভাবে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় অন্যসব মন্ত্রণালয়ের চাইতে আদৌ খুব ভালো চলছে না, কিন্তু এই সরকারের 'ভালো' মন্ত্রীদের তালিকা করতে বললে করলে অনেকেই তাঁর নাম রাখবেন সেখানে।

এই ব্লগ লিখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের অর্থমন্ত্রীর এক আলোচিত উক্তি শুনে। গতকাল সংসদে ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি নিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন – পুকুর নয়, সাগর চুরি হয়েছে। যদিও হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর তিনি বলেছিলেন, ৫ হাজার কোটি তেমন কোন টাকা না। কিন্তু সরকারে থেকেও মাঝে মাঝেই মুখ দিয়ে সত্য কথা বেরিয়ে যায়, যেমন বেরোলো কাল, যেটা সরকারকে বিব্রত করবে, সন্দেহ নেই। তিনি কেন মাঝে মাঝে এমন করেন, সেটা জানায় কিছুদিন আগে করা তাঁর একটা উক্তি। সরকারকে বিব্রত করা এক মন্তব্যের পরে বলেছিলেন, বয়সের কারণে তাঁর কথায় মাঝে মাঝে ভুল হয়।

অর্থমন্ত্রীর বর্তমান বয়স পঁচাশি। আওয়ামী লীগের এই মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় আশি। বয়সের কারণে কিছু উল্টোপাল্টা কথা বললেও দারুণ কিছু সত্য কথাও বলে ফেলেন তিনি। স্বীকারোক্তির কথাগুলো আমরা আগে থেকেই জানি, কিন্তু মন্ত্রীদের স্বীকারোক্তি দেখতে ভালো লাগে।

যেহেতু আমাদের অর্থমন্ত্রীর আশি বছর বয়স হবার পর থেকে এসব কথা বেরোচ্ছে, তাই ধরেই নেয়া যায় আঠারোর মতো আশি বছর বয়সেরও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে, এর মধ্যে একটা নিশ্চয়ই 'ডিনায়াল সিনড্রোম' রোগ কিছুটা হলেও কমে যাওয়া। তাই সুকান্তর স্টাইল অনুসরণ করে আমি কামণা করছি আমাদের সব মন্ত্রীদের ওপর 'আশি' আসুক নেমে। তাতে যদি তাঁরা মানুষের সামনে ভুল স্বীকার করেন, সেটা শোধরাবার অঙ্গীকার করেন।