ইন্টারনেটে ভিডিও ছড়ানো, অন্যায়কে প্রশ্রয় ও আমাদের আইন

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 9 Oct 2011, 06:02 AM
Updated : 9 Oct 2011, 06:02 AM

'পারসোনা'র সাম্প্রতিক ঘটনা প্রভার কথা মনে করিয়ে দিল অনেক দিন পর। মনে আছে তো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া মডেল এবং অভিনেত্রী প্রভার সেই বাক্তিগত ভিডিওটির কথা? শুধু মনে থাকাই নয়, অনেকেরই কম্পিউটারে এবং মোবাইলে এখনো নিশ্চয়ই ভিডিওটি আছে এবং সেটি এখনো নিশ্চয়ই অনেকের 'বিনোদনের' সঙ্গী। আসল বিষয় নিয়ে আলোচনার আগে আমার একটা বাক্তিগত লজ্জার কথা বলা দরকার এবং ক্ষমা চাওয়া দরকার তার জন্য।

প্রভার সেই ভিডিওটির একটি অংশ আমিও দেখেছিলাম। দেখা শেষ হবার পরই মনে হল, এ আমি কি করলাম!! ছি!! একজন নারীর ওপর পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম অন্যায়গুলোর একটি হল, আর আমিও ওই ভিডিও দেখে তার অংশ হয়ে রইলাম!! "বোন প্রভা আমি ভীষণ লজ্জিত, দুঃখিত, মনের গভীর থেকে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। এটা প্রায় নিশ্চিত যে এই লিখাটা তুমি পড়ছ না, কোনদিন তোমার সাথে দেখা হলে সামনাসামনি ক্ষমা চেয়ে নেব"। পরবর্তীতে প্রভার সেই ভিডিওটির অন্য কোন অংশ আমি আর দেখিনি, এবং প্রতিজ্ঞা করেছি এধরনের কোন ভিডিও আর কখনও আমি দেখবো না।

এর পর থেকে বন্ধু এবং চারপাশের মানুষদেরকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে – হতে পারে এই ভিডিওটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু এই ভিডিওটা দেখা মানে হল ওই ভয়ঙ্কর অন্যায়টাকে প্রশ্রয় দেয়া এবং তার অংশ হয়ে যাওয়া। ২/১ জন ছাড়া কেউ কিন্তু আমার কথা মানল না, বরং নানা খোঁড়া যুক্তি দেখাতে লাগলো – ভিডিওটাতো ইন্টারনেটে ছড়িয়েই পড়েছে এখন আমি এক জন না দেখলেই বা কি? কোন লাভ আছে? আচ্ছা, আপনারা যারা এই মুহূর্তে এই লিখাটি পড়ছেন, তারা কি ভিডিওটি দেখেননি? দেখে থাকলে এই দেখাটাকে কি আপনারা অন্যায় হিসেবে স্বীকৃতি দেন? আমি এই ব্লগে খোলাখুলি আমার নিজের স্বীকৃতি দিলাম। আপনারা খোলাখুলি স্বীকৃতি না দিতে চাইলেও অন্তত নিজের সামনে দাঁড়ান, একটু ভেবে দেখুন। আজ ইন্টারনেটে এসব ভিডিও কেন যায় জানেন? কারন আমরা সবাই এগুলো দেখি — নারী-পুরুষ, কিশোর-তরুন-বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আস্তিক-নাস্তিক, সবাই –- কি অসাধারণ সাম্য এই ব্যাপারে! অর্থনীতির একটা বেসিক নিয়ম আছে – 'চাহিদা ছাড়া কোন যোগানই হবে না'। তাই একথা নির্দ্বিধায়ই বলা যায় যে আমাদের নোংরা লালসা শুধু প্রভারই না, আরও অনেক নতুন নতুন ভিডিও আসার পথ খুলে দেয়। 'পারসোনা'তে এরকম কোন চেষ্টা যদি হয়েও থাকে (বিষয়টি যেহেতু প্রমাণিত না, তাই এই ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে মন্তব্য করছি না) সেটারও কারণ ওই একই – আমাদের নোংরা লালসা। আমরা কি খেয়াল করে দেখছি না যে আমাদের মধ্যে চরিত্রগত একটা ভয়ঙ্কর ভণ্ডামি ঢুকে গেছে – ওপরে ওপরে আমরা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভীষণ সমালোচনা করি, আবার আড়ালে এগুলো উপভোগ করি রসিয়ে রসিয়ে।

