নারী, আয়নায় নিজেদের মুখ দেখছেন তো!

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 9 Jan 2017, 05:37 PM
Updated : 9 Jan 2017, 05:37 PM

"হাসতে হাসতে পেটে খিল!" এটা ইউটিউবের সেই ভিডিওটার শিরোনামের প্রথম বাক্য, যেই ভিডিও সাজু খাদেম এর নোংরা, মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ওই শিরোনামে ভিডিওটা যে আপলোড করেছে, সেও খুব অবাস্তব কোন শিরোনাম লিখেনি, কারণ এই ভিডিও দেখে তার যেমন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরেছে, তেমনি খিল ধরবে এই সমাজের অনেক পুরুষেরই। কিছু নারীকে যৌন হয়রানির দৃশ্যে অনেককে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরা, এটা আমাদের সমাজের এক নির্মম বাস্তবতা।
বোধগম্য কারণেই এই সমাজেরই সচেতন মানুষদের একাংশ সাজু খাদেম এর এমন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করছেন। যে কয়েকটি লেখা আমি পড়েছি, তার প্রায় সবগুলোতেই খেয়াল করলাম সাজু খাদেমের মুণ্ডুপাত করতে করতে আমরা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এড়িয়ে যাচ্ছি (উইমেন চ্যাপ্টার এর একটা লিখায় অবশ্য এই সংক্রান্ত একটিমাত্র বাক্য চোখে পড়েছে)। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখি।

চারটি মেয়ে বসে বসে সাজু খাদেম কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হলেন, কিন্তু একজনও প্রতিবাদ করলেন না! ভিডিওটি দেখে মনে হতে পারে, মুহূর্তের মধ্যে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তারা কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।

'মনে হতে পারে' কথাটি বলার একটা উদ্দেশ্য হলো, আমি আসলেই সন্দিহান আছি হতবিহ্বল না হলেও তারা প্রতিবাদটি করতেন কিনা। আমি যে ভিডিওটি দেখেছি, সেটার রেজল্যুশন বেশ খারাপ ছিল, তাই আমি ঠিক চিনতে পারিনি সাজু খাদেমের সাথে থাকা মেয়েরা কারা ছিলেন? আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে এটা জানতে, হতবিহ্বল অবস্থা কেটে যাবার পর কেউ কি অন্তত ফেইবুকে সাজু খাদেমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন? এমনকি যখন ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির মতো অকাট্য প্রমাণ হাতে এসেছে, তারপরও কি তারা কেউ কিছু বলেছেন? অপরাধটার শিকার হয়েছিলেন কিন্তু তারাই। মিডিয়ার অন্য কোনো মেয়ে কি করেছে কোনো প্রকাশ্য প্রতিবাদ?

পুরুষ নারীকে প্রাপ্য সম্মান, সম-অধিকার নিজ থেকেই দিয়ে দিলে সেটাই হতো সবচাইতে ভালো ব্যাপার। বিষয়টা সুন্দর, কিন্তু এটা ইতিহাসবোধহীন ভয়ঙ্কর ইউটোপিয়ান চিন্তা। আমি ইতিহাসবোধহীন মানুষ নই, তাই আমি জানি একটা অন্যায় ক্ষমতা, প্রাপ্তি ভোগ করা মানুষ, শ্রেণী, কিংবা জাতি কোনোদিন সেই ক্ষমতা নিজ থেকে ছেড়ে দেয়নি। এর জন্য ক্ষমতা ভোগকারীকে 'নসিহত' করে, কিংবা গালিগালাজ করে কোনো লাভ হয়নি। বরং যেসব বঞ্চিত মানুষ, শ্রেণী কিংবা জাতি যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, তারাই ধাপে ধাপে তাদের অধিকার অর্জন করতে পেরেছে। অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় এই বিষয়ে, সময় করে কোনোদিন বিস্তারিত লিখবো এটা নিয়ে।

নারীরা কর্মস্থলে নানা রকম যৌন হয়রানির শিকার হন, জানি। এটাও জানি, বেশিরভাগ নারী এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হন না। সম্ভবত: দীর্ঘদিনের নিষ্পেষণের মধ্যে থেকে এসবকে এক রকম মেনেই নিয়েছে অধিকাংশ নারী। অনেকে আবার সেই প্রতিবাদটুকু করার সাহস করেন না। আবার আমাদের দেশে নিপীড়িতের ওপর মানুষের পাল্টা বিদ্রুপ হয়তো অনেককে এটা করতে নিবৃত্ত করে। আর কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা এটা মেনে নেয় কর্মক্ষেত্রে ঝামেলা হবার কিংবা প্রাপ্তিতে সমস্যা হবার ভয়ে। একদিকে সাজু খাদেম মিডিয়ায় যথেষ্ট পরিচিত মুখ, অন্যদিকে আরেকটি বেশ প্রভাবশালী পরিবারের মেয়েজামাই তিনি। পাছে মিডিয়ায় ক্যারিয়ারের সমস্যা হয়, এজন্য কি যৌন হয়রানির শিকার কেউ প্রতিবাদ করছেন না?

