শাহাদাত-হ্যাপি কাণ্ড: ন্যায়বিচার নয়, ভাতই সুগন্ধময়

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 25 August 2016, 00:04 AM
Updated : 25 August 2016, 00:04 AM

অনেকটা কাছাকাছি সময়ে আমাদের জাতীয় দলের দুই ক্রিকেটার রুবেল আর শাহাদাত এর নামের সাথে দুই 'হ্যাপি' যুক্ত হয়েছিল। রুবেলের সাথে যুক্ত হ্যাপিকে আমরা খুব ভালোভাবে চিনি, কারণ মুহুর্মুহু ফেইসবুক স্ট্যাটাসে সে আমাদের সামনে এসে নানা কথা জানাতে পেরেছিল। কিন্তু শাহাদাত এর সাথে যুক্ত হ্যাপি এতো সৌভাগ্যের আশেপাশেও নেই – কারণ, সে হলো 'ফকিন্নির ঝি'।

আমরা নিশ্চয়ই অনেকেই জানতাম না, শাহাদাত এর বাসার গৃহকর্মীটির নামও হ্যাপি – নিজের পেট চালানোর জন্য মানুষের বাসার কাজে সাহায্য করে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পরও এই মানুষগুলো আমাদের অনেকের চোখে স্রেফ 'কামের মাইয়া'। বছর খানেক আগে এই হ্যাপি শিরোনামে এসেছিল শাহাদাত আর তার স্ত্রীর ভীষণ অত্যাচার হতে পালিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে। সংবাদ মাধ্যমে আমরা তখন দেখেছি কী বিভৎস, বর্বর নির্যাতনের চিহ্ন ছিল বাচ্চা মেয়েটির শরীরে!

এই হ্যাপি আজ আবার সংবাদ শিরোনামে (গৃহকর্মী হ্যাপিকে 'ম্যানেজ' করেছেন ক্রিকেটার শাহাদাত) – আদালতে শাহাদাত আর তার স্ত্রীকে যাবতীয় অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে সে – জানিয়েছে তার ওপর কোন অত্যাচার, নির্যাতন হয়নি, এমনকি গত বছর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিতে সে কী বলেছিলো সেটা তার 'মনে নেই'। অনুমান করাই যায় কী ঘটতে যাচ্ছে এই মামলার ভাগ্যে।

ফেইসবুকে দেখি বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে মধ্যে ক্ষোভ, হা-হুতাশ; সেটা প্রকাশ পাচ্ছে তাদের নানা রকম মন্তব্যে। শাহাদাত-কাণ্ডে আমাদের বেশিরভাগের হৈ চৈ আদৌ কোন মানবিকতা কিনা, সেটা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে, আর সেটা নিয়ে সেই সময় একটা পোস্ট লিখেছিলাম – শাহাদাতকাণ্ডে হাউকাউঃ মানববিকতা নয়, আমাদের 'স্ক্যান্ডাল ভোজ'। তবে আলোচনার স্বার্থে আপাতত ধরে নেই, প্রায় সব মানুষের এই বোধ মানবিক।

আমরা প্রত্যাশা করেছি একজন 'জাতীয় বীর' এর (ক্রিকেটাররা আমাদের প্রায় সবার চোখে বীরই তো) বিরুদ্ধে মামলা করে একজন নেহায়েৎ 'ফকিন্নির ঝি' জিতে যাবে, আর সেটা দেখে আমরা আমাদের দেশের আইনের শাসনের নমুনা পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবো। সেটা না হতে দেখে আমরা অনেকেই হতাশ হয়েছি, সেটার প্রকাশ দেখছি ফেইসবুকে। আমি কিন্তু বিন্দুমাত্রও অবাক হইনি এই ঘটনায়।

বেশ কিছুদিন আগে একবার কোন এক গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় একজন আইনজীবী টিভিতে এসেছিলেন, জানিয়েছিলেন এসব মামলা ভবিষ্যতে কী হয়। তাঁর কথাতেই জেনেছিলাম, ভালো আইনি লড়াই খুব খরচ সাপেক্ষ হলেও এসব দরিদ্র মানুষ খুব ভালো আইনি সাহায্য পায়, কারণ এমন 'চাঞ্চল্যকর' মামলা লড়ার জন্য অনেক সংস্থা বিনামূল্যে আইনি সাহায্য দেয়। কিন্তু সমস্যা হয় অন্যখানে, শক্তিমান প্রতিপক্ষ খুব দ্রুত নির্যাতিত শিশুটির পরিবারকে টাকা দিয়ে 'ম্যানেজ' করে ফেলে, আর মামলাটির মৃত্যু হয় খুব দ্রুতই।

আমরা যারা ফেইসবুকে ক্ষুব্ধ হচ্ছি, মন খারাপ করছি এই ঘটনায়, তারা হয়তো কোনদিন এই প্রান্তিক মানুষদের ভয়ঙ্কর অপ্রাপ্তি নিয়ে খোঁজ নেই না। দেশের নানা প্রান্তে গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর অতি সাধারণ হলেও কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ তাঁর শিশু সন্তানটিকে কারো বাসায় কাজ দেয়, সেটা অনুধাবন করার মতো পরিস্থিতির কাছাকাছিও আমরা ছিলাম না।

আমি ভীষণভাবে 'ভেতো বাঙালি' – ভাত ছাড়া আমার চলেই না। কিন্তু এই অতি প্রিয় ভাতের গন্ধ আমার কাছে কোনদিন সুঘ্রাণ মনে হয়নি। বুঝলাম গরম ভাতের গন্ধ সুঘ্রাণ হয়ে ওঠার জন্য একটা নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক সামর্থ্যের নীচে অবস্থান করতে হয়, সৌভাগ্যক্রমে আমার অবস্থান সেই পর্যায়ের অনেকটা ওপরে। তাইতো বাস্তবে কিছু করতে পারি বা নাই পারি, ব্লগে বা ফেইসবুকে রাজা-উজির মারার মতো 'বিলাসিতা'র সুযোগ আছে আমার। তাই আমার ওপর কোন প্রভাবশালীর ভয়ঙ্কর অন্যায় হলে সেই ব্যক্তির প্রভাবের কারণে ন্যায়বিচার পাবো না জানি, কিন্তু টাকা নিয়ে 'ম্যানেজড' হয়ে বিচারের দাবি থেকে সরে আসবো না নিশ্চয়ই।

কিন্তু হ্যাপি'দের পরিবারের বাস্তবতা ভীন্ন, ওরা জানে ন্যায়বিচার খাওয়া যায় না – বরং 'ম্যানেজড' হবার জন্য নিপীড়কের কাছ থেকে পাওয়া টাকা তাদের পরিবারে ভাত যোগাবে অনেকদিন। ওরা জানে 'জন্ম'ই তাদের 'আজন্ম পাপ'; আর এই পাপের মাশুল আমৃত্যু দিয়ে যেতে হবে নানাভাবে। মানুষ বাড়িতে উদয়াস্ত খাটা, আর কথায় কথায় নির্যাতিত হওয়া সেই 'আজন্ম পাপ' এর একটা মাশুল। এই 'আজন্ম পাপ'ই তাকে জানায়, ন্যায়বিচার গন্ধহীন, কিন্তু গরম ভাত দারুণ সুগন্ধময়।