প্রভার ভিডিওটি বের হবার পরে আরেকটা ব্যাপার ভীষণ অবাক করে আমাকে – এই ঘটনার প্রতিবাদহীনতা। প্রভা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করে। তার সহকর্মীরা সবাই এই দেশের ভীষণ পরিচিত মুখ। তারা সবাই একত্রে রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করতে পারতেন, বিচারের মুখোমুখি করতে পারতেন প্রভার সাবেক প্রেমিককে যে ওই ভিডিওটি ইন্টারনেটে আপলোড করেছিলো। এটাও অবাক লাগে যে কেউ ওই মেয়েটিকে সাহস দিয়ে একটা কেস পর্যন্ত করাতে পারল না! যে মেয়েটি তার জীবনের চরম দুর্দিনে তার সহকর্মীদেরকেই পাশে পায়নি, সমাজের অন্য মানুষরা তার পাশে থাকবে – এটাতো অযৌক্তিক প্রত্যাশা। নানা জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক রুল জারী করে (সুয়ামটো) সরকারকে নানা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। কিন্তু আজকের এই ইনফর্মেশন টেকনোলজির যুগে এত বড় একটা সাইবার ক্রাইম এর ক্ষেত্রে তাদের সুয়ামটো রুল জারি করা জরুরী মনে হয়নি। এই ঘটনায় যদি প্রভার সাবেক প্রেমিকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো তাহলে আমাদের সমাজে এরকম অপরাধ করতে কেউ সহজে সাহস করতো না। প্রতিবাদ করাতো দুরেই থাকুক, অনেকেই বরং এই সমালোচনা করেছেন যে 'ছি, মেয়েটা কি করে এই বাজে ভিডিও করল'। প্রভার ভিডিওটি করা কোন অনৈতিকতা (আমি ধর্মীয় নৈতিকতার কথা বলছি না) হয়নি – আলোচনা করে সেটা প্রমাণ করা যায়, তবে সেই আলোচনার স্থান এটা নয়।

প্রভার ভিডিও, বা কিছুদিন আগে বের হওয়া ভিকারুন্নিসা স্কুলের শিক্ষক পরিমলের ভিডিও, বা হালের 'পারসোনা'র ঘটনা, এগুলো সব আসলে এক সুতোয় বাঁধা। এগুলো কিন্তু রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। রোগগুলো হল আমাদের বিকৃত যৌনচেতনা, চারিত্রিক ভণ্ডামি, অন্যায়ের প্রতিবাদহীনতা, অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যার্থতা। এই রোগগুলোর চিকিৎসা না করে আমরা যত কথাই বলি না কেন, এই ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে।

জানি না এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে কিনা, তারপরও বলছি – আমার বিশ্বাস যারা এতক্ষন লিখাটি পড়লেন, তাদের প্রায় সবাই এ ধরনের ভিডিও পেলে দেখেন (নিদেনপক্ষে প্রভার ভিডিওটি দেখেছেন)। আসুন আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, আগে আমরা নিজেদের শুধরে নেব। এই ধরনের ভিডিও বয়কট করব, অন্যদেরকে বয়কটে উদ্বুদ্ধ করব – অন্তত বিলি করে বেড়াব না। এতে এই সব নোংরা ভিডিওর চাহিদা কমে যাবে – যেটা ধীরে ধীরে যোগানকে কমিয়ে দেবে। নিজেদেরকে শুধরে নিয়ে আমদের এরকম প্রতিটা ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে, রাষ্ট্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করতে হবে। কিছুদিন আগে ভিকারুন্নিসা স্কুলের ঘটনায় আমরা দেখলাম প্রতিবাদের মুখে সরকার ওই নোংরা লোকটাকে (পরিমল) গ্রেফতার করতে বাধ্য হল। স্যালুট জানাই ওই পিতাকে যিনি ফালতু 'সামাজিক মর্যাদাকে' তোয়াক্কা না করে আইনের কাছে গিয়েছিলেন।

আর এসব যদি করতে না পারি তবে কোন এক দিন এমন হতেই পারে যে আমরা নতুন একটা 'মাল' এর ভিডিও পেয়ে লোভে জিভ লকলক করতে করতে দেখতে গিয়ে হয়ত আবিষ্কার করব – ভিডিওর মেয়েটা পরিচিত বা ভীষণ কাছের কেউ।