মনে পড়ে যায় অভিনেত্রী প্রভা যখন তার সাবেক বয়ফ্রেন্ডের এক ভয়ংকরতম বর্বরতার শিকার হন, তখনও মিডিয়ার পুরুষরা তো বটেই, মেয়েরাও দাঁড়াননি তার পাশে। একজন 'নষ্ট' মেয়ের পক্ষে দাঁড়ালে ক্যারিয়ারের ক্ষতি হতে পারে, তাই?

এই দেশে নারী আজ পর্যন্ত যতটা অর্জন করতে পেরেছে, তার পেছনে অনেক নারীর ত্যাগ স্বীকার আছে। যেদিন তারা স্কুলে যেতে শুরু করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চেয়েছে, পেশাজীবী হতে চেয়েছে, এমনকি শ্রমিক হতে চেয়েছে, সেদিনও সমাজের পুরুষতন্ত্র তাদেরকে নানাভাবে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে, নানা রকম নোংরা অপবাদ দিয়েছে। মেয়েরা পড়তে যাবার পর বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়কে যেমন 'বেশ্যা বিদ্যালয়' বলা হয়েছে, তেমনি গার্মেন্টে কাজ করতে যাওয়া নারীরা 'জেনার মইধ্যে আছে' – এই কথা এই একবিংশ শতাব্দীতেও শুনি আমরা। কিন্তু এসবকে তুচ্ছ করে নারীরা এগিয়ে গেছে। বলাবাহুল্য প্রথম যারা পথটা তৈরি করেছে, তারা নানা রকম চাপে পড়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পথ যারা তৈরি করেন, নিজেই সেই পথে হাঁটতে পারেননি, কিন্তু তবুও সেই পথ তৈরির জন্য শ্রম দিয়েছেন, অন্যের পথচলা সুন্দর হবে বলে।

আমরা প্রায় সবাই চাই এই সমাজ আমাদের জন্য অসাধারণ হয়ে উঠুক, কিন্তু সেটা বাসযোগ্য করে তুলতে যে চেষ্টা করা দরকার, আমরা চাই সেটা আমি করবো না, সেটা অন্য কেউ করে দেবে। সমস্যা হলো এভাবে প্রগতি পিছিয়ে যায়। আর নানা কারণে যখন কিছু মানুষ সিস্টেমের সাথে আপোষ করেন তখন সেটা সিস্টেমকে আরও গেঁড়ে বসতেই উৎসাহ যোগায়। শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আমার বিবেচনায় এই সমাজের অনেক নারীর অবস্থান, আচরণ নারীর প্রাপ্য অধিকার অর্জনকে পিছিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।

আমি বিশ্বাস করি, মানুষ হিসাবে ন্যায্য অধিকার পাবার জন্য নারীদেরকে সবদিক থেকে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। খেয়াল করলে দেখবো গত পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাদেশের তুলনায় নারী আজ অনেক বেশী মর্যাদার অধিকারী। এর কারণ পুরুষের মহানুভবতা নয় অবশ্যই, কারণ নারী পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় অনেক দিক থেকেই অনেক বেশী যোগ্য। ঠিক এভাবেই নারীকে যোগ্যতা অর্জনের (নিজের ওপর ঘটা যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে পারাও একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা) মধ্য দিয়েই তার অধিকার আদায় করে নিতে হবে।

স্বাধীনতার পর 'তলাবিহীন ঝুড়ি' তকমা পাওয়া বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার জন্য অনেক দেশ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর মতো সংস্থা ঋণের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরছে। কারণ আর কিছু নয় – ত্রিশ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমরা এখন ঋণ ফেরৎ দেবার জন্য দারুণ যোগ্য। হ্যাঁ, যোগ্যতাই সম্মান/অধিকার অর্জনের মূল চাবিকাঠি।

নারীদের এটাও ভেবে দেখতে হবে কোনো সাময়িক ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য করা কোনো কাজ অন্য নারীর অধিকারের পথ সংকুচিত করে কিনা। আবার নারীদেরকে এজন্যও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, এমন পথ তৈরির চেষ্টা তাদেরকে করতে হবে, যার জন্য মূল্য দিতে হবে তাদেরকে, কিন্তু সেই পথে তারা নিজেরা হাঁটতে পারবেন না, সেই পথে নির্বিঘ্নে হাঁটবে অন্য প্রজন্মের কোন নারী।

আগেই লিখেছিলাম বঞ্চিত মানুষের অধিকার অর্জনের কাজ বঞ্চিত মানুষকেই হাতে তুলে নিতে হবে। তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি নারীদের অধিকার অর্জন করার পন্থা নিয়ে যাবতীয় আলোচনার লক্ষ্য হওয়া উচিত নারীরা। কিন্তু এটার পদ্ধতি কী হবে, সেটা নিয়ে উইমেন চ্যাপ্টারের অনেক লেখকের সাথে আমার দ্বিমত আছে। সেটা নিয়ে লিখবো আরেকদিন।

পূর্ব প্রকাশিত: উইমেন চ্যাপ্টার