‘নগর নাব্য- মেয়র সমীপেষু’ এবং বাংলাদেশের নিউ মিডিয়ার বিকাশ

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 22 March 2017, 05:27 PM
Updated : 22 March 2017, 05:27 PM

সিনেমা নিয়ে ফরাসি দার্শনিক Jean Cocteau এর একটা উক্তি খুব বিখ্যাত "Film will only become an art when its materials are as inexpensive as pencil and paper." কথাটা আমার খুব পছন্দের- সিনেমা তৈরির সাথে যখন একটা বড় ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত হয়ে যায়, তখন সেই শিল্প সবার হাতে পৌঁছে যেতে পারে না। তাই প্রশ্ন আসতেই পারে গুটিকতক মানুষ, যারা একটা বিরাট ইন্ডাস্ট্রির অংশ হতে পারে, শুধু তাদের হাতে থাকলেই একটা শিল্প মাধ্যম আদৌ কি শিল্প মাধ্যম হতে পারে? কথাটাকে কি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও দারুণভাবে যুক্ত করা যায় না?

নিজেকে বাংলাদেশের 'নাগরিক সাংবাদিকতা'র পথিকৃত দাবি করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ। দীর্ঘ ছয় বছরের যাত্রার পর এটা বলাই যায়, এই ব্লগ তার দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছে; যে কেউ ব্লগের কিছু লিখায় চোখ বুলালে এটা স্পষ্ট হবে। তবে ষষ্ঠ বছরে এসে এই ব্লগ এমন এক অর্জন করলো, যেটা এই দেশের ব্লগ ইতিহাসের এক অসাধারণ মাইলফলক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। হ্যাঁ, আমি এই বছরের 'নগর নাব্য- মেয়র সমীপেষু' এর কথা বলছি।

এটা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগের চতুর্থ ব্লগ সংকলন। প্রথম দু'টি ব্লগ সংকলনে বিভিন্ন বিষয়ের মিশ্রণ থাকলেও গত বছর থেকে নগর নাব্য বিষয়ভিত্তিক ব্লগ সংকলন তৈরি করছে। ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগ নিয়ে গত বছরের সংকলনটির পর এবছরের বিষয় ছিল নগরের সমস্যা নিয়ে নাগরিক সাংবাদিকদের ব্লগ। নগর নাব্যের শিরোনামে থাকা 'মেয়র সমীপেষু' নির্দেশ করে এই নগর নাব্য নগরের সমস্যা নিয়ে 'নগর প্রধান' তথা মেয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। সেই প্রচেষ্টা যে সফল হয়েছে নগর নাব্যের মোড়ক উন্মোচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের উপস্থিতি এবং নাগরিক সাংবাদিকদের সাথে তাঁর সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও এর মধ্যেই সংকলনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পৌঁছে গেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী'র কাছেও।

প্রথাগত মিডিয়ার জায়গা 'নিউ মিডিয়া' নিয়ে নিচ্ছে কিনা, সেটা নিয়ে গত কয়েক বছর থেকে তুমুল আলোচনা-বিতর্ক চলছে। নিউ মিডিয়ায় তথ্যের যথার্থতা, নির্ভরযোগ্যতা, গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি প্রশ্ন আছে প্রতিনিয়ত সামনে আসা অবিশ্বাস্য পরিমাণ তথ্যের প্রবাহে 'ভেসে যাওয়া' নিয়েও। কিন্তু সবকিছুর পরেও নিউ মিডিয়া আজ এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে, এর প্রভাব দিনে দিনে অবিশ্বাস্যভাবে বাড়ছে। এর চমৎকার সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে সাম্প্রতিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মূল ধারার প্রায় সব মিডিয়া (এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকান সমর্থক মিডিয়াগুলো পর্যন্ত) বিপক্ষে চলে যাবার পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প দিব্যি তার প্রচারণা চালিয়ে যেতে পেরেছেন নিউ মিডিয়াকে ব্যবহার করে।

ইন্টারনেট যখন এই গোটা পৃথিবীকে একসাথে বেঁধে ফেলেছে, তখন বাংলাদেশও একই প্রবণতা তৈরি হবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের অর্থনৈতিক দুর্বলতা, আর নিরক্ষরতার কারণে অনেক বেশি মানুষের হাতে এখনও স্মার্টফোন নেই, সাথে ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য বাধা তৈরি করছে বটে, কিন্তু এই পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে খুব দ্রুতই। তাই এরই মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠা নিউ মিডিয়া সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবেই।

জন্মের পর থেকেই সিটিজেন জার্নালিজমকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগে স্বাভাবিকভাবেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্লগার এই ধরণের ব্লগ লিখেছেন, তাই এই ধরণের ব্লগের সংখ্যাও অনেক। সেখান থেকে ২৫টি ব্লগ বেছে নেয়া হয়েছে 'নগর নাব্য: মেয়র সমীপেষু'তে। পোস্টগুলোতে মূলতঃ দেশের বিভিন্ন এলাকার নানা সমস্যার কথা, এবং সেগুলো সমাধানের দিকনির্দেশনা দুর্দান্তভাবে উঠে এসেছে। এখানে একটা ব্যতিক্রম – "কুমিল্লার 'মাতৃভান্ডার' রসমালাই, একটি বিশ্বরেকর্ড এবং জি আই নিবন্ধন" পোস্টটি, যেটি সমস্যা নয়, একটি দারুন সম্ভাবনার পথ নির্দেশ করে। এখানে স্মর্তব্য, উল্লিখিত পোস্টটি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ব্যাপারে রীতিমত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করে।

যে কোন বিবেচনায়ই এই সংকলনের প্রতিটি ব্লগ সুনির্বাচিত, গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকজন ব্লগারের একাধিক ব্লগ স্থান পেয়েছে সংকলনে। সর্বোচ্চ মানের ব্লগ খুঁজে নিতে গেলে এটা হবারই কথা। তবে আমার একটা ব্যক্তিগত অভিমত হলো, লেখকপ্রতি একটি করে লিখা নেয়াটা ভালো হতো। মানি, এতে মানের ক্ষেত্রে কিছুটা কম্প্রোমাইজ করা হতো, কিন্তু এতে আরও বেশ কয়েকজন ব্লগার তাঁদের লিখা ছাপার অক্ষরে দেখতে পেতেন। এটা অবশ্যই তাদের জন্য চমৎকার একটা অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করতো।

এই ব্লগ সংকলনটি নিউ মিডিয়ায় যারা কাজ করতে চান তাদের জন্য দারুন পথনির্দেশক হিসাবে কাজ করবে। আমাদের নগর পিতা/মাতাগণও নগরের সমস্যা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা পাবেন 'কর্পোরেট প্রভাবহীন' লেখকগণের কাছ থেকে, যেটা তাঁদের জনগণকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে দারুন কাজে লাগবে।

শুরু করেছিলাম Cocteau এর স্বপ্ন নিয়ে, আজ বলাই যায় তাঁর স্বপ্ন অনেকটাই বাস্তবের মুখ দেখার পথে – হাতের মোবাইল সেটটি আজ যখন খুব ভালো মানের ভিডিও করতে পারে, খুব সহজে যে কেউ একটা পিসি'তে (এমনকি স্মার্টফোনেও) এডিট করতে পারে, তখন এটা কাগজ-পেন্সিলের মতো সস্তা না হলেও সিনেমা তৈরির প্রক্রিয়াটা অনেকটাই মানুষের হাতের নাগালে চলে এসেছে।

শুরুতে এটাও বলেছিলাম, বিষয়টাকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও যুক্ত করা যায়। একটা সময় সাংবাদিকতা মানে ছিল একটা বিশাল বিনিয়োগের পত্রিকায় কাজ জোটানোর চেষ্টা করা, তারপর সেই পত্রিকা মালিকের, প্রভাবশালীদের আর বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থ সুরক্ষা করে কাজ করা। পুরো ব্যাপারটির সাথে বিরাট বিনিয়োগ জড়িত ছিল, আর ছিল প্রভাবশালীদের প্রভাবে অনেক দুর্দান্ত রিপোর্টের আলোর মুখ না দেখা।

আজ পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেছে – হাতের মোবাইলটিকে একটা দুর্দান্ত অস্ত্রে পরিণত করা যায় মুহূর্তেই, ছবি তুলে নিজেই রিপোর্ট করা যায় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। দুর্দান্ত সাংবাদিক হবার পথ এখন সবার সামনেই খোলা। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই নিউ মিডিয়ায় আসা সংবাদকে অনুসরণ করেছে মূলধারার সংবাদ মাধ্যম।

এটা নিশ্চিত, সামনের দিনগুলোতে এই মিডিয়া আরও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশে নিউ মিডিয়ার বিকাশের পথে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ব্লগ অসাধারণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, আর নিশ্চয়ই এই ব্লগের সংকলন 'নগর নাব্য-মেয়র সমীপেষু' নিউ মিডিয়ার এই অগ্রযাত্রার পথে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।