ফারাক্কা নিয়ে চর্বিত-চর্বন

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 27 August 2016, 05:39 PM
Updated : 27 August 2016, 05:39 PM

কালকের ফেইসবুক যারা খেয়াল করেছেন, তাদের কাছে আজ সকালের ব্রেকিং নিউজটা তেমন কোন আবেদন যোগায়নি। কারণ গতকালই ফেইসবুকে জল্পনা-কল্পণা চলছিল ফারাক্কার সব গেইট খুলে দেবার পর দেশের উত্তরাঞ্চলে যে বিপর্যয় ঘটেছে সেই পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য কোন কোন ইস্যু 'পয়দা' হতে পারে। জিয়ার স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করার খবর ছিল, ছিল রামপাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা, আর রবিবার তো মীর কাসেম আলীর রিভিউ এর শুনানি আছেই। কিন্তু কোনোটাতেই ঠিক ফারাক্কা কে চাপা পড়ছিল না, তাই কাল থেকেই ফেইসবুকে জল্পনা চলছিল আজ কোন ইস্যু যুক্ত হতে পারে। মজার ব্যাপার, এই জল্পনায় সবচেয়ে বেশি ছিল গুলশান হামলার হোতারা ধরা পড়বে বা 'দুর্ধর্ষ অভিযানে' নিহত হবে। তাই নারায়ণগঞ্জে সোয়াট এর অভিযানে তামিমসহ তিন জঙ্গি নিহত হবার খবর আমার মধ্যে ওই অর্থে সাড়া জাগায়নি – জানা খবর 'ব্রেকিং নিউজ' হয় না।

ফারাক্কার আলোচনার আগে তামিম হত্যা নিয়ে কয়েকটা কথা একটু বলে নেয়া যাক। তিন/চার দিন আগে গুলশান হামলার হোতারা 'যে কোন মুহূর্তে' ধরা পড়বে বলে 'আওয়াজ দিয়ে' রেখেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তারও আগে আইজিপি ও এমন মন্তব্য করেছিলেন। সাধারণ কান্ডজ্ঞান বলে, এমন মন্তব্য করা যায় তখনই যখন কোন ব্যক্তি এর মধ্যেই ধরা পড়ে থাকে। না হলে তো এই যৌক্তিক প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন মন্তব্য করে ধরা পড়ার আগে তামিমসহ অন্য জঙ্গিদের সাবধান করে দিচ্ছেন? এখন কেউ যদি বলে, তামিমসহ ওই জঙ্গিরা আগেই ধরা পড়ে ছিল, অপেক্ষা ছিল জাস্ট প্রয়োজন মতো ওদেরকে হত্যার অভিযানের নাটক সাজানো। এটাতো সবাই জানে গল্প সাজাতে আমাদের বাহিনীগুলোর পারদর্শিতা আছে খুব ভালোই – তাদের থেকে ক্রসফায়ার আর এনকাউন্টারের গল্প আমরা শুনি প্রতিদিনই। আমি বলছি না, ঠিক এটাই ঘটেছে, কিন্তু এটা বলতে চাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশ এর আচরণ এমন বিভ্রান্তি তৈরির স্পষ্ট সুযোগ তৈরি করেছে।

তবে এটা অবশ্যই আশার ব্যাপার, তামিমকে নিয়ে বাস্তব ঘটনা যাই হোক, এটা আমাদের পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতাকে প্রমাণ করেছে – আন্তরিক হলে তাঁরা অনেক সাফল্য অর্জন করতে পারেন।

জানি আজ থেকে কয়েকদিন মূলধারার মিডিয়া, সামাজিক মিডিয়া মেতে থাকবে তামিমকে নিয়ে, বা প্রধানমন্ত্রী রামপাল নিয়ে কী বলেছেন সেটা নিয়ে; চাপা পড়ে গেল ফারাক্কা ইস্যু। অথচ ফারাক্কার সব গেইট খুলে দিয়ে আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলকে ভীষণ বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়ার পর এই বাঁধ নিয়ে দেশে তুমুল আলোচনা হবার কথা ছিল, সেই আলোচনা পরবর্তীতে ভারতের ক্ষমতাসীনদের ওপর এই বাঁধ নিয়ে চাপ তৈরি করতে পারতো। এটাই ছিল মোক্ষম সময়, কারণ কয়েকদিন আগে খোদ ভারতে এই বাঁধ পুরোপুরি ডিকমিশন্ড করার দাবী এসেছে একজন প্রভাবশালী মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের মুখ থেকে, যিনি মনে করেন তাঁর রাজ্যকে বাঁচাতে হলে এই বাঁধ কার্যকর থাকা চলবে না (বিস্তারিত)।

গতকালের পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টিভি'র খবরে চোখ বোলালেই দেখবো, ফারাক্কার গেইট খুলে দেবার পর পানির তোড়ে বন্যা আর ভাঙনে কী অবস্থা হয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। পানির পরিমান বাড়ছে প্রতি মুহূর্তেই। এর পরিণতি খুব সহজেই অনুমেয়। খরার সময় মরুভূমি, আর বর্ষায় বন্যায় তলিয়ে যাওয়া – এই হচ্ছে ফারাক্কার 'উপহার'। কিন্তু হাসি পায় ভেবে, আমাদের একটা গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি আছে, যেটা নিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল দারুণ বাহবা নেবার চেষ্টা করে, যেহেতু আগের এক টার্মে তারাই চুক্তিটি করেছিল। আমার তো এখন মনে হয়, এটা না থাকাই অনেক ভালো ছিল, কারণ এতে অন্তত মনের মধ্যে 'বন্ধু ভারত' কর্তৃক প্রতারিত হবার বোধটি থাকতো না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন নদীর পানি বন্টন নিয়ে ভারতের সাথে কোন দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আর আস্থা রাখি না। ভারতের কাছে সর্বস্ব বিকিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ক্ষমতায় থাকা আর ভারতের কাছে 'নাকে খৎ' দিয়ে ক্ষমতায় আস্তে উতলা দলগুলো দেশের মানুষের সত্যিকার কল্যাণ হয়, এমন কোন চুক্তি করতে ভারতকে চাপ দিতে পারবে বলে আমি কোনভাবেই বিশ্বাস করি না। তাই তিস্তা চুক্তি হোক এটাও চাই না। একবার যেনতেন করে এই চুক্তি হয়ে গেলে এটা নিয়ে আমাদের আর কথা বলার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু আমাদের পানি সমস্যার সমাধান হবে কিনা সেটা কি গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি দেখে আমরা বুঝতে পারছি না?

একটা তথাকথিত চুক্তির নামে আমরা কি আদৌ পানি পাচ্ছি শুষ্ক মৌসুমে? ২০১৬ সালের কিছু পত্রিকার রিপোর্টে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারি আমরা – ১) সাড়ে চার দশকে পদ্মায় সর্বনিম্ন পানি ২) নভেম্বর থেকেই পদ্মায় পানি নেই সঙ্কটে ২১ জেলার ১২০ নদী ৩) চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি আসছে না ৪) বর্ষার শুরুতেও পদ্মায় পানি নেই। এমন রিপোর্ট শুধু এই বছর কেন, প্রতি বছর আসে, তবুও এটা নিয়ে আমাদের দেশের সরকারগুলো কখনো জোরেশোরে কথা বলেনি। অথচ এই পানির অভাবে দেশের অসংখ্য বিপদ তৈরি হচ্ছে – মরুকরণ, সেচের পানির অভাবে ভূগর্ভের পানি দিয়ে সেচ দেয়া, মোহনায় পানির অভাবে দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, পলি আটকে গিয়ে দক্ষিণে ভূমি তৈরি বাধাপ্রাপ্ত হওয়া, মৎস সম্পদ ধ্বংস হওয়া, নৌ পরিবহন ব্যাহত হওয়া, বর্ষায় ছেড়ে দেয়া পানির তোড়ে ভয়ঙ্কর বন্যা, ভাঙন। তালিকাটা আরও অনেক বড়, আমরা জানি, তাই অনেক বেশি উল্লেখ করলাম না। ফারাক্কার প্রভাব নিয়ে বাংলাপিডিয়ার এই সংক্ষিপ্ত লিখাটায় চোখ বোলাতে পারেন আগ্রহী কেউ। এতেই বলা আছে, এই বাঁধের কারণে সৃষ্ট প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ বাৎসরিক কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার, আর সাথে পরোক্ষ ক্ষতি তো আছেই। বলা বাহুল্য তথাকথিত গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির পরও পরিস্থিতি পাল্টায়নি এক বিন্দুও, যদিও আমাদের অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলি প্রতিনিনিয়ত।

বিষয়টা এখন আর গঙ্গা-তিস্তায় সীমাবদ্ধ নেই – আমাদের পানির আরেক প্রধান উৎস ব্রহ্মপুত্রসহ ভারতের আন্তঃনদীসংযোগ নিয়ে ভারত এগোচ্ছে খুব জোরেশোরেই (বিস্তারিত দেখুন)। অথচ আমাদের সরকার একেবারে খামোশ হয়ে আছে, কারণটা বোধগম্য। কিন্তু জনগণের মধ্যেও বড়মাপে কোন প্রতিবাদ বা আলাপ-আলোচনা নেই। আমরা কি বুঝতে পারছি না, কত বড় বিপর্যয়ের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে?

এবারের ফারাক্কার পানি ছেড়ে দেয়ার পরের ফলাফল আমাদেরকে এই আলোচনাগুলো সার্বিকভাবে করার সুযোগ করে দিতো। তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছিলো, গতকালই কয়েকটি টিভি চ্যানেল বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে শুরু করেছিলো, যারা ভারতের সাথে অভীন্ন সব নদীর সবগুলো নিয়ে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু সেটা আর হলো না।

জানি, আমাদের সরকারগুলোর মেরুদণ্ডহীনতায় ভারত তার সাম্রাজ্যবাদী আচরণ চালিয়ে যাবেই; আর সেটা করে এই অঞ্চলকে এক বিস্ফোরণ্মুখ পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবে। ইংল্যান্ডের স্বনামধন্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এই রিপোর্টে দেখুন, ভবিষ্যত পৃথিবীতে পানি নিয়ে যে ভয়ঙ্কর সংঘাতগুলো ঘটবে, তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াও আছে। আমরা কি বসে আছি সেই দিনের অপেক্ষায়?

জঙ্গিবাদ এই দেশের জন্য একটা সমস্যা, ঠিক আছে। কিন্তু এটার পেছনে তাড়া করতে করতে আমাদের এই জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরী অনেক বিষয় আমরা অবহেলা করছি, এটা সুইসাইডাল। এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো (যদিও এদেরকে ঠিক রাজনৈতিক দল বলা যায় না) দেশপ্রেমিক নয়, তারা ক্ষমতায় থাকার আর ক্ষমতায় যাবার জন্য ভারত নামের এই ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্যবাদী দেশটিকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই আসুন দেশবাসী, ফারাক্কাসহ ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমরাই জনমত তৈরি করি, রুখে দাঁড়াই।