মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারঃ সর্ষের মধ্যেই ভূত নেই তো?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 28 Dec 2011, 01:51 PM
Updated : 28 Dec 2011, 01:51 PM

কয়েকদিন আগে জামাতের সাবেক আমীর, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সবচাইতে ঘৃন্য ব্যক্তি গোলাম আজমের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগ 'যথাযথভাবে বিন্যস্ত' না হওয়ায় ট্রাইবুনাল সেটা ফেরত দিয়ে নতুন করে আবার যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে বলেছেন। আজ দেখলাম আবার একই সমস্যায় আলি আহসান মুজাহিদ এবং কামারুজ্জামানের অভিযোগও ফেরত দিয়ে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।

কয়েকদিন আগে গোলাম আজমের ঘটনাটির পর তাঁর আইনজীবী ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাকের দম্ভোক্তি দেখে রাগে ক্ষোভে জ্বলছিলাম। তার বক্তব্যের সারমর্ম মোটামুটি এরকম "গত দুই বছর ধরে কাজ করেও এই ঘটনা হওয়া প্রমান করে এই বিচার শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই করা হচ্ছে"। তিনি আইনজীবী, মক্কেলের (তিনি তো গোলাম আজমের ভাবশিষ্যও) পক্ষে বলার মত এমন দারুন একটা সুযোগ পেয়ে তিনি ছাড়বেন কেন?

অভিযোগপত্রটি বাতিল করে নতুনভাবে দিতে বলার পর গোলাম আজমের আইনজীবীর মুখে এমন কথা কি খুব অযৌক্তিক শুনিয়েছে? আমার কাছে না। তার মন্তব্য কতটা যৌক্তিক হয়েছে সেই আলোচনায় যাচ্ছি না; বরং আমার প্রশ্ন, এতো বাজে একটা ভুল করে কেন রাজ্জাককে এই মন্তব্য করার সুযোগ দেয়া হোল? আজ আবার আরো দুই জনের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটলো। আব্দুর রাজ্জাকদের ওসব মন্তব্য করার আরো চমৎকার সুযোগ কি এসে গেলো না?

এখন প্রশ্ন হল, যে কর্মকর্তারা ঐ অভিযোগপত্রটি তৈরী করেছিলেন, তারা কি যোগ্য ছিলেন? যোগ্য হয়ে থাকলে এত হাস্যকর ভুল তারা করলেন কীভাবে? জামাতের কাছ থেকে কোন সুবিধা নিয়ে? আর যদি তারা যোগ্য না হয়ে এমনিই ভুলটা করে থাকেন তবে ওই সব অযোগ্য লোককে ঐ যায়গায় নিয়োগ দেয়া হল কেন? এটা তো তাহলে সরকারের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা।

শুধু এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে আমার লিখার এই শিরোনামের যোউক্তিকতা নিয়ে কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন। আমি আসলে শুধু এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে এই শিরোনাম দেইনি; মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা বেশ কিছু ঘটনা আমার মনে এই সন্দেহ তৈরি করেছে।

ট্রাইবুনালের স্থান নির্বাচন নিয়ে শুরু; শেষে সবার চাপে পড়ে সরকার পুরনো হাইকোর্ট ভবনকে নির্বাচন করে। প্রশ্ন ওঠে তদন্তকারী এবং আইনজীবী প্যানেলের দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়ে। এমনকি একজনের বিরুদ্ধে তো জামাতের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ উঠেছিল। আওয়ামী লীগের এতো দক্ষ-যোগ্য আইনজীবীরা থাকলেও এই ট্রাইবুনালে নিয়োগ দেয়া হয়নি তাদের। কেন? যতোই আমরা এটাকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীন বিষয় বলি না কেন, এই বিচারের দিকে দৃষ্টি সারা পৃথিবীর (আর আমরাও এটাকে কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলছি)। তাই এখানে সবচাইতে দক্ষ আইনজীবীদেরই কি নিয়োগ দেয়ার দরকার ছিল না? আমি আইনজীবী নই, তবে টিভি ক্যামেরার সামনে অন্তত আমাদের ট্রাইবুনালের আইনজীবীদের অভিযুক্তদের আইনজীবীদের তুলনায় অনেক কম আত্মবিশ্বাসী এবং কম বাগ্মী মনে হয়েছে আমার কাছে।

