সময় কি হয়েছে ‘রেস্ট ইন পিস জুডিসিয়ারি অব বাংলাদেশ’ বলার?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 15 Oct 2017, 03:47 AM
Updated : 15 Oct 2017, 03:47 AM

প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় নিয়ে যা যা ঘটেছে তার এখন পর্যন্ত সর্বশেষ কিস্তির (কিস্তি আরও বাকি আছে নিশ্চয়ই) ঘটনাগুলো আমরা দেখলাম কাল রাতে আর আজ বিকালে। উচ্চ আদালতের শরৎকালীন ছুটির পর যে প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতি 'ছুটি নিয়েছেন', সেটাকে ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই নাকচ করে দেয়া যাচ্ছিলো। কাল রাতে অস্ট্রেলিয়া যাবার প্রাক্কালে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং এই মিথ্যাচারকে নাকচ করে এই দেশের প্রশাসনযন্ত্রের ভিত নিশ্চয়ই প্রচন্ডভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মৌখিক আর লিখিত বক্তব্য আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় ছুটি নিয়ে কী বীভৎস মিথ্যাচার করা হয়েছে।

এরকম ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকই হবার কথা, হয়েছেও। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হয়েছে তাঁর স্ত্রীকে (বিস্তারিত পড়ুন)। অথচ আমরা নিয়মিতই জানছিলাম তিনি তাঁর স্ত্রী সহ ভিসার আবেদন করেছেন, ভিসা পেয়েছেন এবং একসাথে বিদেশ যাবেন। তাঁর স্ত্রীকে এভাবে আটকে রাখার বার্তাটা খুব সহজেই বোধগম্য।

নাটকীয়তা কালই শেষ হয়নি, আজ অপেক্ষা করছিলো এর চাইতে বড় নাটকীয়তা। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেওয়া বিবৃতিকে বিভ্রান্তিমূলক বলা হয়। ওই বিবৃতি থেকে এটাও আমরা জানতে পারি, তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ও গুরুতর অভিযোগ এর কথা জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে একই বেঞ্চ বসতে চাননি আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতি (পুরো বিবৃতিটি পড়ুন এখানে)। একই ধরনের বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিক স্বদেশ রায় এর একটা কলাম প্রকাশিত হয়েছিল তিন দিন আগে (আগ্রহীদের জন্য লিংক)।

আমি একাডেমিক্যাললি আইন পড়িনি, 'সংবিধান বিশেষজ্ঞ' হওয়া তো দূরেরই কথা। কিন্তু ব্যক্তিগত আগ্রহে সংবিধান আর আইন পড়তে গিয়ে দেখি, সেটা অন্তত রকেট সায়েন্স নয়, বোঝা যায়। আর সুপ্রিম কোর্টের ওই বিবৃতিতে যা লিখা হয়েছে, সেটার মধ্যকার অবিশ্বাস্য স্ববিরোধিতা, ভ্রান্তি একেবারে সাদাচোখেই দেখা যায়, খুব কম বুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায়।

কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি এখানে –
১. স্বদেশ রায় জানতেন প্রধান বিচারপতি কেন ছুটি নিয়েছেন, আমাদের আইনমন্ত্রী, আর এটর্নি জেনারেল জানতেন না! তাঁরা কেন আমাদের সামনে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ছুটি নেবার গল্প ফাঁদলেন? কেউ বলবেন ক্যান্সারের কথা তো জনাব সিনহা ই বলেছেন। বিদেশ যাবার প্রাক্কালে মৌখিক এবং লিখিতভাবে তিনি যা বলেছেন, সেটা কি প্রমাণ করে না, তথাকথিত ছুটির 'আবেদন' তিনি নিজে লিখেননি?

২. মাননীয় রাষ্ট্রপতি আর আপিল বিভাগের পাঁচ জন বিচারপতির মধ্যে যে গোপন বৈঠক হয়, এবং সেখানে রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের যা জানান, সেই তথ্য স্বদেশ রায়ের কাছে গেল কী করে? দেশের রাষ্ট্রপতি আর সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ পাঁচ জন মানুষদের মধ্যে একজন এই তথ্য স্বদেশ রায়ের কাছে ফাঁস করেছেন, এটা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?

৩. সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে জানা যায়, আজ থেকে ঠিক দুই সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রপতি জনাব সিনহা ব্যতীত সুপ্রিম কোর্টের অপর পাঁচ (একজন বিদেশে ছিলেন) বিচারপতিকে ডেকে পাঠান, এবং রাষ্ট্রপতি জনাব সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। এরপর উক্ত পাঁচ বিচারপতি প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়ে এই ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা চান। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সেটা দিতে ব্যর্থ হলে অপর পাঁচ বিচারপতি জানিয়ে দেন এমতাবস্থায় ওই অভিযোগসমূহের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে তাঁদের পক্ষে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সুষ্পষ্টভাবে বলেন যে, সেক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অসদাচরণের অভিযোগ আসলে সেই বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার এটাই কি সঠিক, সাংবিধানিক পদ্ধতি?

