ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: তাজউদ্দীন কন্যা শারমিনের বিচার হবে কি?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 16 Sept 2016, 06:09 PM
Updated : 16 Sept 2016, 06:09 PM

কিছুদিন আগে অরুন্ধতী রায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে 'বর্ণবাদী' এবং 'বৈষম্যকারী' বলেছেন (বিস্তারিত পড়ুন) আর অন্য দুই লেখকের বইতেও গান্ধীকে যখন 'জাতবাদী' এবং 'ব্রিটিশের পতাকাবাহী' বলা হয়েছে সেটাকে সমর্থন করে ওই বইতে ভূমিকা লিখেছেন তিনি (বিস্তারিত পড়ুন)। এবার আরেকটু এক্সট্রিম উদাহরণ, আমরা অনেকেই কি জানি, ভারতের হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস এর মত সংগঠনগুলো গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে কে একজন 'জাতীয় বীর' বলে মনে করে এবং তার ফাঁসির দিনকে 'বলিদান দিবস' হিসেবে পালন করে। তারা 'তাদের প্রধানমন্ত্রী' নরেন্দ্র মোদির কাছে দাবি করে 'ভারতের জন্য গডসের অবদান' নিয়ে পাঠ্যবইতে বিশেষ রচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। (বিস্তারিত)

পোস্টটা শুরু করলাম উদাহরণ দিয়ে – পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশগুলো থেকে কোন উদাহরণ দিলে আমরা নানারকম কথা বলে সেগুলো গ্রহণ করতে চাই না, তাই উদাহরণ হোক পাশের বাড়ি ভারত থেকেই। বলা বাহুল্য, অরুন্ধতী রায় বা হিন্দু মহাসভার এমন মন্তব্যের পর তাদের পক্ষে বিপক্ষে নানা রকম আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে এখনও। কিন্তু ওই দেশে কেউ তাদের 'জেলের ভাত' খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারেনি, কারণ ওই দেশে আইন করে ইতিহাস চর্চার পথ রুদ্ধ করা হয়নি।

কিন্তু আমাদের দেশে এই ভুত ভর করেছে বেশ ভালোভাবেই। কিছুদিন আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই সংক্রান্ত ধারা বর্ণনা করতে গিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম আমাদের জানান "কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত থেকে মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে যে কোনো প্রচার, প্রগাগান্ডা চালালে বা তাতে মদদ দিলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ডে, সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।" (বিস্তারিত পড়ুন)।

আরো কিছুদিন আগে পশ্চিমের অল্প কিছু দেশে প্রচলিত 'ল এগেইস্ট হলোকস্ট ডিনায়াল' কে দেখিয়ে এই জাতীয় আইন করার দাবি যখন উঠছিল সরকারের হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া 'সুশীল'দের পক্ষ থেকে তখন আইন দিয়ে ইতিহাস নির্ধারণের এই চর্চার বিরুদ্ধে একটা পোস্ট লিখেছিলাম – রশোমন এফেক্ট, ডিনায়াল ল আর 'আ পিপল'স হিস্ট্রি অফ লিবারেশন ওয়ার'। সমাজের নানা স্তর থেকেও একই রকম বিরোধিতা হয়েছিলো, কিন্তু সরকার কোন রকম গা করেনি সেসবে। হোক রামপাল কিংবা এই আইন, সরকার তার গায়ের জোরে যাচ্ছেতাই করার প্রবণতা বহাল রাখছে এখনও। অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই অনুমান করা যায়, এই আইনে বহু মানুষ, যাদের খুঁটির জোর নেই তারা হয়রানির শিকার হবে বা সেল্ফ সেন্সরশিপে বাধ্য হবে। কিন্তু মানুষটি যদি হন এই দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের সদস্য, তাহলে?

কিছুদিন আগে প্রকাশিত বই "তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা" তে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বয়ানের বিরুদ্ধে যায় অনেক কথা লিখেছেন তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ। এর মধ্যে ২৫ মার্চ নিয়ে লিখা কিছু কথা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করছি –

মুজিব কাকু আব্বুর সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী আত্মগোপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। আব্বুর বিশ্বাস ছিল যে, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। মুজিব কাকু, আব্বুর সাথেই যাবেন। অথচ শেষ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় রয়ে গেলেন। তিনি আব্বুকে বললেন, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশু দিন (২৭শে মার্চ) হরতাল ডেকেছি।

 

পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান।

 

এদিকে বেগম মুজিব ওই শোবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। ঢোলা পায়জামায় ফিতা ভরলেন। পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার এই সব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

 

স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর অস্বীকৃতি জানানোর পর তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, 'মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে। এই ঘোষণা কোন না কোন জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাবো। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে। মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন 'এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।

আমি এটা কোনভাবেই বলছি না, শারমিন আহমদ যা বলেছেন সেটাকেই সঠিক বলে মনে নিতে হবে, তেমনি আমি এটাও কোনভাবেই মনে করি না আওয়ামী লীগের বয়ানও বেদবাক্য। কিন্তু একটা মোটামুটি (মোটামুটি শব্দটা এজন্য ব্যবহার করেছি যে, পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক কোন ইতিহাস হতেই পারে না) সুষ্ঠু, নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস রচনার স্বার্থে ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর সবদিক থেকে আলো পড়া উচিত। কিন্তু সরকার গায়ের জোরে এই চর্চার পথ বন্ধ করতে চেষ্টা করছে। আর ভারতে যা হচ্ছে সেরকম কিছু হলে তো…..

এই সরকারের অতীত কর্মকাণ্ড দেখে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, অসংখ্য মানুষের মতামত উপেক্ষা করে সরকার এই আইন করবেই। তাই আমার ভীষণ কৌতূহল একটু আগে উল্লেখ করা লিখার জন্য 'শক্ত খুঁটি' থাকা শারমিন এর কি বিচার হবে? উত্তরটা আমরা পেয়ে যাবো 'শক্ত খুঁটি' শব্দযুগল মাথায় রাখলেই।