কিছুদিন আগে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিশাল তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়া হয়। রিপোর্ট নিয়ে তার আইনজীবীরা প্রশ্ন তোলেন যে রিপোর্টের বিরাট অংশের ছাপা অস্পষ্ট। প্রথমে ভেবেছিলাম ওটা বাজে অভিযোগ, কিন্তু পরে অবাক হয়ে দেখলাম বিচারকরাও এই অভিযোগ আমলে নিয়ে ভাল ছাপার রিপোর্ট দিতে বলেন। অবাক হয়ে ভাবি একটা রাষ্ট্রের ভাল ছাপার মেশিন নেই? জমা দেবার আগে কেউ খেয়াল করলেন না যে লিখা পড়াই যায় না ঠিকমত? এটা কি ছেলেখেলা?

আমার জন্ম স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পরে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গোলাম আজম আর যুদ্ধাপরাদের কথাকে সমার্থক হিসাবে শুনছি। এই প্রধান লোক আজো বাইরে কেন? যদ্দুর খোঁজ খবর নিয়েছি, তাতে জানি এই অপরাধের অকাট্য তথ্য-প্রমান তার বিরুদ্ধেই সবচাইতে বেশী। কিন্তু তারপরও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে ৩ বছর লেগে গেলো? কিছুদিন আগে টিভিতে তার সাক্ষাৎকারে তার সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী চেহারা, কন্ঠস্বর দেখে অবাক হয়েছি। এত আত্মবিশ্বাস এরা পায় কোথায়? তবে তারা কি জেনে গেছে যে তাদের কিছু হবে না?

আরেক দিকে ক্ষমতাসীনরাতো দেশের যাবতীয় সব সমস্যার সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর কথা বলে বলে ব্যাপারটাকে একটা কৌতুকে পরিনত করেছে। কিছুদিন আগে এক আড্ডায় একজন মশার উৎপাত বাড়ার কথা বলার সাথে সাথে আরেকজনের চটপটে জবাব "যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য বিএনপি-জামাত মশার সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে" – যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের ফালতু কথাগুলোই কি মানুষকে এমন মন্তব্য করার ক্ষেত্র তৈরী করে দিচ্ছে না?

কয়েক বছর আগে ডঃ আবুল বারাকাত একটা গবেষণায় দেখিয়েছেন জামাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাৎসরিক আয় কমপক্ষে ১৪০০ কোটি টাকা। তাদের এই টাকার শক্তি, সাথে মধ্যপ্রাচ্যের টাকা আর শক্তির চাপ সব মিলিয়ে এই বিচারটা একটা প্রহসনে পরিনত হচ্ছে কিনা সেই আশঙ্কা আমার কিছুদিন থেকেই হচ্ছে। কারন এই দেশে টাকায় প্রায় সবাই বিক্রী হয়; রাজনীতিবিদরা একটু বেশীই। তার ওপর আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে বিএনপি যদি নির্বাচন না করে সে ক্ষেত্রে জামাতকে এককভাবে নির্বাচনে আনার কৌশল হিসাবে এই বিচারকে ঝুলিয়ে রাখা হতে পারে বলে শুনছি।

এই সব কিছু দেখেই আমার বার বারই মনে হচ্ছে সর্ষের ভেতরই ভুত আছে সম্ভবত। আর সেটা যদি থেকেই থাকে তাহলে আমরা, সাধারন মানুষেরা যত আশায়ই বুক বাঁধি না কেন, এই বিচার হবে না। লক্ষন সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে আমার অনুমান-আশংকা যদি ভুল প্রমানিত হয় তবে ভীষন খুশি হব আমি।

গত নির্বাচনের আগে আমার মত অনেক মানুষ আওয়ামী লীগের এই বিচারের কথায় আস্থা রেখেছিল। কিন্তু ইদানিং আমি প্রতারিত বোধ করছি, এবং সেটা সঙ্গত কারনেই। এই বিচারের উদ্যোগ নিয়ে সেটা সফলভাবে শেষ না করে এটাকে প্রহসনে আর রাজনৈতিক খেলায় পরিনতি করা হলে এই বিচার এই দেশের মাটিতে ভবিষ্যতে আর কোনদিন ভালভাবে হবার পথ অনেকটাই রুদ্ধ করে দেবে। এবং সেই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটার দায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটাকেই বয়ে যেতে হবে চিরকাল।