৪. ওই প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আরেকটা বিষয় একটু বুঝে নেয়া যাক। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে কয়েকটি মিডিয়া মারফত আমরা জেনেছি। সেগুলো হলো, যুদ্ধাপরাধী সাকা চোধুরীর আত্মীয়দের সাথে দেখা করা, উত্তয়ায় বাড়ি করার ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করা, ব্যাংক একাউন্টে চার কোটি টাকার হিসাবে গরমিল ইত্যাদি। খেয়াল করুন, প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটেছে অনেকদিন আগে, কিন্তু সরকারি তৎপরতা শুরু হয়েছে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর। মানে কি এটা নয়, এই রায় এবং এর আলোচিত পর্যবেক্ষণগুলো সরকারের মন মতো হলে এসব 'দুর্নীতি/অসদাচরণ' নিয়ে সরকার খামোশ হয়ে থাকতো?

৫. এবার আসি অসদাচরণ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে ওই সংশোধনীকে বাতিল তো করা হয়েছেই, সাথে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনস্থাপিত করা হয়েছে। আমাদের যে পাঁচ মাননীয় বিচারপতি রাষ্ট্রপতির ডাকে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন, তাঁরা সর্বসম্মতভাবে ওই রায় দিয়েছিলেন। তাঁদের সামনে যখন মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিয়ে এতো গর্হিত ১১ টি অভিযোগ এর দালিলিক প্রমাণ আসলো, তখন কি তাঁদের উচিত ছিল না, মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বলা তিনি যেনো এই ব্যাপারে সাংবিধানিকভাবে ব্যবস্থা নেন? তাঁরা কেন বিষয়টি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠাতে রাষ্ট্রপতিকে বলেননি? আমরা এটাও মনে রাখবো, রাষ্ট্রপতি নিজেও একজন আইনজীবী ছিলেন।

৬. প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অপরাদের 'দালিলিক প্রমাণ' পাবার পর অন্যান্য বিচারপতিরা যে তাঁর সাথে আর বিচারে বসবেন না বললেন, সেটা কি আইনসম্মত হয়েছে? একজন অভিযুক্ত মানুষ মানেই কি প্রমাণিত অপরাধী? তাঁর সাথে বসতে না চাওয়ার কি কোনো নৈতিক বা সাংবিধানিক অধিকার অন্য বিচারপতিদের আছে?

৭. আমাদের মনে থাকার কথা তথাকথিত ছুটি নেবার পর এই বিরাট 'অপরাধী'র কাছে আইনমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর অতি প্রভাবশালী উপদেষ্টা গওহর রিজভী কেন দফায় দফায় গিয়েছিলেন? কী আলোচনা করতে গিয়েছিলেন তাঁরা?

৮. আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন ১১ টি ভয়ঙ্কর অপরাধের দালিলিক প্রমাণ আছে, তখন কেন তাঁকে বিদেশে যেতে দেয়া হলো? এমন ভয়ঙ্কর একজন 'অপরাধী' কে কি উচিত ছিল না, সুপ্রিম জুডিশিয়াল এর মাধ্যমে ইমপিচ করা, এবং আইনের আওতায় আনা? এমনকি প্রধান বিচারপতির অপরাধের তদন্তের জন্য দুদক এর কাজ করতে কোনো আইনি বাধা নেই। তো, তাঁকে কেন বিদেশে যেতে দেয়া হলো?

এই পর্যন্ত যারা পড়লেন, তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারেন, আমি কি তাহলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেলের চিঠিটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি? আমি নিজেও আসলে ভীষণ সন্দ্বিঘ্ন। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে রবিবারই সুপ্রিম কোর্ট খুলছে, বিচারপতিদের কিছু বলার থাকলে তাঁরা আদালতেই তো বলতে পারতেন। তার আগের দিন ছুটির মধ্যে এমন বিবৃতি কি তড়িঘড়ি হয়ে গেল না? আর যখন তথাকথিত ছুটি নিয়ে চরম অবিশ্বাস তৈরির মতো ঘটনা ঘটে, তখন এসব বিষয়েও অবিশ্বাস তৈরি হলে সেই দায় কি মানুষের? একটা রাষ্ট্রের উঁচু সব পদে বসে থাকা মানুষরা যখন রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিচার বিভাগ নিয়ে ফাজলামো করেন, তখন অবিশ্বাসই অনিবার্য।

আসি শিরোনামের প্রসঙ্গে। আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে 'রেস্ট ইন পিস' বলার সময় এসে গেছে কিনা সেটা নিয়ে আমার কিছুটা সংশয় আছে, তবে এটা নিশ্চিত সর্বোচ্চ বিচারালয় নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে বলাই যায় এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে যাচ্ছেতাই রকম ছেলেখেলা করা হচ্ছে। আশংকা করি, এসব ছেলেখেলা এই ব্যবস্থাটিকে ভেঙে ফেলবে অচিরেই, আর 'রেস্ট ইন পিস জুডিসিয়ারি অব বাংলাদেশ' বলার পরিস্থিতি তৈরি করবে অচিরেই।

প্রাসঙ্গিক পাঠ: