গণভবনে ‘তেলের নহর’: অবাক হওয়া কিংবা হবার ভান

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 30 August 2016, 08:42 PM
Updated : 30 August 2016, 08:42 PM

রাজনীতির নানা ঘটনা ব্যাখ্যায় অর্থনীতির চাহিদা-যোগান তত্ত্বের উদাহরণ টেনেছি আমি একাধিক লিখায়; টানবো আজও। সেটা যে প্রসঙ্গে, সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আগে কয়েকটা কথা বলে নেয়া যাক।

রামপাল ইস্যুতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকগণ (২/১ জন ব্যতীত) মুখ থেকে 'তেলের নহর' বইয়ে দিলেন; বিষয়টাকে আদৌ 'গরম' কোন বিষয় বলে মনে হয়নি আমার কাছে, তাই লিখতে ইচ্ছে করেনি বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু অবাক হচ্ছি এটা দেখে যে সাংবাদিকদের এমন কাণ্ড দেখে আমাদের অনেকেই অবাক হচ্ছি বা অবাক হবার ভাণ করছি।

আমাদের মধ্যে যারা সাংবাদিক নন তাদের অনেকেই ফেইসবুকে দারুণ সমালোচনা করছেন সাংবাদিকদের এই আচরণের। ওদিকে অনেক সাংবাদিক পত্রিকায় কলাম লিখে সাংবাদিকদের এমন আচরণের 'কঠোর' সমালোচনা করেছেন! এই দেশের সাংবাদিকতা সম্পর্কে ধারণা না রেখে এই আলোচনাগুলো পড়লে যে কারো মনে হতেই পারে, দারুণ নিরপেক্ষভাবে 'ফোর্থ এস্টেট' এর দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিকরা ওইদিন প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সামনে এতো তেল উগরে দিলেন। বাস্তবতা আসলেই কি তাই?

দুই 'বড়' দলের প্রভাবে সারা দেশের বেশিরভাগ মানুষ মোটাদাগে দুইভাগে বিভক্ত হলেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিলদের মতো পেশার মানুষরা নিজেদের মধ্যে একক কেন্দ্রীয় সংগঠন এখনও ধরে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যে দলাদলির প্রবণতা এতোটাই প্রকট যে তাঁরা পারেননি একক কোন সংগঠন ধরে রাখতে। আমরা কি সাংবাদিকদের মধ্যকার এই প্রকট দলাদলির কারণ তলিয়ে দেখেছি?

এটা সত্য, আর সব সেক্টরের তুলনায় সাংবাদিকদের কলুষিত করে নিজেদের তাঁবেদার বানানোর চেষ্টা এদেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো অনেক বেশি করেছে। কারণ সাংবাদিকদের হাতেই আছে জনমত তৈরি বা সেটা পাল্টে দেবার ক্ষমতা। এজন্যই বিদেশ ভ্রমণ, প্লট, নানা রকম পদে পদায়ন, পত্রিকা/টিভি চ্যানেলের মালিক হতে দেয়া, নামসর্বস্ব পত্রিকায় সরকারী বিজ্ঞাপন দেয়া, ইত্যাদি নানা 'মুলা' ঝোলানো হয় সাংবাদিকদের সামনে। বলা বাহুল্য, সেই 'মুলা'র লোভ সম্বরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না বেশিরভাগ সাংবাদিকের পক্ষেই।

তাই মালিক, সরকার বা অন্য অনেক ক্ষমতাশালীর সামনে নতজানু সাংবাদিকদের আমরা দেখি হরহামেশাই। সেটা যদি হয় প্রধানমন্ত্রীর মতো মানুষ তাহলে তো আর কথাই নেই। আগেও এই প্রবণতা ছিল, আছে এখনও। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাড়ে সাত বছরের মেয়াদে একাধিকবার সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন, প্রতিবারই এবারকার মতো 'সিল-ছাপ্পর মারা' কিছু সাংবাদিকই প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিল এবং তখনও ঠিক একইভাবে 'তেলের নহর' বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা আমাদের অনেকেরই চোখে পড়েনি, কারণ আগের সংবাদ সম্মেলনগুলো বেশিরভাগই ছিল প্রায় গুরুত্বহীন – কোন দেশ সফরের 'সফলতা' বয়ান করা।

এবারকার সংবাদ সম্মেলনটি যেহেতু 'গরম' রামপাল ইস্যু নিয়ে, তাই দেশের অনেক মানুষের আগ্রহী চোখ ছিল টিভি'র পর্দায়। তাই প্রশ্নের নামে সাংবাদিকদের তেল বন্যায় গণভবন ভাসিয়ে দেয়াটা চোখে পড়ছে বেশি, প্রতিক্রিয়াও হয়েছে অনেক বেশী। তবে আমি ধাক্কা খাইনি একদমই, প্রধানমন্ত্রী'র সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের নামে যা হয় এটা আমি আগেও দেখেছি। কারো সংশয় থাকলে ইউটিউবে যদি তাঁর পুরনো কোন সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও পান, তবে সেটা দেখে নিতে পারেন।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো – এই পরিস্থিতির দায় কার? শুরুতে উল্লেখ করা চাহিদা-যোগান তত্ত্বে ফিরে আসি। অর্থনীতির খুব ব্যাসিক কথাটা হলো কোন জিনিষের চাহিদা থাকলে সেটার যোগানও থাকবে; কথাটাকে উল্টে বলা যায় কোন জিনিষের যোগান থাকা মানে সেটার চাহিদাও আছে। তাহলে গণভবনে যখন সাংবাদিকরা ব্যারেল ব্যারেল তেল উগরে দেন, তখন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ওখানে তেলের চাহিদাও আছে। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে এই দেশে ক্ষমতাসীনদের কৃপা পাবার জন্য দক্ষতার দরকার নেই; ক্ষমতাসীনদের কৃপা পায় স্রেফ তেলবাজরা।

একটু পাল্টে ভাবি, যদি এমন হতো, সরকার প্রধান সেইসব সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করেন, পুরস্কৃত করেন যাঁরা তাঁর এবং তাঁর সরকারের কোন ভুলকে ছেড়ে দেন না, গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাহলে কি এমন একটা সংবাদ সম্মেলনে গণভবন এভাবে তেলের বন্যায় ভাসতো? ভাসতো না; তখনকার চাহিদা হতো মেরুদন্ডযুক্ত 'হক কথা'র সাংবাদিকতা।

গণভবনের সেদিনকার ঘটনায় সাংবাদিকদের দায় নেই, সেটা বলছি না। সরকারের পক্ষ থেকে চিরকালই তাঁবেদার বানানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু অতীতে সাংবাদিকতার এমন নোংরা রূপ আমরা দেখিনি; বরং শুধু প্রলোভন না, ভয়ঙ্কর ভীতিকে উপেক্ষা করে আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচিত হয়েছিলো। কিন্তু আজ দেশের মানুষদের সামগ্রিক নৈতিকতার মানের অধঃপতন স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকদেরও স্পর্শ করেছে।

আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, সমাজের নৈতিকতার মানের এই অধঃপতন ঘটার জন্য মূল দায় ক্ষমতার শীর্ষপর্যায়ের। ওই পর্যায়ে যদি মানুষের সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দক্ষতার মূল্যায়ন থাকে তবে মানুষ সেরকমভাবেই নিজেকে গড়ে তুলবার চেষ্টা করবে। আর চাহিদা যদি হয় তেলের, তাহলে গণভবন তো বটেই সারাদেশ ভাসবে তেলে, যেমন ভাসছে এখন।