ঈদ-উল-আযহা: প্রাণ যখন পরিণত হয় খেলনায়

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 10 Sept 2016, 07:58 AM
Updated : 10 Sept 2016, 07:58 AM

আমেরিকার আদিবাসী চেরকী ইন্ডিয়ানরা আদিতে শিকারজীবী ছিল। শিকারে যাবার আগে এদের নানা রকম কৌতুহলোদ্দীপক রিচুয়াল ছিলো, এই পোস্টের সাথে সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয় বলে সেসব নিয়ে কিছু কথা বলার লোভ সম্বরণ করলাম। কিন্তু শিকারের পর তারা যা করতো সেটা এই পোস্টের বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় সেটা নিয়ে কিছু কথা লিখছি।

বেঁচে থাকার অনিবার্য খাদ্য হিসাবে একটা প্রাণী হত্যার পর তারা ছোট একটা রিচুয়াল পালন করতো – তাতে তারা ক্ষমা চাইতো প্রাণীটার কাছে, এবং ঈশ্বরের কাছে। চেরকী'দের কথা উল্লেখ করলাম কারণ এরা অনেক ঘটা করে কাজটা করতো, যদিও খাদ্যের জন্য হত্যা করা প্রাণীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার রীতি খুব দুষ্প্রাপ্য না এই পৃথিবীতে – কালাহারি মরুভূমির অনেক "অসভ্য" আদিবাসীদের মধ্যে এই চল আছে।

"কোরবানীর ঈদ" আসছে এটা খুব ভালোভাবেই বোঝা যায় টিভি-পত্রিকা খুললে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলালে। এখন চ্যানেলে চ্যানেলে ঈদ উল আযহার ৫/৬/৭ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চলছে। বেশ কয়েক বছর থেকেই দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন শুরু হয় এনিমেশন দিয়ে, যেখানে আমাদের দেশের কোরবানির মূল প্রাণী গরুকে নিয়ে নানা রকম মজার অঙ্গভঙ্গি দেখানো হয়।

দেশের শীর্ষ দৈনিক, যেগুলোর ফান সাপ্লিমেন্ট আছে সেগুলো গরুর ছবি দিয়ে নানা রকম কোলাজ বানিয়ে মজা ফেরি করছে আমাদের কাছে। দেশের সর্বাধিক পরিচিত ফান ম্যাগাজিনটি এই ব্যাপারে সবচাইতে এগিয়ে – ছোটবেলা থেকেই দেখেছি তাদের ঈদ-উল-আযহা সংখ্যা ভরা থাকে কোরবানীর প্রাণী নিয়ে নানা রকম ফানে।

কেন তারা এসব করে, তার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় আশপাশে একটু কান পাতলেই। কুরবানীর প্রাণীটিকে নিয়ে নিজেদের মধ্যেই নানা রকম ফান করি আমরা। আর এখন ফেইসবুক তো আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে অনেক কিছু – কেউ দিচ্ছেন গরুর সাথে ছবি, কেউবা গরুর ছবি দিয়ে নানা রকম ফানি কোলাজ বানাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ গরুর নানা রকম ছবি দিয়ে রসাত্মক মন্তব্য করছেন।

এসব সময় আমরা ঘুনাক্ষরেও ভাবি না, যাদের নিয়ে আমরা এমন করছি তাদেরও জীবন আছে – আমাদের আনন্দের উপলক্ষ্য তৈরির জন্য ওদের জীবন দিতে হয়। যে প্রাণীটার জীবন শেষ করে দিচ্ছি, সেই প্রাণীটাকে নিয়ে মজা করি; সেই প্রাণীটার প্রতি ন্যূনতম সম্মানও আমরা দেখাই না!

ওদের প্রাণ আছে, এটা ভুলে যাই বলে বা ওদের প্রাণ "ইতর" বলে মোটাতাজাকরণের নামে ওদের শরীরে বিশাল পরিমাণ স্টেরয়েড ঢোকাই আমরা। ইদানিং এর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়েছে এভাবে – এরকম প্রাণীর মাংস খেলে মানুষের শরীরেই নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি হয়, তাই…..। কেউ ঘুণাক্ষরেও বলি না স্টেরয়েডের কারণে ওই প্রাণীগুলো অসীম শারীরিক কষ্টে ভোগে মাসের পর মাস – একবার হুট করে মরে যাবার চাইতে যার কষ্ট বহুগুন বেশী। কেউ বলবো কী আসে যায় একটা "ইতর প্রাণীর" কষ্টের কথা ভেবে? অথচ ধর্মও কিন্তু ওদের অহেতুক কষ্ট দেবার বিপক্ষে – ধর্ম মতেই কুরবানীর প্রাণীটিকে প্রচন্ড ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করতে হবে, যেন তার কষ্ট কম হয়।

কই আমাদের হাতে গোনা দুই-একজন বাদে ধর্মীয় গুরুদেকেও তো দেখি না, শরীরে স্টেরয়েড ঢুকিয়ে এই প্রাণীগুলোকে মাসের পর মাস এমন মর্মান্তিক কষ্ট দেয়া বন্ধ করার নসিহত করতে! কারণটা অবশ্য অনুমেয় – তাদের চামড়া পেলেই তো হয়; স্টেরয়েড দেয়া গরুর চামড়াও সমান মূল্যবান।

এই ব্লগের শুরুর দুই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য এটা দেখানো, এই পৃথিবীতেই কত 'অসভ্য জাতি' প্রাণকে সম্মান করে; প্রয়োজনে প্রাণ সংহার করলেও সেই প্রাণের প্রতিও সম্মান জানায়। আর আমরা……। এটাই সভ্যতা! আমরা "সভ্য"রা আবার ওদের অসভ্য বলি! তাও আবার এসব স্রেফ খাবারের জন্য হত্যা করার প্রাণী না। রীতিমত "উৎসর্গ" করার প্রাণী; "পুণ্য অর্জন" করার প্রাণী। সেই প্রাণীগুলো পদে পদে আমাদের বর্বরতার সাক্ষী হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। হ্যাঁ, এই ঈদে আমরা প্রাণকে পরিণত করি স্রেফ খেলনায়।

আমাদের এই মানসিকতার কারণ অনুসন্ধানে নামলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোয় – মুখে কুরবানী, ত্যাগের মহিমা উপলব্ধি ইত্যাদি নানা কথা বললেও আমার শৈশব থেকেই দেখি এটা স্রেফ একটা মাংস খবর উৎসব; এর বেশী কিছু নয়। কারো ধর্মীয় চেতনায় আঘাত দিয়ে থাকলে দুঃখিত, কিন্তু অতি সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এটাই বাস্তবতা।

এই বিষয়টাকে মাথায় রেখে অনেক কাল আগে একটা ব্লগ লিখেছিলাম। ঈদ-উল-আজহা'র আগে আজ স্মরণ করছি সেটাও – ১৭ লাখ টাকার গরু আর ওএমএস এর চালের লাইন